আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

[ [ [[[ নীল পূর্ণিমা ]]] ] ]

পাঠশালার ছাত্র এখনো

[আমার নীল পরীকে] সময়টা শেষ বিকেল। সোনাগলা রোদ চুঁইয়ে নামছে দিগন্তের মেঝেতে। সেই অপূর্ব সোনায় সোনারূপে সেজেছে আকাশ-মেঘ-সাগর। ডানায় সোনালী আভা মেখে ঘরে ফেরা গাংচিলের দল ঘাড় নামিয়ে উঁকি মেরে দেখে নিল একবার রাজা’কে। রাজা।

রাখাল ছেলে রাজা। বাংলাদেশের দক্ষিণে অখ্যাত এক সাগর পারে তার রাজত্ব। যেখানে এখনো পৌঁছেনি বিজলীর আলো। কংক্রিটের ছোঁয়া লাগেনি এখনো সোঁদাগন্ধ মাটিতে। যে মাটিতে আঁচড় কাটতে পারেনি শহুরে সভ্যতার ধারালো নখর।

মাটি জুড়ে তাই মা মা গন্ধটা এখনো আকুল করে তাই। গাংচিলের দলকে হাত নেড়ে ভালোবাসা জানিয়ে দিল সে। বেলাভূমি ধরে হেঁটে হেঁটে এক সময় সমুদ্রের কিনারা ছোঁয় তার পা। উদোম শরীরে বিলি কেটে যায় বাতাস, আর গলে গলে ডুবন্ত সূর্য রচে শরীর জুড়ে সোনার ভাস্কর্য। পা’য়ের পাতায় আলতো চুমু খেয়ে স্বাগত জানাল সাগরের লোনা জল।

শিরশিরে দারুন এক অনুভূতি। সেই অপূর্ব অনুভূতি নিয়ে নামতে থাকে রাজা আরো গভীরে। সমুদ্রের ঠোঁট উঠতে থাকে- তার পা বেয়ে বেয়ে ওপরে। কোমর সমান জলে নেমে আরো অদ্ভূত অনুভূতি জাগে। শরীরের ওপরের অর্ধেকে বাতাসের মাতামাতি খেলা, নিচের অর্ধেকে জলের শীতল সুখ-সঙ্গম।

চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল রাজা। ডুবে যাচ্ছে...হারিয়ে যাচ্ছে....যাচ্ছে ভেসে। আর ওকে ঘিরে ভাসছে তরল সোনা, বায়বীয় সোনা –সোনা আর সোনা। দু’হাত দু’দিকে মেলে দেয় রাজা.... চোখ বন্ধ। বুক ভরে নিশ্বাস নেয়.... চোখ বন্ধ।

ডুব দেয়..... ডুবুক...ডুব.....ডুব........ নিশ্চুপ নিঝুম..ঝুম সেই পাতালপুরীর দেশে। খেলা হয় নাম না জানা সব রঙ্গীন মাছেদের সাথে। গান হয়, হয় জলজ ঘুর্ণী নৃত্য। রাজার ভেট হিসেবে কোঁচড় ভরে নেয় সে ঝিনুক-শামুকে। নারকোল গাছের ছায়ায় তখন অন্ধকার জেঁকে বসেছে।

উদোম ভেজা চকচকে শরীরে বালুভূমিতে বসে রাজা একটানা হাঁপায়। বিষাদমাখা এক অবসাদ -পৃথিবী জুড়ে। তবুও কিসের এক অপার্থিব সুখ ওকে ঘিরে রাখে কালচে সন্ধ্যার এই ক্ষণে। কোঁচড় খুলে একে একে বার করল সব ঝিনুক-শামুকের রাশ। মুখ খুলে খুলে ঝিনুকের ভেতরগুলো দেখে নেয় উঁকি মেরে।

টিকটিকির ডিমের মতো একটা গোলাপী মুক্তো পাওয়া গেল অবশেষে শেষ ঝিনুকটার পেট থেকে। বেছে বেছে তিনটা সাদা শামুক তুলে নেয় রাজা। মুক্তোটাতে ঠোঁট ছোঁয়ায়। শব্দ করে চুমু খায়। তারপর ছুঁড়ে দেয় ওটা শরীরের সবটুকু শক্তি নিক্ষেপ করে- সমুদ্রের বুকে।

শামুক তিনটা আবার কোঁচড়ে গুঁজে নারকোল গাছের দিকে রওনা হয়; লুঙ্গি আর বাঁশিটার খোঁজে। এই নিয়ে মোট সতেরোটা মুক্তো ছুঁড়েছে সে সাগরে। সাগর থেকে তুলে আবার সাগরেই ছোঁড়া। কেন ? কোন উত্তর আছে কি রাজা’র কাছে ? ********************* হোগল পাতায় ছাওয়া টং-ঘরের পলকা দরজাটা এক টুকরো গাছের ডাল দিয়ে আটকানো থাকে। বড্ডো হাওয়া বইছে আজ।

গরু-বাছুর’গুলোর খৈল-ভুষি দিয়ে এসেছে সেই কখন। চেয়ারম্যান বাড়িতে আজ লোকে থই থই। চেয়ারম্যানের নাতনি হয়েছে আজ দিন সাতেক হল। নাতির জন্য আকুপাকু ছিল তার। মনটা তাই একটু খারাপ চেয়ারম্যানের।

যদিও কাজের বেলা তার কোন প্রভাব পড়েনি। আজ বাদ জোহর আস্ত তিনটা গরু শোয়ানো হয়েছে দক্ষিণকান্দার ইশকুল মাঠে। এখন মাইকে রূপবান নাচছে কোমর ঢুলাইয়া। আরেকটু পর খানাপিনা শেষে শুরু হবে আরেক ভেল্কি। - উত্তরকান্দার লতিফ মাতবর, হাজার টাকা।

মা-র-হা-বা। জৈন্ত হাটের নজু বেপারি, দুই শ টাকা। মা-আ-শা-ল্লা। তেলেসমাতি ঢঙে চাঁদাবাজী চলবে রাতভর। আবার গান।

আবার মারহাবা। এদিক ওদিক আগানে বাগানে তাস-ভ্যোমশংকর। হল্লা...ধোঁয়া আর ধোঁয়ার গন্ধে মৌ মৌ গ্রাম। গ্রামের হাওয়া। এসব রাজার ভাললাগে না।

বাছুরগুলোকে বেঁধেই তাই আর দেরি করেনি। চেয়ারম্যান বাড়ির ভিড় ঠেলে পালিয়ে এসেছে। পলকা দরজা ঠেলে টং-ঘরের ভেতরে ঢোকে রাজা। হোগলপাতার বেড়ার ফাঁক গলে চাঁদের আলো ফালি ফালি হয়ে ঢুকছে ওর ঘরে। একগাঁদা খড় দিয়ে বানানো নরম বিছানা সারাদিনের ক্লান্তি ঢেকে দিতে হাতছানি দিয়ে ডাকছে....আয়.....আয়।

আরে.... ওটা কি? ধিরে ধিরে সামনে এগিয়ে দেখতে পেল রাজা- ধপধপে সাদা একটা পালক পড়ে আছে ওর পালঙ্কের উপর। বিস্ময় বাধ মানছে না রাজা’র। টং-ঘরটা হোগল পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি হলেও একটা টুনটুনি ঢোকার মতো কোন ফাঁকও কোথাও নেই। পালকটা কিভাবে এসে ওর বিছানায় শুয়ে পড়লো...ভেবেই কুল পাচ্ছে না ও। ঘরের চারপাশটা ভালো করে দেখলো আরেকবার।

নাহ্... কোন সুরাহাই হল না। হঠাৎ করেই রাজা’র চোখমুখ জুড়ে খেলা করে গেল এক বিচিত্র হাসি। কিছুদিন হল রোজ রাতে মা’কে স্বপ্নে দেখছে রাজা। মায়ের কপালের সাদা পালকগুলোও তো ঠিক এটার মতোই। ঠিক।

আলতো করে পালকটা বুকে ঠেকায় রাজা। চোখ বন্ধ করে আবেশে। মায়ের গন্ধ খোঁজে অবচেতনে... ঘুমিয়ে পড়ে ওভাবেই। ****************** সোনালী ফিনফিনে ডানার মাছটাকে চোখের সামনে দিয়ে সরিয়ে দিতেই... আরে.... ওটা আবার কি ? নীল রঙের বড়সর একটা অদ্ভূত আকৃতির ঝিনুক চোখে পড়ে রাজা’র। ঝিনুকটা একেবারে ডিমের মত।

কেমন লম্বাটে গোল। কি এক অমোঘ আকর্ষনে চুম্বকের মত টেনে নিয়ে যায় ঝিনুকটা ওকে। আজ আর অন্যকিছু কুড়োবার তালে গেল না তাই। দু’হাতে ওটাকে চেপে সোজা ওপরমুখী সাঁতার। ভুস্ করে ভেসে ওঠে একটু পর।

কি এক অজানা উত্তেজনা পেয়ে বসে রাজাকে। জোর সাঁতার লাগায়। অস্থির মুখে ঢুকে পড়ে লোনা জল। খক্ খক্ কাশি। কিন্তু কোনদিকে কোন হুঁশ নেই।

সাঁতরে চলে রাজা একই গতিতে। কি যেন একটা ঘটবে আজ। যা’র অপেক্ষায়ই হয়তো এতদিনের এই সূর্যডোবা ডুব সাঁতার। আঙুল কেঁপে যাচ্ছে। বুক ঢিপ ঢিপ করছে।

আস্তে আস্তে মুখ খোলে রাজা নীল ঝিনুকের। শরীর-মন জুড়িয়ে দিল অসম্ভব ঘন নীল এক টুকরো ছোট্ট মুক্তো। শুয়ে আছে ঝিনুকের শক্ত খোলের মধ্যে নরম অনুভবে। অভিভাবক শরীর থেকে মুক্তোটাকে ছাঁড়াতে হাতটাকে আজ বড্ডো বেশি আঢ়ষ্ট মনে হচ্ছে। অবশেষে ভেতরের অদম্য লোভটা ছাড়িয়ে নেয় ওটাকে ঝিনুকের খোল থেকে।

কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে চুমু খায় রাজা নীল রত্নে। আজ বুঝতে পারে, ওর এতদিনের মুক্তো ছুঁড়ে ফেলার প্রতিদান কি। এতগুলো রত্ন ছুঁড়েই তো জয় করল এই নীল মুক্তো। নিজ দায়িত্বে আজ কোঁচড়ে বন্দী করলো পৃথিবীর সবচেয়ে দামী রত্নটাকে। ********************* অনেক রাত অবধি জেগে একটা মুকুট তৈরি করল রাজা।

মুকুটের উপাদান হিসেবে- মায়ের ছেঁড়া আঁচল পাকানো, চারটে সাদা শঙ্খ, মাঝখানে সাদা পালক, আর তার মাঝখানে বসে নীল রূপসী মুক্তোটা। মুকুটটা মাথায় দিতেই রাজ্যির ঘুম নেমে এল রাখাল বালকের ক্লান্ত দু’চোখে। চারিদিক সুনসান। মাঝে মাঝে দামাল হাওয়ার ছোটাছুটি। রাত্রি দ্বি-প্রহর।

বেড়ার ফাঁক গলে ফালি জোছনার একটা টুকরো মুক্তোটাকে উদ্ভাসিত করলো। আর সাথে সাথে মুক্তোটার ভেতর থেকে মিহি নীল রঙের ধোঁয়া বার হতে শুরু করল। ঘরের মধ্যে নীল আলোয় ভরে গেল। ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে খেতে ধিরে ধিরে এক অপরূপা নীল পরীর অবয়ব পেল ধোঁয়াটুকু। বরফ রঙা নীলচে তার বসন।

চোখে তার হাজার তারার ঝিলিক। নিশ্বাসে তার চাঁদের স্নিগ্ধ ঘ্রাণ। ধিরে ধিরে ঠোঁট নামালো পরী রাজার তামাটে কপালে.... চোখ বন্ধ করে। আর তখনি চোখ খোলে রাজা। .......... .............................................. . . . পৃথিবী জুড়ে তখন নীলাম্বরী সাজ।

নীল সাগরের ঢেউয়েরা মেতেছে নীল আকাশে রূপ থই থই নীল জোছনার সাথে নীল কাব্য রচনায়। আজ যে নীল পূর্ণিমা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।