সত্যানুসন্ধিৎসু
২৯ মার্চ, ১৯৭১-এর সন্ধ্যা। নুতন রূপপুরের তিনটি বাড়ি ঢাকা পড়েছে মানুষের উত্তাল স্রোতে। বুক ফাটা আর্তনাদ আর কান্নার তরঙ্গে নীল হয়ে উঠেছে নুতন রূপপুর গ্রামের আকাশ-বাতাস। সেই আবহের পরতে পরতে যেন বেদনার নীল অশ্রু। সকালের সদ্য প্রস্ফুটিত পুস্পদল আর নবকিশলয় ম্রিয়মান হয়ে নুয়ে পড়েছে সেই বেদনার খরতাপে।
ভুলুন্ঠিত হয়ে তীব্র আর্তনাদে বক্ষ-পিঞ্জরে করাঘাতের পর করাঘাত করে চলেছে এ গ্রামের আব্দুর রশিদ সরদার আর তার স্ত্রী হাজেরা খাতুন। উঠানের এককোণে পড়ে আছে তাদের জ্যোষ্ঠ সন্তান বুলেটবিদ্ধ নিস্প্রাণ হাবিবুর রহমান রাজু। আটভাই দু'বোনের চোখের মনি, পিতার অবর্তমানে তাদের প্রথম ভরশাস্থল, স্নিগ্ধ তরুছায়া। সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর পর সেদিন অপরাহ্নে বৃক্ষছায়ায় বসে কান্নাভেজা কন্ঠে বর্ণনা দিচ্ছিলেন মাধপুরের যুদ্ধে শহীদ রাজুর ছোটভাই মিল্কি। রাজুর কথা এলাকার সবাই জানেন, তবু স্বীয় পরিবারের ভেতর থেকে সরাসরি আসা কথা, এটা সম্পুর্ণ আলাদা ব্যাপার।
অবরুদ্ধ কন্ঠ পরিস্কার করার জন্য একটু থামলো ও। অশ্রুর প্রবাহে ঝাপসা হয়ে উঠেছে দুচোখের দৃষ্টি। শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে আছে মিল্কি অপলকে। প্রায় তিন যুগ আগের বেদনাবিধুর স্মৃতি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তার সমগ্র দেহ-মন। সে আবেশ লেগে আছে সমগ্র মুখাবয়বে।
আমি একদুষ্টে চেয়ে আছি মিল্কির মুখের দিকে। এক সময় মুখখানা ফেরালো ও। তখনো ওর চোখের তারায় অসীম শূন্যতা। আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে যেন খানিকটা আত্মস্থ হলো সে। তারপর কোনো এক গভীর গহ্বর থেকে জেগে উঠলো ওর কন্ঠস্বর।
...
ঢাকার রেসকোর্স মাঠে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ক্রমেই ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে উঠলো সারা পূর্ব পাকিস-ান। পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে সে উত্তাপ। সব জায়গায় শুরু হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রস'তিপর্বের প্রশিক্ষণকাজ। রাজু তখন ঈশ্বরদী জিন্নাহ কলেজের (বর্তমান ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ) বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্রলীগ মনোনীত নির্বাচিত এজিএস এবং পাকশী ছাত্রলীগের অন্যতম সংগঠক।
তাই স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তান সরকারের সাথে অসহযোগের কর্মতৎপরতায় ব্যস্ত রাজু। সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু (বর্তমানে জাসদ-এর কেন্দ্রীয় নেতা) ও কাজী সদরুল হক সুধা (বর্তমানে জাসদ নেতা)-র নেতৃত্বে পাকশীতে শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। পাকিস্তানি পতাকার বদলে পৎ পৎ করে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত সবুজ পতাকা। অন্যদের সঙ্গে রাজুও দিনরাত ব্যস্ত এসব কর্মকান্ড নিয়ে। বাড়ির কথা ভুলে গেছে সে।
নতুন রূপপুরের বগা মিঞা রোডের (অধুনা) বাড়িতে সারাদিন পথচেয়ে থাকেন তার বাবা-মা। প্রত্যেক খাওয়ার সময় ভাত বেড়ে পথের পানে চেয়ে থাকেন মা হাজেরা খাতুন। তার চোখদু'টি ছলছল করে ওঠে। শূন্যতায় ভরে থাকে মায়ের বুক। অন্ন রোচে না মুখে তার।
তিনদিন বাড়ি ফেরে নি রাজু। কোথায় খাচ্ছে, কোথায় তার গোছল হচ্ছে, কিছুই জানেন না তিনি। সন্তানের মুখদর্শনের অতৃপ্তি নিয়ে পথের দিকে চেয়ে থাকেন সব সময়।
সে দিন ‘৭১ এর ২৯ মার্চ সকাল ১০/১১টা। দলে দলে মানুষ এগিয়ে চলেছে বগা মিঞা সড়ক ধরে পাবনার দিকে।
হাতে তাদের তীর-ধনুক, বল্লম, ফালা, রাম দা। বন্দুকও দেখা যাচ্ছে কারো কারো হাতে। শঙ্কিত হয়ে উঠলেন মা হাজেরা। ভেবে কুল পাচ্ছেন না তিনি। কোথায় যাচ্ছে এত লোক।
সকাল থেকেই বাম চোখ নাচছিল তার। বাড়ির আশেপাশে গাছের ডালে কাক ডেকে চলেছে ক’দিন থেকে একটানা। সকালে নাস্তা বানাতে যেয়ে হাতের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে শ্বশুরের আমলের চীনামাটির বৈয়ামটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। কী যেন এক অজানা আশংকায় দুরু দুরু করছে বুক। বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে এসবই চিন্তা করছেন তিনি।
আর অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন জনতার চলমান স্রোতের দিকে। এমন সময় তার দিকে এগিয়ে এলো দুই যুবক। বলল, "খালাম্মা, পানি খাওয়াতে পারেন?"
সম্বিৎ ফিরে পেলেন হাজেরা খাতুন। বললেন, "হ্যাঁ, বাবা, একটু অপেক্ষা কর। " বলেই বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন তিনি।
এক জগ পানি আর একটা গ্লাস একজনের হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "এত লোকজন কোথায় যাচ্ছে, বাবা?
মাধুপুরের যুদ্ধে যাচ্ছে সবাই, প্রতিরোধযুদ্ধে। পাকিস্তানী সেনা বাহিনী নগরবাড়িতে বাঙালী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ব্যুহ ভেদ করে পাবনা শহর অতিক্রম করে মানসিক হাসপাতালের পাশ দিয়ে ঈশ্বরদীর দিকে এগিয়ে আসছে। "আমরা মাধপুরে তাদের প্রতিহত করবো। তাই সেখানে যাচ্ছি। "
"রাজুকে চেনো তোমরা, হাবিবুর রহমান রাজু?"
"হ্যাঁ, রাজুকে চিনবো না কেন?" উত্তর দিল একজন।
"রাজু আপনার কে হয়?" অপরজনের প্রশ্ন।
"আমার ছেলে। কোথায় সে জানো?" প্রশ্ন করেন হাজেরা খাতুন।
"রাজু তো অনেক আগেই চলে গেছে মাধপুর। আমরা আসি, দোয়া করবেন খালা।
" বলেই চলে গেলো ছেলেদুটি।
অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে রইলো হাজেরা চলমান জনস্রোতের দিকে চেয়ে। নিমেষেই কে যেন শুষে নিয়েছে তার সারা শরীরের রক্ত। পান্ডুবর্ণ হয়ে গেলো তার মুখখানা। সকাল দশটার মত বাজে এখন।
চমকে উঠলেন হাজেরা খাতুন। এত বেলা হয়ে গেছে, রাজুর বাপের তো এখনো নাস্তা হয় নি। গেছে কোথায় লোকটা? সেও কি যুদ্ধে গেলো নাকি? আবার রাস্তার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন তিনি। জনতার ভিড় এতক্ষণে কমে গেছে রাস্তায়। ওই তো রাজুর বাপ আসছে।
হাত দু'খানা পেছনের দিকে, মুখখানা গম্ভীর থমথমে। একদৃষ্টে পাথরের দিকে চেয়ে বাড়ির পথে আসছে সে। বুকের মধ্যে এতক্ষণ কষ্টের যে জগদ্দল পাথর বুকখানাকে পিষে মারছিল সে পাষান গলে অশ্রুতে রূপ নিলো। স্বামী সন্মুখে আসতেই কান্না মিশ্রিত আর্তনাদে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন, "আমার রাজু কোথায়?"
স্ত্রীর একখানা হাত নিজ মুঠোর মধ্যে টেনে নিয়ে স্বস্নেহে বললেন, "এখনই এত উতলা হইও না রাজুর মা। সুস্থ্যভাবে ওর ফিরে আসার জন্য দোয়া কর।
"
আব্দুর রশীদ ভাবলেন, শুধু রাজু কেন-যারা আজ এই মহান কাজের জন্য এগিয়ে গেলো তারা সবাইা তো আমাদেরই সন-ান। আল্লাহ যেন সকলকে সুস্থ্য শরীরে ফিরিয়ে আনেন। আজ তো সন্তানের কোনো মালিকানা নেই। সবার পরিচয় একটা, সবাই বাঙালী-সন্তান। বাংলার সৈনিক, বাংলার সূর্য সন্তান।
বাঙালী আজ সব ভেদাভেদ ভুলে এক পরিচয়ে সমবেত হয়েছে। আমরা সবাই বাঙালী। আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতি এক, লক্ষ্য এক। সকলের সকল চাহিদা, সকল বাসনা একত্রে মিলে একটা চাওয়ায় রূপ নিয়েছে, স্বাধীনতা, বাংলার স্বাধীনতা। পশ্চিমাদের কবল থেকে মুক্তি, বৈষম্মের কবল থেকে মুক্তি।
ওই শিমুল গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখো, ক’দিন আগে টকটকে লাল ফুলে ছাওয়া ছিল গাছটা। আজ তাতে ফল ধরেছে। এতদিন ধরে স্বাধীনতার যে লাল ফুল হৃদয়কে রঞ্জিত করে রেখেছিল আজ তা নিষিক্ত হয়েছে। ফল ধরেছে তাতে। স্বাধীনতা নামের সোনার ফসল ঘরে আসার জন্য নিজেই উদ্গ্রীব হয়ে পড়েছে।
এখন কি আমাদের রাজু ঘরে বসে থাকতে পারে?
আব্দুর রশীদ রাজুর মাকে বললেন, "চলো, ঘরে চলো, আমার তো নাস্তা হয় নি। আমাকে নাস্তা দেবে না?"
এবারে চঞ্চল হয়ে ওঠেন হাজেরা খাতুন। আঁচলে চোখমুখ মুছে বললেন, "তুমি হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসো, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি। অনেক বেলা হয়ে গেছে, সেই কখন থেকে আমি পথচেয়ে আছি। "
স্বামীকে খাবার দিয়ে পাশে বসলেন হাজেরা খাতুন।
স্বামী খাওয়া শুরু করেছেন, কিন্তু এক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে চিবিয়েই চলেছেন।
বেলা বেড়ে গেছে। ছোট ছেলেমেয়েগুলোর দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রতিদিন রান্নাঘরের প্রতি এসময় দুর্বার আকর্ষণ থাকে হাজেরার। আজ কেন যেন বিরক্ত লাগছে তাঁর রান্নাঘরে যেতে।
কিন' যেতে তাকে হবেই। বাচ্চা ক’টার মুখ চেয়ে। এক সময় যেতে হলো, এবং রান্নাও শেষ হলো। কিন্তু সবাই যেন আজ খাবারের প্রতি উদাসীন। এমনকি ছোট বাচ্চাটাও ভুলে গেছে খাবারের কথা।
আব্দুর রশীদ কোথায় বেরিয়ে গেছেন নাস্তা সেরেই। এখনো ঘরে ফেরার নাম নেই। স্বামীর জন্য ভাত বেড়ে বসে আছেন হাজেরা খাতুন। নিজের ক্ষুধাতৃষ্ণা যেন মিটে গেছে সেই সকাল থেকে। শরীর-মন অবশ হয়ে আসছে তার।
ইতিমধ্যেই রাস-ায় জনকোলাহল আবার বেড়েছে। ফিরতে শুরু করেছে লোকজন আবার মাধপুর থেকে। উৎকর্ণ হয়ে বাড়ির বাইরে এলেন তিনি। দ্রুত চলে যাচ্ছে লোকজন রাস্তা দিয়ে। পথের পাশে কোনো একজন লোক হাত নেড়ে বলছে আরেকজনকে, "তিন জন মারা গেছে, তিনজন।
না, না, কে কে তা জানি না। "
এর কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছলো সেই মর্মান্তিক সংবাদ ‘‘রাজু মারা গেছে পাক হানাদারদের গুলিতে। " সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন হাজেরা খাতুন। সন্ধ্যার পর ঘোড়ার গাড়ি থেকে মইয়ের ওপর শোয়ানো রাজুর লাশ যখন উঠানে নামানো হলো মা হাজেরার তখন জ্ঞান নেই। তারপর থেকে মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে পেয়েই বুক চাপড়ে কাঁদছেন, তারপর জ্ঞান হারাচ্ছেন।
এ পর্যন্ত বলেই থামলেন মিল্কি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, "রাজু ভাইয়ের দম্ভ ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর রাজু ভাই বলেছিলেন, স্বাধীনতার জন্য যদি রক্ত দিতে হয় তবে সে রক্ত আমিই প্রথম দেব আমার বুক থেকে। আমিই হব এখানকার প্রথম শহীদ। "
তার সেদিনের সেই আস্ফালন যে কত নির্ভেজাল তা তিনি প্রমাণ করে গেলেন মাধপুরের মাটিতে নিজের রক্ত বিলিয়ে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস গড়তে গিয়ে তিনি নিজেই ইতিহাস হয়ে গেলেন। সেদিন আর এক ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল তার জানাজায়। সেদিন নুতন রূপপুর খেলার মাঠে তিনজন শহীদের নামাজে জানাজায় যত লোক সমবেত হয়েছিল আজও পর্যন্ত ওই মাঠে অতো লোক কোনদিন জমায়েত হয় নি। নুতন রূপপুর গোরস্থানে পাশাপাশি তিন শহীদের কবর। তার ওপর সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা।
আটত্রিশ বছরেও কেউ এগিয়ে আসে নি কবর তিনটি সংরক্ষণ করতে। আজো চলার পথের পথিকরা যেতে-আসতে মাথা নত করে তাকায় কবর তিনটির দিকে।
জিজ্ঞেস করলাম, "সরকারী সাহায্য কিছু কি পেয়েছিল এ পরিবার?"
"জ্বি হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর আমলে একবার দু’হাজার টাকা এবং মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কাছ থেকে আরেকবার সাত হাজার টাকা অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে। "
মিল্কি আক্ষেপ করে বলেন, "আসলে স্বাধীন দেশে এখন সরকার আসে সরকার যায়। দেশে প্রভুত উন্নয়ণ হচ্ছে এরকম বুলি সবাই আওড়ায়।
কিন্তু এসব হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কেউ উল্লেখযোগ্য কিছু করেছে এমন কথা শোনা যায় না। "
সত্যিই কি তাই?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।