আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে...
মূলধারার লেখকরা ঈর্ষা করতে শুরু করেছেন বিকল্পধারার ব্লগ আর ব্লগারদের- এ খবর পুরনো। মূলধারার গণমাধ্যমের বিকল্প হিসেবে বাংলাব্লগ যে সগৌরবে স্বমহিমায় এগিয়ে যাচ্ছে, ইতিমধ্যে সেটা অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ। তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথার কারণ নেই। তবে বিস্ময়করভাবে মূলধারার গণমাধ্যমে কোনো বাংলাভাষী ব্লগের বিরুদ্ধে এই প্রথম নারী হয়রানির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হল। আমরা যারা ব্লগ নিয়ে বাইরে উচ্চকণ্ঠ থাকি, বৈঠকী আড্ডায় সগর্বে ব্লগের প্রসঙ্গ তুলে ধরি, ব্লগে নারী হয়রানির এই সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ঘটনায় তাদের মুখে চুনকালি পড়ার অবস্থা।
দৈনিক কালের কণ্ঠে সম্প্রতি 'প্রযুক্তি যেখানে নারীর যন্ত্রণা' শিরোনামের লেখায় প্রতিবেদক জয়ন্ত সাহা জানাচ্ছেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই যন্ত্রণার শিকার হচ্ছেন নারীরা। নারীদের জন্য ইভটিজিংয়ের মতো সমস্যা এখন হাজির হয়েছে প্রযুক্তি মাধ্যমেও। কথা অসত্য নয়। হয়রানির উদাহরণ টানতে গিয়ে তিনি ব্লগের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। সেটা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাও কিন্তু নয়।
তিনি সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করেছেন। সেটা এসেছে এভাবে-
ব্লগে যন্ত্রণা
বাংলাদেশে ব্লগিং ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন নারীরা। সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের আফরানা জানালেন, 'কিছুদিন আগে আমি আমার ব্লগে একটি লেখা পোস্ট করেছিলাম। সেই লেখার পর থেকে আসতে থাকল আজেবাজে মন্তব্য আর অশ্লীল গালিগালাজ।
' ব্লগের কোনো কোনো সদস্য ওঁৎ পেতেই থাকেন নারী সদস্যদের পোস্টে মন্তব্য করার জন্য। কিছু বাংলা ব্লগের কোনো নীতিমালা না থাকায় সদস্যরা ইচ্ছামতো মন্তব্য করতে পারেন। আর এর শিকার হচ্ছেন নারীরা। মূল প্রতিবেদন পড়ুন এখানে।
আমারব্লগের বিরুদ্ধে নারী হয়রানির অভিযোগ অবশ্য এটাই প্রথম নয়।
এর আগেও সুনির্দিষ্টভাবে অনেকেই এরকম অভিযোগ এনেছেন। অরণ্যে রোদন জেনেও শুভাকাঙ্খী হিসেবে অনেকেই আমারব্লগ কর্তৃপক্ষকে নানাভাবে সতর্কও করেছেন। কিন্তু তারা তাতে গা করেনি কখনোই। উল্টো আমরা অভিযোগ শুনি প্রায়ই, কর্তৃপক্ষীয় লোকজনই নানা নিকে বখাটেপনার প্রদর্শনী করছেন।
মূলধারার গণমাধ্যমে ব্লগের বিরুদ্ধে কুৎসা
১. আসিফ নজরুলের স্বল্পজ্ঞান : অনেকেই ইতিমধ্যে জানেন, দৈনিক সমকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কলামলেখক আসিফ নজরুল বাংলাব্লগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন।
সেখানে তিনি লিখেছেন-
বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় নতুন যুক্ত হয়েছে ব্লগ। বহু ব্লগ ওয়েবসাইটে এখন কলাম লেখকদের লেখা রাখা হয়। তার নিচে পাঠকদের মন্তব্য করার সুযোগ থাকে। এসব মন্তব্যের বিষয়ে জানা ছিল না আমার। একদিন একজন নিয়মিত পাঠক কিছু বল্গগের ঠিকানা দিয়ে পাঠান।
সেখানে গিয়ে দেখি ভয়াবহ সব ব্যাপার। প্রধান দৈনিকগুলোর কিছু ব্লগের লেখা শালীন, যুক্তিপূর্ণ এবং সুচিন্তিত। কিন্তু অন্য অনেক ব্লগ আক্ষরিক অর্থেই বিকৃত মানুষের আখড়া। সেখানে এত জঘন্য ও ঘৃণ্য মন্তব্য লেখা হয় যে, তা পড়লে বুকের রক্ত হিম হয়ে যাবে যে কোনো সুস্থ মানুষের। কোনোরকম সম্পাদনা ছাড়া এসব মন্তব্য ছাপানো হয় কেন তা বল্গগের মালিকগণই জানেন।
হয়তো তারা কলমের স্বাধীনতায় অতিমাত্রায় বিশ্বাসী, হয়তো তারা নিজেরা এসব পড়ে দেখেননি কোনোদিন, হয়তো এভাবেই পাঠকদের আগ্রহী করতে চান তারা।
ব্লগ নিয়ে আসিফ নজরুলের জ্ঞান কতোটুকু এ থেকে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। আমাদের সময় টাইপ পত্রিকা কিংবা সোনারবাংলাদেশ টাইপের ওয়েবসাইটের তলদেশে পাঠকের ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়াকে তিনি 'ব্লগ' ঠাউরেছেন। সেটা তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, আমরা বরং সেটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারি।
২. তাড়া খাওয়া গল্পকারের বিলাপ : সম্প্রতি প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গল্পের পুরোটা জুড়ে ব্লগের প্রসঙ্গ এসেছে এমনভাবে, যেন ব্লগ মানেই অন্যের লেখা চুরি করে মেরে দেওয়া।
গল্পটি পড়ে আমরা অনুমান করতে পারি, লেখক ব্লগে তশরিফ রেখেছিলেন কোনো এক সময়ে। বেয়াড়া ব্লগারদের তোপের মুখে উড়ে যেতেও হয়তো সময় লাগেনি তার। এরকম উদাহরণ ব্লগে অবশ্য নতুন কিছু নয়। ব্লগ আসলেই বিপজ্জনক একটা জায়গা। এখানে বর্ণানুক্রম নেই, জ্যেষ্ঠতা নেই।
সবাইকেই দাঁড়াতে হয় একসারিতে এসে - নতুন-পুরনো, খ্যাত-অখ্যাত সবাইকেই। ফলে এটা খুব স্বাভাবিক যে, পত্রিকার পাতায় দরজা-জানালা বন্ধ করে বিশিষ্ট হয়ে ওঠা লেখক ব্লগের মুক্ত জানালার কাছাকাছি এসে অস্বস্তি বোধ করবেন। আর সেই অস্বস্তি থেকে তৈরি হওয়া জ্বালা প্রশমনের জন্য মূলধারায় তিনি ব্লগকে এক হাত দেখে নিতেই পারেন।
এক বালতি দুধে এক ফোটা চুন
জানার সীমাবদ্ধতা ভেবে আমরা আসিফ নজরুলকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতে পারি, শওকত চৌধুরীর গল্পকে উপেক্ষা করতে পারি, কিন্তু কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন আমাদের চোখে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে- সামহোয়্যারইন কিংবা সচলায়তনের মতো ব্লগগুলোর তিলে তিলে গড়ে তোলা ভাবমূর্তি মাত্র একটি 'আমারব্লগ' কিংবা একটি 'যৌবনযাত্রা' সহজেই ধুয়েমুছে দিতে পারে। এক বালতি দুধে এক ফোটা চুনে যেমন হতে পারে।
কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনটি যারাই পড়বেন, তাদের কাছে মনে হবে ব্লগ যেন নিষিদ্ধ পল্লী, যেখানে মেয়েদের নিত্য যৌন হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়, নিত্য গালিগালাজের মুখে পড়তে হয়। সচেতন ও নিয়মিত ব্লগার ছাড়া কেইবা বুঝবে যে, সামহোয়্যারইনের সঙ্গে আমারব্লগের তফাৎ কতো দূর। সাধারণ মানুষকে কে বোঝাবে যে, ব্লগ মানে সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণের তলদেশে পাঠকের অপাঠ্য প্রতিক্রিয়া নয়, ব্লগ মানে কলিকাতায় নিত্য নারী হয়রানি নয়। কে বোঝাবে তাদের- ব্লগ হচ্ছে আলাদা কিছু, ভালো লেখক-পাঠকের অনলাইন সমাবেশও। এমনিতে ফেইসবুকেও এই ধরনের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।
সেটা মার্ক জুকারবার্গের মাথাব্যাথা। কিন্তু এখন অবস্থা হয়েছে এমন, মূলধারার কোথাও বাংলা ব্লগ প্রসঙ্গ দেখলে অজান্তেই ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুকটা। হবেই না বা কেন, আমাদেরই তো ব্লগ! ওয়েবদুনিয়ায় আমাদেরই তো একটুকরো বাংলাদেশ!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।