কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! রেলস্টেশনে একটা প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে আছে শায়লা। একটু পরপর অস্থিরভাবে হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। একেকবার ঘড়ি দেখার সাথে সাথে কুঞ্চিত ভ্রূ আরও কুঁচকে যাচ্ছে তার।
ট্রেন আসবে আর একটু পরে। সেই ট্রেন স্টেশনে দাঁড়াবে মাত্র পাঁচ মিনিট।
তারপর আবার যাত্রী নিয়ে রওনা দেবে গন্তব্যে।
শায়লার হাতে দুটো টিকিট। একটা নিজের জন্য। আরেকটা অমির জন্য। অমি চরিত্রটি শায়লার গল্পে বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আর একটু পরে এই অমির হাত ধরেই শায়লা পালিয়ে যাবে।
ব্যাপার তেমন কিছু না। অমি দেখতে ভালো, বেশ ভালো ছাত্র। শায়লার চেয়ে সামান্য লম্বা। পাশাপাশি দাঁড়ালে তাদের বেশ মানাবে।
অমি শায়লাকে ভালোবাসে।
শায়লাও ভালোবাসে অমিকে। সমস্যা শুধু একটাই জায়গায়। অমির বাবা মা কেউ নেই। ছুটিতে সে বাসায় যায় না। এটাও সমস্যা না।
সমস্যা হচ্ছে, অমি শায়লার চেয়ে মাত্র, মাত্র ছয় বছরের জুনিয়র।
***
জনাব ডাঃ কামরুল হাসান অস্থিরভাবে নিজের ঘরে পায়চারি করছেন। এরকম পায়চারি তিনি সাধারণত করেন না, আসলে সারাদিন তিনি এত রোগী দেখেন যে পায়চারি করার কোন সময় তার থাকে না। অন্য কোনকিছু চিন্তা করারই সুযোগ থাকে না তার আসলে। কিন্তু আজ তার কপালে চিন্তার ভাঁজ।
চিন্তার কারণ একই সাথে সাধারণ এবং অসাধারণ। সাধারণ এই কারণে, তার মেয়ে এক ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। এটা খুবই সাধারণ, এরকম ঘটনা বাংলাদেশে হরহামেশাই ঘটে। কিন্তু ঘটনার অসাধারণত্ব হচ্ছে, তার গুণবতী মেয়ে যার হাত ধরে পালিয়েছে তার বয়স মেয়ের থেকে বেশ কম। তার মেয়ে করে চাকরি, ঐ ছেলে নাকি এখনও পড়াশোনা করে।
কামরুল হাসানের মুখের কোণে সূক্ষ্ম একটা হাসির রেখা জন্মেই মিলিয়ে গেল। কি হাস্যকর ব্যাপার। ছোটভাইয়ের বয়সী কারো সাথে পালানো। মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তার মেয়ের?
***
শায়লা অমির ভালোবাসার কাহিনী খুব একটা আহামরি কিছু নয়। অমি যখন মেডিকেল ফোর্থ ইয়ারে পড়ত, শায়লা তখন তাদের মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগে এম ফিল স্টুডেন্ট ছিল।
সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে অমিদের ব্যাচ টিচার হয় শায়লা।
ভালো ছাত্র হবার সুবাদে অমিকে ব্যাচ মনিটর বানায় শায়লা। অমির সাথে নাম্বার আদান প্রদান করে। তারপর কিভাবে যে কি হয়ে গেল শায়লা জানে না। কে আগে কাকে পছন্দ করেছে, কে কাকে কি বলে প্রপোজ করেছে, এইরকম একটা সম্পর্কে জড়ালে ভবিষ্যতে কি হবে এসব ঠিকমত বুঝে ওঠার আগেই শায়লা দেখল অমি ছাড়া তার জীবন অন্ধকার।
যেহেতু কেউ মেনে নেবে না, শায়লাই প্রস্তাব দিল পালানোর। অমি অনেক ভেবেও রাজি না হবার কোন কারণ খুঁজে পেল না। অথবা পেল, কিন্তু প্রবল ভালোবাসার কাছে সেসব কারণ তুচ্ছাতীত তুচ্ছ বলে মনে হল তার কাছে। আর তার বাবা মা নেই, সুতরাং কোন পিছুটানও নেই।
সব ঠিকমত প্ল্যান করা হল।
কবে যাবে, কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে। ঠিক হল শায়লা আগে এসে টিকিট কেটে রাখবে, অমি পরে আসবে। তারপর তারা একত্রে চলে যাবে দূর বহুদূর। তারপর কি হবে তারা জানে না।
শায়লা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
অমি আসছে না। শায়লার কেমন যেন অস্থির লাগছে। পানির পিপাসা লাগছে খুব।
ট্রেন চলে এল। শায়লার খুব কান্না পাচ্ছে।
খুব কান্না। কান্নাটা দলা পাকিয়ে বারবার বুকের কাছে উঠে আসছে।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। না, অমি আসে নি। শায়লা হঠাৎ করেই বসে পড়ে মুখ ঢেকে ফেলল আঁচল দিয়ে।
উথলে ওঠা কান্নার স্রোত কোনভাবেই সামলাতে পারল না সে।
***
ডাঃ নুসরাত সুলতানা তখন সেকেন্ড প্রফের ভাইভা নিচ্ছিলেন। এক গাধা স্টুডেন্ট এসেছে, একটা উইপন জীবনে দেখে নি, পয়জনের নাম একটাও জানে না। হ্যাঙ্গিং এর ডেফিনিশনই বলতে পারে নি গাধাটা। অথচ গাধার বাপ নাকি রংপুর মেডিকেলের প্রিন্সিপাল।
বিশ্বাস করা যায়?
গাধার ভাইভা নিয়ে নিজেকেও গাধা গাধা মনে হচ্ছিল নুসরাত সুলতানার, তখনই ফোন এল তার। নুসরাত দেখলেন, স্ক্রিনের উপর কলার আই ডির জায়গায় লেখা, “O”। এটা তার স্বামীর নাম্বার, তিনিও ডাক্তার, নাম তার কামরুল হাসান। কামরুল হাসান তাকে ফোন দিতেই পারেন, কিন্তু এই অসময়ে! ব্যাপারটা কি?
নুসরাত সুলতানা গাধাকে ১০০ তে ২০ দিলেন। এই গাধার পাশ করার কোন অধিকার নেই, গাধার বাপ যে-ই হোক না কেন।
গাধাকে পাঠিয়ে দিয়ে ফোন রিসিভ করলেন তিনি।
ওপাশ থেকে কামরুল হাসানের গলা শোনা গেল, এই শোন, শকিং নিউজ।
নুসরাত সুলতানার ভ্রূ কুঁচকে গেল। কি এমন শকিং নিউজ?
কি নিউজ?
নিউজ তোমার গুণবতী মেয়েকে নিয়ে।
কি করেছে মেয়ে?
তোমাকে বলেছিল না বান্ধবীর বিয়েতে যাচ্ছে, তিনদিন থাকবে? বলেছিল কিনা?
হুম বলেছিল।
সেই বান্ধবী আজ ফোন দিয়েছিল। রূম্পা না টুম্পা কি যেন নাম।
তো? কি বলেছে?
কি আর বলবে? আদর্শ মায়ের আদর্শ মেয়ের মতই কাজ করেছে তোমার মেয়ে।
মানে?
মানে আর কি? বাসায় আস, ডিটেইলস বলব। ফোন রেখে দিলেন কামরুল হাসান।
নুসরাত সুলতানার বুকের মধ্যে কেমন ধুপধুপ শব্দ করতে লাগল। কি করেছে তার মেয়ে? তার এর ভালো, এত লক্ষ্মী মেয়েটা কি এমন করেছে?
নুসরাত সুলতানা আর কারো ভাইভা নিতে পারলেন না। আরেক জুনিয়র স্যারকে ইন্টারনাল হিসেবে বসিয়ে দিয়ে রওনা দিলেন বাসার উদ্দেশ্যে। জানা যায়, তিনি ভাইভা নেবেন না এই খবরে আনন্দিত হয়ে সেদিনের বাকি স্টুডেন্টরা জিলাপি সহকারে মিলাদ দিয়েছিল।
***
একটু পরে, কে যেন তার ঘাড়ে হাত রাখল।
অমি বলল, সরি।
শায়লার চোখে পানি, বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা প্রবল অভিমানের সাথে সদ্য মেশা এক সাগর আনন্দ। অমি তাকে টেনে তুলল। তারপর দুজনে মিলে ছুট লাগাল ট্রেনের দিকে।
ট্রেনের সিটে দুজন পাশাপাশি বসে।
শায়লা ভেজা চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে। অমি বলল, আসতে একটু লেট হয়ে গেল। রাস্তায় কিরকম জ্যাম থাকে তুমি তো জানোই।
শায়লা কোন উত্তর দিল না।
অমি বলল, শায়লা, এখনও কিন্তু সময় আছে।
তুমি ইচ্ছা করলেই ফিরে যেতে পার। আমি তোমাকে আটকাব না।
শায়লা নিশ্চুপ রইল।
অমি বলল, তোমার জীবনের যে কোন ডিসিশন তুমি নিজের ইচ্ছামত নিতে পার। আমি তোমায় বাঁধা দেব না।
শায়লা হঠাৎ করেই শ্লেষের সুরে বলল, তোমার কি মনে হচ্ছে আমি স্বেচ্ছায় তোমার সাথে আসি নি?
অমি বলল, অবশ্যই তুমি স্বেচ্ছায় এসেছ। কিন্তু এখনও ভেবে দেখ শায়লা, এখনও কিন্তু তুমি ফিরে যেতে পার। আমি শুধু চাই আমার কারণে যেন তোমাকে শেষ জীবনে অনুতাপ করতে না হয়।
শায়লা মুখ ফিরিয়ে নিল। সে এসব কথা অনেক ভেবেছে।
অনেক ভেবেই পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
***
নুসরাত সুলতানা বাসায় এসে দেখলেন কামরুল হাসান চেয়ারের উপর হা করে বসে আছেন। কেমন উদাস উদাস দৃষ্টি তার।
নুসরাত সুলতানা বললেন, কি করেছে মেয়ে?
কি করেছে? আদর্শ বাপ মায়ের আদর্শ মেয়ের যা করা উচিৎ তা-ই করেছে।
মানে? হেঁয়ালি না করে আসল কথাটা বল।
পালিয়েছে।
পালিয়েছে? কোথায়?
সেটা ফ্যাক্টর না। একজনের সাথে পালিয়েছে সেটা ফ্যাক্টর।
সে কি? কার সাথে?
একটা ছেলের সাথে।
বল কি?! কখন? কোথায় গেছে ওরা? আমাকে তো একবারের জন্যও কিছু বলে নি।
বলবে কিভাবে? বলার মত কাজ করলে তো বলবে।
মানে? কাউকে পছন্দ করে এটা তো আমাকে বললেই পারত।
ওখানেই তো প্রবলেম। সে কাকে পছন্দ করেছে জানো? মানে কার সাথে ভেগেছে?
কার সাথে?
ছেলে ছাত্র। মেয়ের চেয়ে নাকি চার পাঁচ বছর ছোট হবে।
রূম্পা না টুম্পা তো তা-ই বলল।
নুসরাত সুলতানা কিছুক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলেন না। তার নিজের রক্ত পানি করে মানুষ করা, নিজের গর্ভে কোলে লালন পালন করা মেয়ে তাদের মুখে চুনকালি মেরে পিচ্চি একটা ছেলের সাথে পালিয়েছে? তার মেয়ে এরকম একটা হাস্যকর কাজ কিভাবে করতে পারল?
হঠাৎ নুসরাত সুলতানার ঠোঁটের কোণে একটা সুক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল। হাসিটা আবার মিলিয়ে গেল সাথে সাথেই। অস্ফুট স্বরে তিনি বলে উঠলেন, বলদ!
***
শায়লা আর অমি বিয়ে করল।
শায়লার এক বান্ধবীর বাসায় উঠল তারা। বান্ধবী অমি আর শায়লার বয়সের পার্থক্য জানত না। সে প্রথমে অমিকে বরের ছোট ভাই মনে করল। পরে তাকে যখন আসল ঘটনা বলা হল, প্রবল ঘৃণায় নাক সিটকাল সে।
একটাই রুম বরাদ্দ হল তাদের জন্য।
ঘণ্টাখানেক ধরে গোছগাছ করল শায়লা। একটা বেড, একটা টেবিল। অ্যাটাচড বাথরুম। আর কিছু নেই। শায়লাও কিছু টাকা ছাড়া আর কিছু নিয়ে আসে নি।
অমির অবস্থা আরও খারাপ। টিউশনির হাজার চারেক টাকা ছাড়া তার কাছে আর কিছুই নেই।
অমির জন্য অনেক কষ্টে একটা টিউশনি জোগাড় করা হল। ক্লাস থ্রি, মাসে তিন হাজার দেবে। শায়লার জন্য আগে থেকেই বান্ধবী একটা বাচ্চাদের স্কুলে পার্ট টাইম পড়ানোর ছোট একটা চাকরি ম্যানেজ করে রেখেছিল।
পালিয়ে আসার তিন দিন পর থেকে ওরা উপার্জনে লেগে গেল। বান্ধবী তো আর সব খরচ দেবে না। এমনকি সাবলেট ধরে টাকাও চেয়ে বসতে পারে। চাইলে দিতে হবে, কি আর করা।
প্রথম কয়েকদিন এবং কয়েকরাত স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্নের মত কেটে গেল তাদের।
***
নিজেদের ড্রয়িংরুমে মুখ গোমড়া করে বসে আছেন কামরুল হাসান ও নুসরাত সুলতানা। তাদের সামনাসামনি বসে আছেন পুলিশ অফিসার সারজিল খান। সারজিল খান তাদের পারিবারিক বন্ধু। মেডিকেল পড়া শেষ করে বিসিএস দিয়ে পুলিশে জয়েন করেছিলেন তিনি।
সারজিল খান বললেন, স্যার আপনার মেয়ের একটা ছবি লাগবে।
কামরুল হাসান দিলেন। মেয়ের সিঙ্গেল ছবি।
সারজিল খান বললেন, ওর বান্ধবী লোকেশন বলেছে না?
কামরুল হাসান বললেন, বলেছে। তুমি লেখ, আমার মুখস্থ আছে।
সারজিল খান ঠিকানা লিখে ফেললেন।
তারপর বললেন, আপনারা ঠিক কি ধরণের অ্যাকশন চান?
কামরুল হাসান বললেন, তুমি ওখানে যাবা, কোন কথা না বলে ধরে নিয়ে আসবা। না আসতে চাইলে ছেলেটাকে কিডন্যাপিং এর কথা বলে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসবা। সাথে দেখবা মেয়েও সুড়সুড় করে চলে আসছে।
সারজিল খান তার ছোট প্যাডটা বন্ধ করতে করতে বললেন, আপনাদের ফ্যামিলি ম্যাটার, আপনারা নিজে গেলেই ভালো হত।
কামরুল হাসান বললেন, একটু প্রবলেম আছে।
সেটা তুমি বুঝবা না। ওটা না হলে আমরাই যেতাম।
সারজিল খান আর কোন কথা না বলে দাঁড়িয়ে গেলেন। কামরুল হাসানের কথা সে বেদবাক্যের মত মানে। সারজিল খান যখন মেডিকেলে পড়তেন তখন কামরুল হাসান তার মায়ের পেটের অপারেশন করেছিলেন, মেডিকেল স্টুডেন্ট বলে এক টাকাও নেন নি।
***
ছয় দিন ভালোই কাটল, কেউ তাদের খুঁজে পেল না। সপ্তম দিনের দিন বাসায় ফিরে বান্ধবীর ড্রয়িং রুমে হঠাৎ করেই এক ইউনিফর্মধারী পুলিশ অফিসারের উপস্থিতি লক্ষ্য করল শায়লা। পুলিশ অফিসার শায়লাকে দেখেই বলে উঠলেন, এই যে, আসুন আসুন। আপনাকেই খুঁজছিলাম।
শায়লা বসল।
সে দেখল, অমি বসে আছে পুলিশ অফিসারের উলটো দিকের সোফায়, বান্ধবী দাঁড়িয়ে আছে অদূরে। শায়লা বলল, আপনি কি উদ্দেশ্যে এসেছেন জানতে পারি?
পুলিশ অফিসার বললেন, আমার উদ্দেশ্য প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল। আপনাদের আমার সাথে যেতে হবে।
শায়লা বলল, দেখুন, আমি বাচ্চা বা অপ্রাপ্তবয়স্ক নই। আমার লিগাল গার্জিয়ান আমি নিজেই।
কোন কারণ ছাড়া আপনারা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারেন না।
পুলিশ অফিসার বলল, পারি। ধরুন আপনাকে কিডন্যাপ করে এনেছে আপনার এই প্রেমিক, এই অভিযোগে আপনাদের দুজনকেই থানায় নিতে পারি আমি। বা ধরুন এলাকায় একটা বাচ্চা খুন হয়েছে, সেই খুনী সন্দেহের হাত থেকে বাঁচতে বান্ধবীর বাসায় লুকিয়ে আছে, কাভার হিসেবে একটা বাচ্চার সাথে স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস শুরু করেছে, এরকম একটা ওয়ারেন্ট দেখিয়েও আপনাদের গ্রেফতার করতে পারি আমি।
শায়লা কি বলবে ভেবে পেল না।
পুলিশ অফিসার বললেন, ওর চেয়ে আমার কথা শুনুন, চুপচাপ আমার সাথে থানায় চলে আসুন। এমনিই আপনারা যে কাণ্ড ঘটিয়েছেন, সারা পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ঢি ঢি পড়ে গেছে। আমাদের কাজে বাঁধা দিলে আপনাদের নিয়ে প্রকাশ্যে টানা হেঁচড়া হবে, আপনার এবং আপনার পরিবারের মানসম্মানের বারোটা বেজে যাবে। আশা করি সেটা আপনি চাইবেন না।
শায়লা অমির দিকে তাকাল।
অমি মাথা নিচু করে পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে শায়লা যা বলবে সে তা-ই মেনে নেবে।
শায়লা তার বান্ধবীর দিকে তাকাল। বান্ধবী ছোট ছোট চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে তাদের বর্তমান অবস্থান এই বান্ধবীই ফাঁস করে দিয়েছে।
শায়লা জানত, আজ হোক বা কাল এমন দিন আসবেই যেদিন তাকে সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সর্বসমক্ষে নিজের কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করতে হবেই একদিন। তবে সেই একদিন যে এত তাড়াতাড়ি আসবে এটা তার কল্পনায় ছিল না।
শায়লা উঠে দাঁড়াল। বলল, চলুন।
***
ডাঃ নুসরাত সুলতানা - ডাঃ কামরুল হাসান দম্পতি বিরক্ত মুখে নিজেদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। একটু আগে সারজিল খান ফোন করেছিলেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়ে আর মেয়ের প্রেমিককে বাসায় পৌঁছে দেবেন তিনি।
নুসরাত সুলতানা কামরুল হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কখনো ভাবতে পারি নি আমার মেয়ে এমন করবে।
কামরুল হাসান বিরক্ত মুখে বললেন, কিছুই করার নাই। সবই কর্মফল।
একটু পরে গেটের বাইরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ানোর শব্দ পাওয়া গেল। নুসরাত সুলতানা কামরুল হাসানের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি কিন্তু ওকে মারবে না।
কামরুল হাসান পিচিক করে একটা থু থু ফেললেন। নুসরাত সুলতানা আরও শক্ত করে তার হাত জড়িয়ে ধরলেন।
লোহার গেটটা খুলে প্রথমে ঢুকলেন সারজিল খান।
তার পিছন পিছন ঢুকল কামরুল হাসান - নুসরাত সুলতানার মুখে চুনকালি মারা তাদের একমাত্র তনয়া। আর তারও পিছনে উঁকি দিতে লাগল বাচ্চা বাচ্চা চেহারার একটা ছেলের মুখ।
সারজিল খান উলটো ঘুরে গাড়ির দিকে চলে গেলেন। কামরুল হাসান - নুসরাত সুলতানা দম্পতি দেখলেন, তাদের একমাত্র মেয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে হেঁটে তাদের দিকে আসছে। মেয়ের মুখে রাজ্যের বিষাদ, দেখেই বোঝা যাচ্ছে মনের আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা।
মেয়ে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে, আর একটু একটু করে নস্টালজিক হয়ে পড়ছেন কামরুল হাসান - নুসরাত সুলতানা দম্পতি। তাদের মনে পড়ছে একমাত্র মেয়ের জন্মের আগের কথা, যখন তারা একসাথে থাকার জন্য কত কিই না করেছেন। বিবাহিত হয়েও ছয় ছয়টা বছর তাদের একে অপরের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়েছে।
মেয়ে তাদের জন্মেছিল একই সাথে এক রাশ আনন্দ ও আশঙ্কা সঙ্গে নিয়ে। মেয়েকে জন্ম দিতে গিয়ে এক্লাম্পসিয়া হয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন নুসরাত সুলতানা, আল্লাহ তাকে আবার পৃথিবী ফিরিয়ে দিয়েছেন।
ডাক্তার বলেছিল আবার মা হবার চেষ্টা তার জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। সুতরাং হয়তো এই মেয়েই হবে তাদের একমাত্র সন্তান, ভবিষ্যতের অবলম্বন, চলার পথের সঙ্গী। এ সমস্ত কারণে নিজের বুকের সবটুকু ভালোবাসা মেয়েকে দিয়ে তাকে নিয়ে বিয়ের পর প্রথমবারের মত আলাদা বাসায় থাকা শুরু করেছিলেন তারা, ভালোই চলছিল তিনজনের সুখের সংসার। নুসরাত সুলতানার মনে পড়ে, তিন বছরের মাথায় মেয়ের শ্বাসনালীতে ইনফেকশন হয়ে ভয়াবহ অবস্থা, মেয়ের জীবন নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি, তখন তিনি টানা সাত দিন না ঘুমিয়ে থেকেছিলেন। তার মনে পড়ে, ক্লাস টুতে পড়ার সময় মেয়ে একবার স্কুলের বাথরুমে আটকা পড়ে, আর তারা তন্নতন্ন করে সারা শহর চষে ফেলেন।
সেদিন রাতেই মেয়েকে উদ্ধার করার পর পুরো একদিন মেয়েকে কোলছাড়া করেন নি তিনি।
নুসরাত সুলতানার চোখ পানিতে ভিজে আসে। তার মনে পড়ে তার মেয়ে যখন ক্লাস নাইনে তখন সে প্রথম প্রেমপত্র পায়। সেই ছেলেকে প্রশ্রয় দেবার অপরাধে মেয়েকে পুরো একদিন খেতে দেন নি তিনি, পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিনি নিজেই এমন কান্নাকাটি শুরু করেছিলেন যে মেয়ে ভয় পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, মা মা বিশ্বাস কর তোমায় না বলে আমি আর কিছু করব না।
চোখের পানিতে নুসরাত সুলতানার স্মৃতির পাতা ঝাপসা থেকে আরও ঝাপসা হতে থাকে।
মেয়ে এসে ভীত পায়ে তার সামনে দাঁড়ায়।
নুসরাত সুলতানা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলান। অতঃপর মেয়েকে উদ্দেশ্য করে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, বাপ মা গাধা বলেই তুই গাধা হবি?
***
শায়লা বাসায় ফেরার সাথে সাথে মায়ের হাতে চারটা থাপ্পর খেল। তারপর মা হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে হুড়মুড় করে কাঁদতে লাগলেন। শায়লা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
রাতে শায়লাকে একাধিকবার জিজ্ঞেস করা হল, তুমি যা করেছ ভেবেচিন্তে করেছ?
শায়লা প্রতিবারই নিঃসঙ্কোচে জবাব দিল, হ্যাঁ।
তারপর অদ্ভুত কোন কারণে অমির সাথে শায়লার সম্পর্ক শায়লার মা মেনে নিলেন। সেই কারণটি আমরা না হয় না-ই জানলাম। তার মাসখানেক পর শায়লার বাবাও নরম হলেন মেয়ের প্রতি। মেয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়াটাই অজ্ঞাত কোন কারণে সঠিক বলে মনে হল তার কাছে, সেই কারণটাও নাহয় আমরা না জানলাম।
ঠিক হল, অমি আবার ক্লাস করা শুরু করবে, কিন্তু শায়লা অন্য কোথাও চাকরি খুঁজে নেবে। এতদিন কোথায় ছিল তারা, একসাথে ছিল কি না, তাদের একসাথে উধাও হওয়ার অন্য কোন কারণ আছে কি এসব নিয়ে কেউ মুখ খুলবে না কারো কাছে।
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। বিয়ের ছয় বছর পর শায়লা আর অমি একসাথে থাকা শুরু করে। একটাই মেয়ে হয় তাদের।
মেয়েটির নাম রাখা হয় স্নিগ্ধা।
***
স্নিগ্ধা কিছু বলল না।
নুসরাত সুলতানা (শায়লা) বললেন, ও তোকে খাওয়াবে কি? পরাবে কি? আর শরীরেরও তো একটা ব্যাপার আছে, সেটাও তো ভাবতে হবে, নাকি?
স্নিগ্ধা মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলল, তুমিও কিন্তু সবকিছু চিন্তা করেই বাবাকে বিয়ে করেছিলে।
নুসরাত সুলতানা শায়লা হতাশায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার আর অমি, যার ভালো নাম কামরুল হাসান, এর অসম ভালোবাসার ফসল স্নিগ্ধা।
মেয়ে একদম মায়ের মতই কাজ করেছে। এখন না মেনে নেবারও তেমন সুযোগ নেই।
স্নিগ্ধা মায়ের সামনে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনের বাচ্চা ছেলেটাকে এখন আর বাচ্চা মনে হচ্ছে না, কেমন বড়দের মত মনে হচ্ছে তাকে। হঠাৎ নুসরাত সুলতানার কেমন মাথা ঘুরে উঠল।
তার মনে হল তার সামনে স্নিগ্ধা নয়, ত্রিশ বছর আগের যুবতী তিনি নিজেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিশ বছর আগের সেই যুবক অমি, যাকে দেখে অপার ভালোবাসায় পাগল হয়ে নিজের অবস্থান ভুলে পালিয়ে গিয়েছিলেন তখন। আকাশে ঘন অন্ধকার। মেঘে ছেয়ে গেছে ওটা। এখনই বৃষ্টি নামবে মনে হয়।
নুসরাত সুলতানা (শায়লা)র হাত মেয়ে স্নিগ্ধার গালের দিকে এগিয়ে গেল।
তবে ওটা কি আদরের উদ্দেশ্যে ছিল নাকি চড়ের উদ্দেশ্যে ছিল সেটা এই লেখকের পক্ষে জানা সম্ভব হয় নি।
(সমাপ্ত) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।