আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১০ ই মার্চের গণহত্যা

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

লেখাটি গতকাল দেয়ার ইচ্ছে ছিলো, পারিনি। তাতে কি? এই কাহিনী যে কোন দিন শোনানো যায়। *********************************************************** ছবিটিই হয়তো সব কথা বলে। তাও বলি। টোকিওর কিনশিচো স্টেশন থেকে কয়েকশো মিটার দূরে সরু নদীর ওপরে একটি ব্রীজ, ব্রীজের নাম মনে পড়ছেনা, অবশ্য নাম জানাটা জরূরীও না।

প্রায়ই এই ব্রীজের ওপর দিয়ে আসা যাওয়া করেন কিনশিচো এলাকার অধিবাসী এক বৃদ্ধা, ৮৫ বছর বয়েস। তবে অদ্ভুত এক কারণে যখনই তিনি ব্রীজের ওপর ওঠেন, চোখ বন্ধ করে ফেলেন; ব্রীজ থেকে যখন আবার সাধারণ রাস্তার ফুটপাথে নেমে আসেন, শুধু তখনই আবার চোখ খুলে হাঁটা ধরেন। কিছুতেই ঐ ব্রীজের ওপরে চোখ খোলা রেখে হাঁটতে পারেননা বৃদ্ধা। কেন? কারণ অবশ্য আছে, রীতিমতো ভয়াবহ কারণ। ৬৫ বছর আগে ওই ব্রিজটির ওপর দাঁড়িয়ে তিনি শুধু মানব ইতিহাসের নৃসংশতম ও ভয়াবহতম গণহত্যাটিরই সাক্ষী হননি, একই সাথে দেখেছেন জ্বলন্ত আগুনে পুড়তে পুড়তে কুঁকড়ে-পুঁকড়ে কুন্ডলী পাকিয়ে নিজ পিতা-মাতার মরে যাবার দৃশ্য।

মাত্র কয়েক মাস বয়েসী সন্তানটিকে কোলে করে ব্রীজ থেকে লাফ দিয়ে নিচের আরাকাওয়া নদীতে পড়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন সেদিন তিনি আর তাঁর সন্তান। তবে তাঁর বৃদ্ধ পিতা-মাতা ব্রীজ থেকে লাফ দেয়ার সাহস পাননি বলে, নাকি ঠিক সে সময়ের বাঁচার একমাত্র আশ্রয় হয়ে ওঠা সেই আরাকাওয়া নদীতে অন্য যাদের লাফিয়ে পড়ার পরও বাঁচার সম্ভাবনা বেশী তাদেরকে জায়গা করে দেয়ার জন্য আগুনেপোড়া মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন -- তা জানা যায়নি, আজ ৬৫ বছর পর টিভি নিউজের লোকদের সে নিয়ে কিছু বলেননি তিনি। কি হয়েছিলো সেদিন? উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত আরাকাওয়া নদী আর কিছুদূর পশ্চিমে তার সমান্তরালে বহমান সুমিদা নদীর আশপাশের এবং এই দুই নদীর মধ্যবর্তী জনবহুল এলাকাটি বেশ জনবহুল ছিলো। টোকিও শহরের ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে এ এলাকাটি দখল করে রেখেছে ৩ টি ওয়ার্ড। প্রায় ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা।

১৯৪৫ সালের মার্চের ১০ তারিখ, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বললে, মার্চের নয় তারিখ পেরিয়ে সবে রাত বারোটা বেজেছে। এর ঘন্টা দুয়েক আগে লোকজন ফাইটার প্লেনের ওড়ার শব্দ শুনেছে, অন্যান্য আর দশটি দিনের মতোই। তবে ১০ ই মার্চের সেই রাতটি ছিলো ভিন্ন; ঘন্টা দুয়েক আগে শোনা যুদ্ধবিমানের গর্জন আর ফিরে না আসায় লোকজন যখন স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলতে যাবে, তখনই হঠাৎ রাত ১২টা পেরিয়ে কয়েক মিনিট যেতেই এলাকার লোকজন দেখতে পেলো আকাশ থেকে নেমে আসছে বিশাল বিশাল আকৃতির সব জ্বলন্ত আগুনের দানব। একটা-দুটো না, পাঁচটা-দশটা না, এমনকি হাজার-হাজারও না! সংখ্যাটা ছিলো লাখে লাখ!! মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দশ লাখ আগুনের গোলা নিক্ষিপ্ত হয় টোকিওর সেই অংশে, পুড়িয়ে কয়লা করে ফেলে ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। অভিযানে অংশ নেয় তিনশো' চুয়াল্লিশটি বি-২৯ যুদ্ধবিমান, একযোগে।

রাত ১২টা ৮ মিনিট থেকে শুরু করে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে এই তিন শতাধিক বি-২৯ ছারখার করে ফেলে আরাকাওয়া-সুমিদা অববাহিকা। গড়ে একেকটি প্লেন থেকে ৭০-৮০ টি বোমা ফেলা হয়, এলোপাথাড়ি। পুড়িয়ে দেয়া হয় ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। একেকটি সিলিন্ডার দখল করেছে ৩০ বর্গমিটার এলাকা। ৩০ বর্গমিটার, ৫ মিটার বাই ৬ মিটার।

১৫ ফুট বাই ১৮ ফুট, মোটামুটি আকারের একটা ড্রয়িংরুমের সমান। কল্পনা করা সম্ভব কিনা জানিনা, সে রাতে গড়ে এরকম প্রতিটি ড্রয়িংরূম সমান এলাকায় পড়েছে একটি করে সিলিন্ডার বার্নার, কেরোসিনে ঠাসা অমন বার্নার সত্যি বলতে একটা পুরো বাড়ি পুড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে! বিশেষ করে যখন বাড়িটি তৈরী হয় কাঠ আর কাগজ দিয়ে। দুই ফুটের বেশি উচ্চতা আর চার/পাঁচ ইঞ্চি ব্যসের সিলিন্ডার আকৃতির অনেকগুলো বার্নারের সমন্বয়ে তৈরী হয়েছিলো বিশেষ ফায়ার বম্ব বা আগুন-বোমা। বি-২৯ এ বহন করে মাটির খুব কাছাকাছি পর্যন্ত নেমে এসে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো ওগুলো, যাতে মেঘ কোন ঝামেলা না করে এই মানুষ হত্যার উৎসবে। মূলতঃ জাপানী "কাগজ আর কাঠের তৈরী ঘরবাড়ী"কে উদ্দেশ্য করেই আমেরিকান সেনাবাহিনীর গবেষণায় উদ্ভাবিত হয় ঐ বিশেষ আগুনের গোলা; এর পরীক্ষা চালানো হয়েছিলো বিশাল আমেরিকার কোন এক মরূভূমিতে, জাপানী আদলের ঘরবাড়ী বানিয়ে, সেগুলোর উপর বোমা ফেলে ফেলে।

সে যুগে জাপানী বাড়ী-ঘরের উপাদানের মধ্যে কাঠ আর কাগজের প্রাধান্য ছিলো বেশী। এদের পোড়ানো সহজ, কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিলেই হয়। সেভাবেই ডিজাইন করা হয়েছিলো বিশেষ ধরনের এই আগুন বোমার সিলিন্ডার বার্নার; তাতে ভরে দেয়া হয়েছিলো জেলের মতো অবস্থায় আধাশক্ত ধরনের কেরোসিন। মধ্য আকাশে একেকটি বোমা ফাটে, সেখান থেকে বের হয়ে আসে ৪০ টি করে সিলিন্ডার বার্নার, প্রচন্ড তাপে আগুন ধরে যায় যেটা সান্দ্র কেরোসিনকে তরল করতে থাকে, কেরোসিন তরল হতে হতে বার্নারশুদ্ধ সেটা এসে পড়ে মাটিতে; দাউ দাউ আগুন জ্বলে ওঠে, আগুনের হোলিউৎসব চলে! কিভাবে মানুষ মারা হয়েছিলো সেদিন? প্রথমে বোমা ফেলে আগুন লাগানো হয় দুই নদী আরাকাওয়া আর সুমিদার তীর বরাবর। আগুন-বোমার ভয়ে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষ যাতে নদী পেরিয়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় না নিতে পারে সেজন্য এভাবে তাদের পালানোর পথ বন্ধ করে দেয়া হয়।

দু'নদীর মাঝখানে যখন আটকে যায় লাখ লাখ মানুষ, তখন তাদের ঘরবাড়ীর ওপর শুরু হয় অনল-বৃষ্টি, আক্ষরিক অর্থেই। দশ লাখ সিলিন্ডারকে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফাটিয়ে আগুন ধরাতে হলে বৃষ্টির মতো করে ঝরানো ছাড়া আর কিই বা করা থাকে পাইলটের? হ কেরোসিন সহ দশলাখ বার্নার সেদিন এসে পড়ে আরাকাওয়া-সুমিদা অববাহিকার মানুষগুলোর কাগজ-কাঠের ঘরবাড়ীগুলোতে। কিচ্ছু থাকেনি! সব পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। তারাই বাঁচতে পেরেছে যারা নদীতে ঝাঁপ দিতে পেরেছে, বাকীরা মরে কয়লা। পুড়ে মরে কয়লা হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে মাত্র ২০ হাজারের লাশ পরে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

বাকী ৮৮ হাজার মানুষ হারিয়ে গেছে চিরতরে, ছাই হয়ে; অথবা পোড়া কাঠ, গলিত লোহার আসবাব, দগদগে মাটি আর অন্যান্য গলন্ত সব জিনিসের সাথে গলে-পুড়ে একাকার হয়ে গেছে ৮৮ হাজার মানুষের দেহ। সাধারণ মানুষ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা -- কেউ বাদ থাকেনি। মাত্র কয়েক মিনিটে এক লাখ মানুষ পুড়ে মরে গেছে টোকিও শহরে, বেশীদিন না, মাত্র ৬৫ বছর আগে। ৬৫ বছর আগের সেই রাতে যখন মায়ের কাছ থেকে আগুন থেকে বাঁচার টুপি পরে নিজ সন্তানকে বুকে জড়িয়ে লাফ দিতে যাচ্ছিলেন কিনশিচোর অধিবাসী ঐ বৃদ্ধা, তখন তিনি দেখতে পান দাউদাউ করে আগুন লেগে যাওয়া চুলের হাত থেকে বাঁচতে কিভাবে আছড়ে-পিছড়ে ব্রিজের ওপর মারা যাচ্ছেন তাঁরই আপন মা। কিভাবে ওখানে তিনি চোখ খুলে হাঁটেন? কি ভেসে ওঠে তাঁর চোখে? এরকম ঘটনা এই একবারই ঘটেনি টোকিওতে বা জাপানে, বারবার ঘটেছে ১৯৪৫ সালে, যুদ্ধের নামে।

নানান হিসেবের সূত্রে, ৫ থেকে ১০ লাখ সাধারণ মানুষ মারা গেছে শুধু আগুনে পুড়ে। কি দোষ ছিলো আরাকাওয়া-সুমিদা তীরের লোকদের? এই অঞ্চলেই ছিলো জাপানীজ সেনাবাহিনীর অস্ত্র তৈরীর কারখানা। সেই কারখানার কাছাকাছি থাকার শাস্তি হিসেবে তাদের পুড়িয়ে মারা যেতেই পারে -- এমন মনোভাব এখনও এপৃথিবীতে অনেক নরপশুর আছে। তারপর? সংক্ষিপ্ততম সময়ে বর্বরতম ইতিহাসের এই গণহত্যার হোতার নাম কার্টিস লুমেই, আমেরিকার বিমান বাহিনীর জেনারেল। মাত্র কয়েকমিনিটে লক্ষাধিক মানুষ পুড়িয়ে মারার পর এই নরপশু বলেছিলো তাদের হাতে সংঘটিত সেই গণহত্যা যৌক্তিক।

তার যুক্তি ছিলো আরাকাওয়া-সুমিদা পাড়ের প্রতিটি সাধারণ মানুষের বাড়িই জাপানী সেনাবাহিনীর অস্ত্র তৈরীর কারখানা হিসেবে কাজ করেছিলো! এই গণহত্যা নিয়ে ঠাট্টা-মস্করাও করে গেছে এই নরপিশাচ লুমেই, কোন এক সাক্ষাৎকারে সে হাসতে হাসতে বলেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের বাহিনী হারলে হিটলারের স্থানটা হতো তার। আশ্চর্যের ঘটনা ঘটে ১৯৬৩ সালে; মেরুদন্ডহীন জাপান সরকার জাপানী বিমানবাহিনীতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য গণহত্যার হোতা কার্টিস লুমেইকে বিশেষ পুরস্কারে ভুষিত করে। পরিশেষে: ৮৫ বছরের বৃদ্ধা এখন কাগজের তৈরী বক নিয়ে ঘুরে বেড়ান, তরুণ প্রজন্মের যারা তার গল্প শুনে উৎসাহ বোধ করে, তাদেরকে একটি করে কাগজের বক উপহার দেন। কাগজের বকেরও দুটো পাখা থাকে, তারা উড়তে পারে, তারা মুক্ত। সেদিনের সেই অভিশপ্ত মুহূর্তে বাঁচতে চাওয়া মানুষগুলো এরকম মুক্ত ছিলোনা, তাদের হাত পা ছিলো বাঁধা।

বৃদ্ধার বকেরা হয়তো তরুণ প্রজন্মকে সে কথাটি না ভুলে যাবার অনুরোধ করে যায়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।