উনার মনে হলো, অমনি বলে দিলেন আর কি! আরে উনি! আমাদের সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ সাহেব। বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধপরাধী নেই। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিও নেই। মাশাল্লাহ, কী ভয়ানক মিথ্যা কথা! তারে জিজ্ঞাস করা হয়েছে ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা কি ছিল। উনার জবাব- সেটা আপনারা খোজ করে দেখুন, মূল্যায়ন করুন।
ঠিক আছে জনাব। আপনার ভূমিকা কি ছিল সেটাই আমরা একটু খোঁজ করি, তারপর বাকিরা না হয় মূল্যায়ন করবেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ফকিরাপুল, নয়াপল্টন এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে থাকতেন। তার মধ্যে একটি হলো- শেখ ভিলা, ৩/৫ নয়াপল্টন। তবে তার প্রধান আড্ডা ছিল ফকিরাপুল গরম পানির গলিতে ফিরোজ মিয়ার ১৮১ নং (এখন ২৫৮ নং) বাড়িটি।
‘৭১ এ মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বর্তমানে জাতীয় পার্টির নেতা আবদুস সালাম, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক জিএম গাউস, মুক্তিযোদ্ধা ও কলামিস্ট মাহবুব কামালের সাক্ষ্য অনুযায়ী জানা গেছে, ফিরোজ মিয়া ছিলেন এলাকার রাজাকার কমান্ডার। তার বাড়িটি শুধু ফকিরাপুল নয়, গোটা ঢাকার রাজাকারদের অন্যতম ঘাটি ছিল। এখানেই অনুষ্ঠিত হতো রাজাকারদের বিভিন্ন সভা, সশস্ত্র ট্রেনিং ইত্যাদি। এখান থেকেই পরিচালিত হতো রাজাকারদের বিভিন্ন অপারেশন, রাজাকার রিক্রুটমেন্ট। এখানে এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির লোকদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো।
ফিরোজ মিয়া গংয়ের নীতি নির্ধারক ছিলেন আলী আহসান মুজাহিদ। কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তার নেতৃত্বেই পরিচালিত হতো যাবতীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা।
জিএম গাউস বলেছেন- ‘৭০ এর মাঝামাঝি সময় থেকে আমরা ফকিরাপুল এলাকার ভাড়াটিয়া আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে চিনতাম জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র সংঘের লোক হিসেবে। এলাকায় তার সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতেন তিনি। কেন্দ্রীয় সমাবেশে এলাকা থেকে লোক নিয়ে যেতেন, এলাকার ছেলেদের ছাত্র সংঘে যোগদানের ব্যাপারে প্ররোচিত করতেন।
‘৭১ এর মার্চের পর মুজাহিদের সার্বিক তত্বাবধানে ফকিরাপুলে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। যার নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয় ফিরোজ মিয়া ওরফে ফেরু মেম্বারকে। মুজাহিদের সরাসরি নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছে ফকিরাপুল এলাকায় রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা, অস্ত্র ট্রেনিং, রিক্রুটমেন্ট ইত্যাদি। তিনি এলাকায় যাবতীয় দুষ্কর্মে সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময় এ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবিদের ধরে এনে অত্যাচার নির্যাতন এমনকি হত্যা করার উদ্দেশ্যে গঠিত আলবদর বাহিনীর নেতা ছিলেন আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ।
আবদুস সালাম বলেছেন, ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ফকিরাপুল গরম পানির গলির ফিরোজ মিয়ার বাড়িটি ছিল রাজাকারদের অন্যতম নির্যাতন কেন্দ্র। এই ফিরোজ মিযা গংয়ের নীতিনির্ধারক বা পরামর্শদাতা ছিলেন মুজাহিদ। অবশ্য কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে শুধু ফকিরাপুল নয়, মুজাহিদের অপতৎপরতা ছিল গোটা ঢাকা জুড়ে। বিজয়ের পর আমি আমার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ফিরোজ মিয়ার বাড়ি থেকে প্রচুর মূল্যবান দলিল ও ছবি উদ্ধার করি। কাগজ পত্রগুলোতে ঢাকা শহরের রাজাকারদের তালিকা, বায়োডাটা, ছবি ও তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডের দলিল ছিল যা ছাপা হয়েছে একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায় বইটিতে।
কলামিস্ট মাহবুব কামাল বলেছেন, ফিরোজ মিয়ার বাড়িটি ছিল ষড়যন্ত্রের ঘাটি। এই বাড়িতে বসেই ফেরু মেম্বার ও আলী আহসান মুজাহিদ বিভিন্ন গুটি চালতেন। মুজাহিদের নির্দেশে ফিরোজ মিয়া ও তার সাগরেদরা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে তল্লাসী চালাত। তখনকার ইউনিয়ন আওয়ামী লিগের সাধারণ সম্পাদক জোবেদ আলীর বাড়িতে বেশ কয়েকবার তল্লাশী চালানো হয়েছে। আমাদের বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা নাজুর বাড়িতেও অনেকবার হানা দিয়েছে তারা।
আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে নাজু নিখোজ হয়ে যায়। ধারনা করা হয় মুজাহিদের নির্দেশে ফিরোজ মিয়া গংই তাকে হত্যা করেছে। আমার এক চাচাত ভাই মহসিন চাকরি খুঁজতে রাজশাহী থেকে ঢাকা আসে। সে আমাদের বাসাতেই থাকত। নিয়মিত নামাজ পড়ত।
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় তাকে খুব অস্থিরচিত্ত ও ভীত দেখাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করে জানলাম আলী আহসান মুজাহিদ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তাকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বলা হয়েছে এবঙ হুমকি দিয়েছে রাজাকার বাহিনীতে যোগ না দিলে তাকে মেরে ফেলা হবে। মুজাহিদের হাত থেকে বাচাতে তাকে আমরা রাজশাহী পাঠিয়ে দিই। এখন সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। ”
মুজাহিদের রিক্রুট ফিরোজ মিয়া ফকিরাপুলে ৩০০ সদস্যের একটি রাজাকার প্লাটুন গড়ে তুলে।
এলাকার প্রবীন বাসিন্দাদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, যুদ্ধের সময় সে ফকিরাপুর ও আরামবাগ এলাকার শত শত বাঙালীকে হত্যা করেছে। নির্যাতন করেছে এলাকার মেয়েদের উপর।
‘৭১ এর ছাত্র সংঘ নেতা ও বদর বাহিনীর প্রধান মুজাহিদের অপতৎপরতার ছবিও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। ১১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে প্রকাশিত একটি ছবির ক্যাপশন ছিল : গতকাল গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী প্রদান করিয়া আলবদর আয়োজিত পথসভায় বক্তৃতা করিতেছেন আলবদর প্রধান জনাব মুজাহিদ। আলী আহসান মুজাহিদের স্বাধীনতা বিরোধী তৎপরতা ও নৃশংসতা ‘৭১এই শেষ হয়ে যায়নি।
এর ধারাবাহিকতা চলছে এখনো। আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ বর্তমানে জামাতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ১১ নভেম্বর ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় - ১৯৭৮ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্রনেতা মওলানা আবদুস সোবহানকে শিবির কর্মীরা কোরআন পাঠরত অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করে। বিশেষ সূত্রে জানা যায়, এই হত্যা অভিযানের নেতৃত্ব দেয় ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মুজাহিদ। ’
তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বকোষ (প্রথম খন্ড) -সম্পাদনা মুনতাসীর মামুন
`একাত্তরের ঘাতক-দালালেরা কে কোথায়' থেকে :
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরী প্রধান ছিলেন আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দলীয় আদর্শ অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনে সহযোগিতা করেছেন। তার নেতৃত্বাধীন আলবদর বাহিনী বিজয়ের আগমুহূর্তে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে এদেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবিদের।
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের স্বাধীনতাবিরোধী ততপরতার বিবরণ পাওয়া গেছে সে সময়কার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তার বক্তৃতা ও বিবৃতিতে। ‘৭১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে ছাত্র সংঘের এক জমায়েতে `বিপুল করতালীর মধ্যে' আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ঘোষনা দেয় `ঘৃন্য শত্রু ভারতকে দখল করার প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের আসাম দখল করতে হবে। এজন্য আপনারা সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহন করুন।
'
১৫ অক্টোবর ১৯৭১ সালে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়- `রাজাকার ও আলবদরদের ভুমিকা সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি জনাব আলী আহসান মুজাহিদ জনাব ভুট্টো, কাওসার নিয়াজী ও মুফতি মাহমুদের তীব্র সমালোচনা করেন। ... এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, `পুর্ব পাকিস্তানে দেশপ্রেমিক যুবকেরা ভারতীয় চরদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছে এবং রাজাকার, আলবদর ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য হিসেবে জাতির সেবা করছে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে কতিপয রাজনৈতিক নেতা যেমন জনাব জেড এ ভুট্টো, কাওসার নিয়াজী, মুফতি মাহমুদ ও আসগর খান রাজাকার, আলবদর ও অন্যান্য দেশহিতৈষী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করে বিষোদগার করছেন। এসব নেতার এ ধরণের কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য এবং এ ব্যাপারে কঠোর মনোভাব গ্রহন করার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান। পরিশেষে ছাত্র সংঘ নেতা ক্লাসে যোগদানের জন্য এবং সেইসঙ্গে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য আলবদর ও দেশ হিতৈষী ছাত্রদের প্রতি আহবান জানান।
'
ছবি : ১.ফকিরাপুলে ফিরোজ মিয়ার নেতৃত্বে রাজাকারদের ট্রেনিং
২. বদর দিবসে মুজাহিদের বিবৃতি
৩. প্রথম আলোর স্পেশাল রিপোর্ট
৪. বদর বাহিনীর হয়ে মুজাহিদের ভাষণ
কৃতজ্ঞতা : মাহবুবুর রহমান জালাল ও জন্মযুদ্ধ
মূল পোস্ট: অমি রহমান পিয়ালের ব্লগ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।