আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংবাপত্রে ট্রেড ইউনিয়ন: পুঁজিপতির মালিকানায় শ্রমজীবীর প্রতিকৃতি (পর্ব- ০১)



মার্কিন জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক মার্ক টোয়ান একদা বলেছিলেন, প্রতিদিন আমরা দুটো সূর্যোদয় দেখি। একটি প্রভাত সূর্য, অন্যটি এপি’র (এসোসিয়েটেড প্রেস) সূর্য বা সংবাদ সূর্য। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে প্রতিটি সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আগের দিনের সংঘটিত সমস্ত ঘটনাবলী সংবাদপত্রে সাজানো অবস্থায় পেয়ে থাকি। প্রতিটি সূর্যোদয় যেমন আরেকটি নতুন দিনের সূচনা করে, প্রতিদিনের সংবাদপত্রও বিভিন্ন সব নিত্য নতুন ও তাজা খবরের মাধ্যমে মানুষের জীবনে নতুনত্বের সূচনা করে। আবার সূর্য যেমন আলোর মাধ্যমে চারদিকের অন্ধকার দূর করে, তেমনি সংবাদপত্র তার লেখনীর মাধ্যমে সমাজের অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কারসহ যাবতীয় অন্ধকার দূর সমাজে আলোর রশ্মি ছড়ায়।

এই প্রক্রিয়ায় সংবাদপত্র তাই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। আধুনিক সমাজের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে মানুষ ঘটনা ও সংবাদের জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে। এসব ঘটনার ইতিবৃত্ত সংবাদপত্রের উপাদান। সংবাদপত্র পাঠকের গন্ডির মধ্যে সহজেই বিশ্বের ও সমাজের পরিবেশ পরিস্থিতির খবর নিয়ে আসছে। সেই সঙ্গে তা পরিণত হয়েছে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় সওদা হিসেবে।

একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আর দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো সংবাদপত্রের এ অগ্রযাত্রার বিকাশ ঘটেছে এবং আজকের এ অবস্থানে পৌঁছাছে। কিন্তু মার্ক টোয়ানের সংবাদ সূর্যে সমাজের শ্রমজীবি মানুষের কথা কি আসে? তারা একজন গার্মেন্টস্ কর্মী বা মিল শ্রমিকের জীবন দুর্দশার কথা তেমনভাবে লিখে না, যেমনভাবে একজন চিত্রতারকা বা খেলোয়ারের সামান্য বিষয় নিয়ে লিখে। বরং তারা যখন অগ্নিদগ্ধ হয় বা আদমজীর মতো চাকুরী হারায়, তখন তাদের কথা দায়সারাভাবে সংবাদপত্রে আসে। কিন্তু এরপর তাদের পরিবারের কী অবস্থা বা তারা কীভাবে দিনানিপাত করছে, সে সম্পর্কে কোনো অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট সংবাদপত্রে আসে না। এছাড়া গার্মেন্টস মালিকদের অস্বস্তিতে ফেলার মতো কোনো রিপোর্ট তারা করে না।

বরং উল্টোদিকে, গার্মেন্টস সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর জন্য সরকারি বিভিন্ন রকম ছাড়ের জন্য তারা সবসময় রিপোর্ট করে। আবার ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ যখন অধিকার আদায়ে বা ন্যায্য মজুরীর জন্য আন্দোলন করে, তখন তা সঠিকভাবে সংবাদপত্রে আসে না। বরং অনেক সময় শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূর্দশার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক আন্দোলনকে দায়ী করা হয়। প্রকৃতপে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সংবাদপত্রগুলো মালিকপকে সমর্থন জানায়, যেখানে শ্রমজীবি মানুষের কথা বা আন্দোলন তেমনভাবে আসে না। আবার শ্রমজীবি মানুষ গণমাধ্যম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে তাদের সম্পর্কে যে গঁৎবাধাঁ ধারণা মিডিয়া দেয় তার কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না।

আলোচ্য গবেষণায় দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিশেষ করে সংবাদপত্র ট্রেড ইউনিয়ন বিষয়ক সংবাদ কীভাবে উপস্থাপন করে অর্থাৎ এর ট্রিটমেন্ট। যার মাধ্যমে আমরা দেখতে পারি শ্রমজীবি মানুষ ইস্যুটা গণমাধ্যমের কাছে কতোটা গুরুত্ব পাচ্ছে। গবেষণার উদ্দেশ্য নিম্মলিখিত উদ্দেশ্যসমূহকে সামনে রেখে আলোচ্য গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে- (১) সংবাদপত্র ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক রাজনীতি বিষয়ক সংবাদ কীভাবে প্রকাশ করে? (২) সংবাদপত্রে ট্রেড ইউনিয়ন বিষয়ক সংবাদগুলো ইতিবাচক না নেতিবাচক তার মূল্যায়ন করা। (৩) প্রাপ্ত তথ্যের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা ক্রসচেক করে কিনা তা দেখা। (৪) ট্রেড ইউনিয়ন বিষয়ে কোনো অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন সংবাদপত্রে আসে কিনা? (৫) সংবাাদপত্র ও ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যকার সম্পর্ক কীভাবে ভাল করা যায় তার নির্দেশনা দেয়া।

গবেষণার অনুকল্প নিন্মোক্ত অনুকল্পের ভিত্তিতে আলোচ্য গবেষণাটি সম্পাদিত হয়েছে। (১) সাংবাদিকরা শ্রমিক রাজনীতি বিষয়ক সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে প্রায়শ শ্রমিক নেতাদের সাক্ষাৎকার বা মন্তব্য নেয় না। (২) সংবাদপত্র শ্রমিক রাজনীতি বা ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে কোনো অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন করে না। (৩) ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে সাংবাদিকরা গঁৎবাঁধা ধারণা উপস্থাপন করে। (৪) শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে কোন নেতিবাচক প্রতিবেদন পরিবেশন করলে তারা এর কোনো প্রতিবাদ করে না।

গবেষণা পদ্ধতি বাংলাদেশের সংবাদপত্রে ট্রেড ইউনিয়ন তথা শ্রমিক আন্দোলনকে কীভাবে উপস্থাপন করা হয় তা অনুসন্ধানের ল্েয আলোচ্য গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। প্রকৃতিগত দিক থেকে একে Triangulation Research বলা যায়-- যেখানে গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় ধরনের বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এখানে গুণগত বিশ্লেষণের দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কলাম ইঞ্চির পরিবর্তে কী ধরনের শিরোনাম, টেক্স্রস, শব্দ এবং ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়েছে তার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। (১) আধেয় বিশ্লেষণ: এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিল্স) সংরতি পেপার কিপিংস থেকে ১ জানুয়ারি ২০০৪ থেকে ৩০ মে ২০০৪ পর্যন্ত পাঁচ মাসের ১৫টি পত্রিকার আধেয় বিশ্লেষণ করি।

এক্ষেত্রে চারটি বিষয়ের ভিত্তিতে সংবাদ বাছাই করা হয়। বিষয় চারটা হলো- (১) বাংলাদেশের সার্বিক ট্রেড ইউনিয়নের অবস্থা, (২) ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন, (৩) গার্মেন্টস্ সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়ন এবং (৪) ব্যাংকিং সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়ন। (২) সাাৎকার: সংবাদপত্রে ট্রেড ইউনিয়ন বিষয়ক সংবাদ উপস্থাপন নিয়ে কয়েকজন সাংবাদিক ও শ্রমিক নেতার সাাৎকার গ্রহণ করা হয়। এর মাধ্যমে জানতে চেষ্টা করা হয়েছে সংবাদপত্র ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে কী রকম সংবাদ দিচ্ছে, আবার শ্রমিকরা এসব সংবাদকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে এবং এর কোনো প্রতিবাদ করছে কিনা? শ্রমিক নেতাদের হলেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান, জাতীয়তাবাদী পাট শ্রমিক দলের মহাসচিব মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান শহীদুল্লাহ চৌধুরী এবং সাংবাদিকদের মধ্যে যারা অর্থনীতি বা বাণিজ্য পাতা দেখেন তাদের মধ্যে থেকে দি ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার শামীম এ জাহিদী আর দৈনিক নয়া দিগন্তের সিনিয়র রিপোর্টার সৈয়দ শামসুজ্জামান নিপু। (ক) সমগ্রক ও নমুনায়ন অত্র গবেষনার সমগ্রক হচ্ছে বাংলাদেশের সবগুলো জাতীয় দৈনিক।

এই সমগ্রক থেকে এমনভাবে নমুনা বাছাই করা হয়েছে যাতে তা সমগ্রকের প্রতিনিধিত্ব করে। গবেষণার জন্য গবেষক নমুনা হিসেবে ১৫টি সংবাদপত্র নেয়া হয়েছে। এ এগুলোর মধ্যে ৯টি বাংলা ও ৬টি ইংরেজি সংবাদপত্র। কারণ বিল্স পাঠাগারে এই ১৫টি পেপারের কিপিংস সংগ্রহ করা আছে। সংবাদপত্রগুলো হলো--- ইত্তেফাক, প্রথম আলো, যুগান্তর, জনকন্ঠ, আজকের কাগজ, সংবাদ, দিনকাল, ইনকিলাব, ভোরের কাগজ, New Age, The Bangladesh Observer, The Financial Express, News Today, The Independent এবং The Daily Star (খ) উপাত্ত সংগ্রহ পদ্ধতি প্রথমে বিলসে সংরতি পেপার কিপিংস থেকে বিগত পাঁচ মাসের ১৫টি পত্রিকার সংবাদগুলোকে বাংলাদেশের সার্বিক ট্রেড ইউনিয়নের অবস্থা, ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন, গার্মেন্টস্ সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়ন এবং ব্যাংকিং সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়ন এ চারটি বিষয়ের ভিত্তিতে সংবাদ বাছাই করি।

তারপর এই সংবাদগুলোকে বিভিন্ন রকমের বিশ্লেষণ করি। যেমন: কোন পত্রিকার সংবাদ বা কলাম, সংবাদের উৎস কি, সংবাদ ইতিবাচক বা নেতিবাচক কিনা, অভিযুক্তদের বক্তব্য নেয়া হয়েছিল কিনা, মন্তব্য ইত্যাদি। শেষে দুইজন সাংবাদিক ও তিনজন শ্রমিক নেতার সাাৎকার নেয়া হয় বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়নের সার্বিক অবস্থা ও সংবাদপত্রে এর উপস্থাপনা নিয়ে। (গ) নমুনার সময়কাল নমুনার সময় বেছে নেয়া হয়েছে ২০০৪ সালের জানুয়ারি ১ থেকে মে ৩১ তারিখ পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ মাস। (চলমান...) (আলোচ্য লেখাটি রোবায়েত ফেরদৌস ও মুহাম্মদ আনোয়ারুস সালাম সম্পাদিত গণমাধ্যম বিষয়ক বই "গণমাধ্যম/শ্রেণিমাধ্যম", শ্রাবণ প্রকাশণী, ২০০৯ প্রকাশিত হয়েছে।

যদি কেহ এই লেখা থেকে রেফারেন্স দিতে চান, তাহলে তাদের উক্ত বইয়ের রেফারেন্স দেয়ার জন্য অনুরোধ রহিল) (কৃতঞ্জতা প্রকাশ: আলোচ্য লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে চতুর্থ বর্ষ এর ইন্টার্শীপ প্রোগামের আওতায় "বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বিলস" এ ইন্টানি করার সময় সম্পাদন করা হয়। )

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।