মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা নাগরিকদের বাংলাদেশি সেজে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা সম্প্রতি খুব বেড়ে গেছে। চলতি বছরের পাঁচ মাসে রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জাল পাসপোর্টসহ ৭৭ জন রোহিঙ্গা ধরা পড়েছেন।
বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এএপি) সদস্যরা তাঁদের আটক করলেও আইনের ফাঁক গলে তাঁরা জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। পরে আবার বাংলাদেশি নাগরিক বনে একই চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ কারণে সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না, বরং তা ক্রমে জটিল হয়ে উঠছে।
এএপি সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে বিদেশ গমনে উদ্যত ৫০ জনের বেশি রোহিঙ্গাকে বিমানবন্দরে আটক করে তারা। এ বছর চলতি মাসেই এ ধরনের ৪২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। এসব রোহিঙ্গাকে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টায় সহযোগিতা করে একশ্রেণীর দালাল।
রোহিঙ্গারা ধরা পড়ার সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দালাল পালিয়ে যায়। পরে তারা রোহিঙ্গাদের মুক্ত করার চেষ্টা চালায়।
তাদের সহযোগিতায় আটক রোহিঙ্গারা আইনের ফাঁকফোকর গলে অল্পদিনের মধ্যে জামিনে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে আবার বাংলাদেশি বনে যান।
ঢাকার পাসপোর্ট অফিস, আদালতপাড়া, কক্সবাজারের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশে রয়েছে এই দালালদের তত্পরতা।
বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া
বিমানবন্দর থানায় করা মামলা ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের মাটিতে নয়, মিয়ানমারে থেকেই বাংলাদেশি পরিচয়ে বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে রোহিঙ্গারা। তাদের মূল আবাস মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে থাকায় রোহিঙ্গাদের ভাষা বাংলাদেশের কক্সবাজারের বাসিন্দাদের মতো।
চেহারা ও শারীরিক গড়ন একই আদলের। সুযোগটি কাজে লাগায় দালাল চক্র। বাংলাদেশ থেকে তুলনামূলকভাবে কম অর্থে সহজে যাওয়ার মতো শ্রমবাজার রয়েছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। এসব বাজারে রোহিঙ্গাদের পাঠিয়ে ফায়দা লোটার জন্য মাঠে নামে দালালেরা।
বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ হাতে আটক হওয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে রোহিঙ্গারা এসব তথ্য দিয়েছে বলে জানা গেছে।
রাখাইন প্রদেশে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে রোহিঙ্গারা। সে ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে তারা বাংলাদেশকে বেছে নেয়।
দালালদের দৌরাত্ম্য দেশে-বিদেশে
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে বিদেশ পাঠাতে শুধু মিয়ানমার বা বাংলাদেশ নয়, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই আছে দালালদের শক্তিশালী যোগাযোগব্যবস্থা। এই দালালেরা বিদেশ গমনেচ্ছুক রোহিঙ্গাদের জন্য জাল পাসপোর্ট সংগ্রহ করে দেয়।
এসব পাসপোর্ট বাংলাদেশ থেকে কেনা হয়।
আবার যেসব দেশে পাঠানো হবে, সেখান থেকেও কোনো না কোনো বাংলাদেশির কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশের মুদ্রায় একেকটি পাসপোর্ট ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় কেনা হয়। যিনি পাসপোর্টের আসল বাহক, তিনি ‘হারিয়ে গেছে’ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে অন্য একটি পাসপোর্ট তুলে নেন। পাসপোর্ট পেয়ে সেখানে ছবি পরিবর্তন করানো হয়। দালালেরা এ ক্ষেত্রে এতটাই দক্ষ যে, মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের ছবিও বদলে ফেলছে খুব সহজে।
আটক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে করা এজাহার ও ঢাকায় পাসপোর্ট অফিস সূত্র থেকে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বিদেশগামী রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে দুই থেকে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় দালালেরা। টাকা ও জাল পাসপোর্ট সংগ্রহের পর প্রথম চট্টগ্রাম শহরে, এরপর রাজধানী ঢাকায় নেওয়া হয় এসব রোহিঙ্গাকে। সাধারণত ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারী-পুরুষ পড়েন বিদেশ যাওয়ার ফাঁদে। ঢাকায় ফকিরাপুল, আরামবাগ, মগবাজারের ছোট ছোট হোটেলে রাখা হয় তাঁদের।
এসব প্রক্রিয়ায় এক মাস বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। এ সময় রোহিঙ্গাদের ভাষা, বিমানবন্দরে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে সম্ভাব্য প্রশ্ন, উত্তরসহ বিভিন্ন বিষয়ে তালিম দেওয়া হয়। বিমান টিকিট কেনার পর ধরা না পড়লে তাঁরা বিদেশে চলে যান। আর্থিক জোগানটি বিদেশে অবস্থানরত স্বজনদের কাছ থেকে পেয়ে থাকেন।
হুন্ডির মাধ্যমে টাকা রূপান্তর করে দালালদের পাওনা মেটানো হয় বলে জানান বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের কমান্ডিং অফিসার মো. আবদুল্লাহ আরেফ।
প্রথম আলো ডটকমকে তিনি বলেন, ‘বিদেশে চলে গেলে পাসপোর্ট বদলে এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যায়। এরাই সেসব দেশে নানা ধরনের অপরাধ করে থাকে। বদনাম হয় বাংলাদেশির। ’
দেশে ধরা পড়লেও হয়ে যায় বাংলাদেশি
বিমানবন্দরে ধরা পড়ার পর সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করে আর্মড পুলিশ। কখনো থানার উপপরিদর্শক, কখনো বা সিআইডি বাদী হয়ে আটক হওয়া রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা করে।
এরপর রোহিঙ্গাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় আদালতে। কয়েক দিন জেলহাজতে থাকার পর কক্সবাজারের কোনো না কোনো ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদ থেকে তোলা নাগরিকত্বের সনদ দেখিয়ে বা জামিনদারের মাধ্যমে ছাড়া পেয়ে যায় রোহিঙ্গারা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রোহিঙ্গা পরিচয় দিলেও আদালতে নিজেদের তারা বাংলাদেশি হিসেবে দাবি করে। এ ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের পাসপোর্ট আদেশকে কাজে লাগিয়ে বের হয়ে আসে রোহিঙ্গারা। ৪০ বছর আগের পাসপোর্ট আদেশে জাল পাসপোর্টসহ আটক হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ৫০০ টাকা জরিমানা বা দুই মাসের কারাদণ্ডাদেশের বিধান রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের কারণে বিশ্বে শ্রমবাজারেও প্রভাব পড়ছে—এমন মন্তব্য করেছেন বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের কমান্ডিং অফিসার মো. আবদুল্লাহ আরেফ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা বিদেশে হত্যা-খুন, মাদক ব্যবসার মতো ভয়ংকর অপরাধ করছে। অথচ পরিচয় পাচ্ছে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে। এতে বাংলাদেশের বদনাম তো হচ্ছেই, শ্রমবাজারেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
এ বিষয়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন জানিয়ে আবদুল্লাহ আরেফ বলেন, এসব রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে জঙ্গি তত্পরতায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তাই তাদের ওপর নজরদারি দরকার।
মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট জাল
১৮ মে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জাল মেশিন রিডেবল পাসপোর্টসহ আর্মড পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিলেন মো. তাহাজ্জুদ (৩৮) নামের টাঙ্গাইলের এক ব্যক্তি। এডি ৯১৬৩৪৮৬ নম্বরে মেশিন রিডেবল এই পাসপোর্টে ছবি বদল করে মালয়েশিয়া যাবার কথা ছিল তাহাজ্জুদের। তাঁর সঙ্গে পাসপোর্টের আসল বাহক মাদারীপুরের আকবর ফকির।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ২০১২ সালের ৮ আগস্ট পাসপোর্টটি গ্রহণ করেছিলেন আকবর ফকির।
এরপর এই পাসপোর্ট চলে যায় দালালদের কাছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের এই সুযোগটি রোহিঙ্গারা নিতে পারে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।