মানুষে মানুষে সমানাধিকারে বিশ্বাস করি
ষাটের দশক বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির স্বর্ণসময় হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় আলো ছড়িয়েছে। । সারাদেশের মত সাতক্ষীরা অঞ্চলেও তখন স্বাধীকার আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। পাকিস্তানী শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিকতা এবং পূর্ব বাংলার সম্পদ লুন্ঠন প্রক্রিয়ায় নিপীড়িত বাঙালী ফুঁসে উঠছে দিকে দিকে। ঠিক এমনই এক সময়ের সন্তান মোস্তাফিজুর রহমান।
১৯৪৯ সালের ১০ অক্টোবর কলারোয়ার বসন্তপুরে জন্ম নেয়া মোস্তাফিজুর রহমান জাহাঙ্গীর পিতৃহারা হন ১৯৫৯ সালে। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন টাউন হাইস্কুল (বর্তমান সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে এস.এস.সি পাস করেন। স্কুল জীবন থেকেই সোস্তাফিজুর রহমান তৎকালীন উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশের উত্তাপ পেয়েছিলেন। তখনকার দিনে অনেক সময় কোন প্রতিবাদ মিছিল বা হরতাল হলে স্কুলে গিয়ে নেতারা ঘন্টা পিটিয়ে স্কুল ছুটি করে দিতেন। মোস্তাফিজুর রহমান সেই সময়ের ছাত্র হওয়ায় রাজনৈতিক শিক্ষা তার ক্রমশ হচ্ছিল জাতীয় পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে।
১৯৬৭-৬৮ সালেই তিনি তৎকালীন সাতক্ষীরা মহাকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন।
তিনি মিছিল শুরু করতেন কয়েকজনকে সাথে নিয়ে। আর পথ যতই এগোত মিছিলের লাইন ততই দীর্ঘ হত। বাইসাইকেলে চড়ে সাতক্ষীরা থেকে শ্যামনগরে(মাত্র ৬৫ কি.মি, তখন প্রায় পুরোটাই রাস্তা খারাপ ছিল) গিয়েছেন সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে। তার অসাধারণ বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়ে কত তরুণ যে আদর্শিক রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিল তার কোন হিসেব নেই।
মোস্তাফিজুর রহমান স্বল্পতম সময়ের মধ্যে অনন্য এক ব্যক্তি হিসেবে সকলের প্রিয় হতে পেরেছিলেন তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সততার কারণে। বর্তমান সময়ে আমরা সংবাদপত্রের পাতা খূললেই দেখি একের পর এক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত করা হচ্ছে। তখনকার দিনের দেয়াল লিখন ছিল একটি অনন্য শিল্প। শহরের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেত বিপ্লবের শ্লোগান, মানবমুক্তির আহবান। আর এসব শ্লোগান লিখত ছাত্র সংগঠনের মেধাবী তরুণ কর্মীরা।
এখন লোক ভাড়া করে দেয়াল লিখন চলে। আর লেখার ভাষায় দেশপ্রেম-মানবমুক্তির পরিবর্তে সন্ত্রসী, গডফাদার, চোরাকারবারি আর দুর্নীতিবাজদের স্বপক্ষে নগ্ন মিথ্যাচারই প্রধানত ফুটে ওঠে।
মোস্তাফিজুর রহমান রাত জেগে দেয়ালে দেয়ালে মেরেছেন মুক্তির পোস্টার। সহকর্মীদের সাথে নিয়ে দিনের পর দিন সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য পাঠচক্রের আয়োজন করেছেন। সমাজের কোথাও কোন অন্যায় দেখলেই রুখে দাড়িয়েছেন ব্যঘ্রমূর্তি নিয়ে।
আর সেকারণেই তাকে সকলে সাতক্ষীরার বাঘ বলতনে। দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসর কারণেই তার রাজনীতিতে যোগদান। সমাজের অসহনীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানবতার মুক্তির স্বপক্ষে ছিল তার লড়াই। দিনের পন দিন না খেয়ে, বাড়ির বাইরে কাটাতে হয়েছে রাজনীতির কারণে। ছয় দফা দিবসে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে তার নেতৃত্বে মিছিল বের হওয়ায় ১৯৬৭ সালের ৭ জুন প্রথমবার কারারুদ্ধ হন।
এরপর বহুবার জেল খেটেছেন ঐ রাজনৈতিক কারণে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথানের সময় তিনিই ছিলেন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সাতক্ষীরার আহবায়ক। ১৯৭-৭২ সালে তিনি ছিলেন সাতক্ষীরা মহাকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি। ১৯৭১ সালে তিনি হন স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সাতক্ষীরার আহবায়ক। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মোস্তাফিজুর রহমান সাতক্ষীরা মহাকুমা মুজিব বাহিনীর সহকারী প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের প্রতিবাদে তিনি জাসদে যোগ দেন। জাসদে যোগ দেয়রি আগ মুহুর্তেও তোফায়েল আহমদ তাকে অনুরোধ করেন, সাতক্ষীরার আশাশুনি থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ৭৩’এর সংসদ নির্বাচনে প্রাথী হওয়ার জন্য। কিন্তু ঐ নির্বাচনে ২৪ (২৫ দেখাতে হয়েছিল) বছর বয়সে প্রার্থী তিনি হয়েছিলেন জাসদের হয়ে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরা সদর আসনে। তিনি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ (খালেকুজ্জামান)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির ১২জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের একজন।
বাংলাদেশের যা কিছু রাজনৈতিক অর্জন তার সাথে এদেশের গৈারবজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতির গভীর সম্পর্কের কথা আমরা মুগ্ধ চিত্তে স্মরণ কর্।
ি আর এই ইতিহাস সম্ভব হয়েছিল মোস্তাফিজুর রহমানদের মত ত্যাগী এবং দেশপ্রেমী ছাত্র নেতৃত্বের কারণে। যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আপন প্রাণ বলি দিতে শত্র“র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন স্বার্থহীন।
আমদের দেশে বর্তমানে ছত্র রাজনীতি বন্ধের এক ধরণের অকল্যাণকর প্রচেষ্টা এক শ্রেণীর সুবিধাবাদীদের দ্বারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এরা দেশ থেকে প্রতিবাদের ভাষা তুলে দিতে তৎপর। এরা কিন্তু বলে না দেশের রাজনীতি আজ কলুষিত সুতরাং, রাজনিিতর বন্ধ করে দিতে হবে।
ছাত্র রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন যে কেন্দ্রীয় রাজনীতির দ্বারাই হচ্ছে এবং হয়েছে সেটি এদের কেউ কেউ বোঝে বটে, কিন্তু সুবিধাবাদিতার কারণে সে বিষয়ে নিরব থাকে। ছাত্র রাজনীতিকে আদর্শের রাস্তায় ফিরিয়ে আনতে হবে। মোস্তাফিজুর রহমানদের মত নেতাদের দরকার ছাত্র রাজনীতিতে। যারা দেশকে ভালোবাসবেন, প্রতিবাদ করবেন অন্যায়ের। যাদের বলিষ্ট হাত দুর্বলকে রক্ষা করবে অত্যাচার থেকে।
যাদের হাত কলুষিত হয়নি কখনও অবৈধ অস্ত্র আর টেন্ডাবাজির বদনামে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে সবকিছু নষ্টদের হাতে চলে যাবে। সমাজ স্থবির হয়ে পড়বে। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত চলে যাবে সুযোগ সন্ধানীদের হাতে। এ সমাজে আর কখনও মোস্তাফিজুর রহামানদের আবির্ভাব হবে না।
অত্যাচারীর পাষাণ হৃদয়ে আঘাত হানতে পারার মত নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হলে কলুষমুক্ত সেই সোনালী দিনের আদর্শভিত্তিক ছাত্র রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন চাই। নেতৃত্ব চাই মেধাবী ও দেশপ্রেমিকের। চাই আরও অনেক মোস্তাফিজুর রহমানদের যারা বদলে দিবে এই নষ্ট, ঘুঁণে ধরা সমাজ।
২০০৭ সালের ৩০ মার্চ ডায়বেটিক এবং কিডনি রোগে মোস্তাফিজুর রহমান মারা যান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।