দিরাইয়ের উজানধল থেকে ফিরে:
ফালগুনের শেষ সপ্তাহ মানে বৃহত্তর ভাটিবাংলার অবিসংবাদিত বাউল সম্্রাট শাহ আব্দুল করিম লোকউৎসব। আমাদের বহনকারী গাড়িটি যখন দিরাই পৌরসভায় প্রবেশ করে তখন চারপাশের সাজসজ্জ্বা দেখে বুঝা যাচ্ছিল শাহ আব্দুল করিম লোক উৎসবের অস্থিত্ব। রাস্তার দুইপাশের বিদ্যুতের খুঁটির মধ্যভাগে বাংলালিকের লগো ও রং সমৃদ্ধ ছোট ছোট রাজকীয় ফরমান। তাতে লিখা শাহ আব্দুল করিম লোকউৎসব ২০১০ এবং “আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া” গানের অংশ বিশেষ।
দিরাই বাজার ধল সড়কের দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার।
সেখান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ যে সাবমার্জিবল রোড (ডুবন্ত) আকাবাঁকা সড়ক ভরাম হাওরের বুকচিরে চিরসবুজ ধানের েেতর মধ্যভাগ দিয়ে উজানধল গ্রামে শেষ হয়েছে। পথে যেতে যেতে দেখা গেলো মানুষের মিছিল। সূর্য্য তখন তার সবটুকু শক্তিদিয়ে তাপবর্ষণ করছিলো। কিন্তু ফাগুনের দখিনা হাওয়া পথচারীদের গায়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে পরম যতেœ সমাদর করে। ধল সড়ক ধরে গাড়িতে চড়ে মেলায় পৌঁছাতে ৩০ মিনিট সময় লাগে।
পথের শেষ ভাগে বাংলালিংক করিমের প্রতিকৃতি ও উৎসবের প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে পোষ্টার দিয়ে তৈরী করেছে সুদৃশ্য তোরণ। গ্রামের একপ্রান্তে এবরো থেবরো মেঠো পথে ধুলির ঝড়,বাঁশের ঝাড়,করচ বাগান পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম উজানধল গ্রামের মাঠে। গ্রামীণ রাস্তার শুরুতে সারি সারি করচ গাছ লোকউৎসবের আভিজাত্য কে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়ে ছিলো। তখন বেলা ৩ টার কাছাকাছি হবে। গ্রামের রাস্তা ধরে ৫ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৬০/৭০ বৎসরের প্রবীণ ছুটে চলেছেন লোকউৎসব প্রাঁঙ্গনে।
বিশাল মাঠের এক কোনে স্থাপন করা হয়েছে বাউল গানের মঞ্চ তার অদূরে ছোট ছোট গ্রামীন দোকানপাট। এগুলো কাপড়ের ত্রিপাল দিয়ে তৈরী। দমকা হাওয়ায় দোকানের ছাদে নৌকার পালের মতো শব্দের সৃষ্টি করছিলো। দোকানের সামনে এক পাটাতন বিশিষ্ট বসার বেঞ্চ আর ছোট একটি টেবিল। মেলা প্রাঁঙ্গনে বাউলিয়ানা পোষাক পড়ে ঘুরাঘুরি করছেন করিমের শিষ্যবাউলগণ।
তাদের মুখে ছিলো কষ্ট মিশ্রিত এক ধরনের আনন্দ। সে কষ্ট হলো করিম বিহীন করিম লোকউৎসবের। গায়ে পিত রংয়ের পাঞ্চাবী পড়ে সর্বত্র খেয়াল রাখছেন বাউল তনয় নূর জালাল তাঁর চোখে মুখে ছিলো অনিদ্রা আর টেনশন আর উদ্বিগ্নতার ছাপ। দেখে বুঝা যায় অনুষ্ঠানটি সফল করতে তাকে কি রকম ধকল পোহাতে হয়েছে। অসংখ্য স্টলের মধ্যে একটি স্টলে ৬/৭ বছরের একটি শিশু টেবিলের সামনে কালনীর ঢেউ, শাহ আব্দুল করিম রচনাবলী, কালনীর কুলে লোকসংগীতের বই নিয়ে বসে আছে ।
অসংখ্য বাঁক সমৃদ্ধ ধল সড়কের মধ্যে দিয়ে মেলা প্রাঁঙ্গনে জনতার মিছিল সারিবদ্ধ পিঁপিলিকার ঢলের কথা মনে করিয়ে দেয়।
সব কিছু আগের মতোই আছে নেই শুধু তিনি :
প্রয়াত করিমের বসত বাড়ির একটু দূরে দেখা যায়। বাংলালিকের লোগো সম্বলিত বেশ বড়সর পোষ্টার তাতে করিমের প্রতিকৃতি সহ লোকউৎসবের বিজ্ঞাপন দেয়া। গ্রাম্য গলিপথ পেরিয়ে করিমের বসত বাড়িতে পৌঁছতেই দেখা গেল জনারণ্য বসতবাড়ি। একপাশে করিম ভক্তবৃন্দের জন্য খাবার তৈরী করা হচ্ছে।
অপর দিকে উঠোনের মধ্যভাগে শাহ আব্দুল করিম ও মা সরলার মাজার জিয়ারত করছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত করিম ভক্তবৃন্দ। বসত ঘরে গিয়ে দেখা গেলো সব কিছু আগের মতই রয়েছে নেই শুধু করিম। তিনি যে বিছনায় ঘুমাতেন সে খাট টি জরির কাগজ দিয়ে সাজানো খাটের এক প্রান্তে রয়েছে করিমের স্থিরচিত্র অপর পাশে করিমের স্কেচ। করিমের আশপাশের বসত বাড়ির মাটির দেওয়ালে শোভা পাচ্ছিল লোকউৎসবের পোস্টার। ঘরের ভিতরে আগের মতই রয়েছে করিমের বিভিন্ন বয়সের ছবি।
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পাওয়া বিভিন্ন সম্মাননা,ক্রেস্ট,মানপত্র ইত্যাদি। কাঠের শোকেসে সাজানো রয়েছে এগুলো। একটি শোকেসে রয়েছে করিমের বিভিন্ন বইপত্র। তার গানের অনুসংঙ্গ ঢোল,দোতারা,হারমনিয়াম,মন্দিরা,বেহালা সব বাদ্যযন্ত্র করিমের বিরহে কাতর।
এগুলোর নীরব অবস্থান বলে দিচ্ছিল করিমের না থাকার কথা।
বসত ঘরের ভিতরে বেশ কয়েকজন মহিলা এদিক ওদিক বসে করিমের আত্মার শান্তি কামনা করছেন।
সেই কালনী নদীর ঘাট :
বসত বাড়ি থেকে প্রায় ২৫ মিটার দূরে কালজয়ী কালনী নদীর ঘাট। কালনীর ঘাটে বসে রাখাল বালক আব্দুল করিম রচনা করেছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয় বাউলগান। নদীর একতীরে কোন গাছপালা নেই অপর তীরে তার বাড়ি সংলগ্ন রয়েছে ছোট একটি হিজল,করচ গাছের বাগান। নদীর তীরে যেতেই ফাগুনের বসন্ত বাতাস গায়ে শিহরণ জাগায়।
কালনীর সবুজাভ স্বচ্ছজলের ঝাপটা মুখে দিতেই মন যেন অজানা এক পরম ভালোলাগার অনুভুতিতে নেচে ওঠে। কালনীর তীর থেকে শাহ আব্দুল করিমের বাড়িতে যাওয়ার সামনের রাস্তা ২/৩ ফুট প্রশস্ত। মেঠো পথের দুইপাশে লাগানো রয়েছে অসংখ্য গাছ-গাছালি। পথের মধ্যভাগে আসার পথে হাতের ডান দিকে রয়েছে করিমের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন শাহ আব্দুল করিম সংগীতালয়। এটি পেরিয়ে একটু সামনে এগুলেই দেখা যাবে চৌচালা টিনের ঘরের ভিতরে চিরনিদ্রায় শায়িত কিংবন্তী বাউল শাহ আব্দুল করিম ও মা সরলার কবর।
কবর দুটো মখমলের জায়নামাজ দিয়ে আবৃত। ঘরের ভিতরে সোনালীজড়ি লম্বালম্বি ভাবে ঝুলানো। ঘরের চারপাশে লাল রংয়ের সালু কাপড় দিয়ে দেয়া হয়েছে বেস্টনী। তার এককোনে রয়েছ করিমের সাধনার ঘর ও বসতঘর।
এদিক ওদিক বাউল ও বাউলগান :
মঞ্চের নিকট দূরে একটু শব্দজট মুক্ত পরিবেশে চায়ের স্টলে গিয়ে দেখা গেলো পারিচিত ৫/৬ বাউল।
তারা ছোট্ট বেঞ্চে বসে চা পান করছেন। গায়ে বাউল ঢংয়ের পোষাক,মাথায় লম্বাচুল, হাতে সিগারেট। তারা সুনামগঞ্জ ও দিরাইয়ের স্থানীয় বাউল শিল্পী। উৎসবে বাউলগান পরিবেশন করতে এসেছেন। তাদের কাছে প্রশ্ন ছিলো জীবিত করিম না মৃত করিম শক্তিশালী তারা যথারীতি বললেন, দুই করিমই তাদের কাছে সমান।
তবে অন্যান্য লোকউৎসবে করিম জীবিত ছিলেন কিন্তু এ বছর করিম না থাকায় তাদের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। এসময় তারা বলেন, শাহ আব্দুল করিম বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টি অসংখ্য বাউলগানের মধ্যে। বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী সাধারন অসাধারন সব মানুষের কাছে করিমের গানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তারা আরও বলেন করিম অমর অবিনশ্বর তার সৃষ্টি দ্বারা।
তখনো আনুষ্ঠানিক ভাবে মঞ্চে বাউলগান পরিবেশন শুরু হয়নি।
এমন সময় তিন তরুণ বাউল পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাদের কাছে স্বল্প পরিচিত বাউল গান শুনার দাবী জানাই, কিছুণ দাঁড়িয়ে থেকে কোন রকমবাদ্য যন্ত্রছাড়াই মঞ্চের বাইরে খালি গলায় পরিবেশন করলেন, “আমার নাও যে গাঙ্গে ডুবে না ওরে মাঝি খবরদার, খবরদার হুশিয়ার মাঝি নাওয়ে আছে ছয়জন চৌকিদার, ওরে মাঝি খবরদার। আর নদীতে ফালাইলেন আশা ভাসল তরী হইয়া, নদীতে ফালাইলেন আশা ভাসল কিস্তি হইয়া, ওরে গাজী কালু দুইজন তারা উঠিলাইন বসিয়া ওরে মাঝি খবরদার”।
শেষ বিকেলের উৎসব ঃ
সূর্য্য যখন মধ্য আকাশ হতে নিজেকে ক্রমশ সরিয়ে নিচ্ছিল ততই বাড়ছিলো মানুষের আনাগোনা। পুরো সড়ক তখন বিভিন্ন যানবাহনের দখলে।
মেলার প্রাঙ্গনের খালি জায়গা ধীরেধীরে জনতার পদাভারে ভারাক্রান্ত হতে লাগলো। বোরো জমির সরু আইল ছেলেবুড়ো ছুটে আসতে থাকেন ধলগ্রামের মাঠে। শেষ বিকেলের প্রায় ঘন্টা খানেক সময়ের মধ্যে জনতার সমুদ্রে পরিণত হয় বিশাল মাঠ। অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেমের কল্যাণে এক কিলোমিটার দূর থেকে বাতাসে ভর করে ভেসে আসা বাউলগান মানুষের চলার গতি আরও বৃদ্ধি করে। করিম বিরচিত বাউল গানের সাথে সুর মেলান বাউল তনয় নূর জালাল।
দেশের স্বনামধন্য বাউল ফকির শাহাবুদ্দিন,কালা মিয়া, আব্দুর রহমান, সিরাজ উদ্দিন, মমতাজ চক্রবর্তী,তোতা মিয়া,সরকার বশির উদ্দিন সহ অসংখ্য খ্যাতিমান বাউল তারকা মঞ্চে বাউলগান পরিবেশন করেন। তাদের দরাজ কন্ঠে এক এক করে ওঠে আসে বাউল শাহ আব্দুল করিম রচিত সুরারোপিত বসন্ত বাতাসে সই গোঁ বসন্ত বাতাসে, মন মজালে ওরে বাউলা গান, কেমনে ভুলিব আমি বাঁচিনা তারে ছাড়া, আমি কুলহারা কলঙ্কিনী, গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান সহ অসংখ্য মঞ্চ কাঁপানু জনপ্রিয় বাউলগান পরিবেশিত গভীর রাত পর্যন্ত।
অশ্র“সিক্ত নয়নে করিম তনয় নূর জালালের কথা:
এই প্রথম বাবা কে ছাড়া অনুষ্ঠান করছি। বাবা আর আমি এক সংগে থাকতাম তার সাথে সর্বত্র যেতাম। তিনি গানের কথার উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, বাউল আব্দুল করিম বলেন বুঝে উঠা দ্বায় কোথা হইতে আসে নৌকা কোথায় চইলা যায়।
তিনি শুধু আমার নয়,সারা দেশের,সারা বিশ্বের সারা জাতির। আমি তাঁর ছেলে কিন্তু আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া তাঁর স্মৃতিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভবনয়। বাবা আজীবন মানুষের কথাই বলেছেন। বিভিন্ন সভামঞ্চে, আসরে, গ্রামেগঞ্জে বাবা বলতেন, লোক সংগীত মানুষের সুখ দুঃখের কথা বলে। তিনি গানের মাধ্যমে তিনি সাধারন মানুষের কথা তুলে ধরেছেন।
তিনি তার গানে বলেছেন,তত্ত্ব গান গেয়ে গেলেন যারা মরমীকবি, আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ দূর্দশার ছবি বিপন্ন মানুষের দাবী। করিম চায় শান্তির বিধান মন মজালে ওরে বাউলা গান। বাবা মহামানব থেকে সাধারন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন।
জনপ্রতিনিধির কথা :
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি দিরাইয়ের কৃতিসন্তান আলহাজ্ব মতিউর রহমান বলেন, শাহ আব্দুল করিম ছিলেন আমাদের গর্ব। কোন দল মতের নয় তিনি আমাদের সকলের।
৭১ এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রণিত করেছেন। শাহ আব্দুল করিম স্বপ্ন দেখতেন শোষণ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার। তিনি শাহ আব্দুল করিম একাডেমী স্থাপনের দাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ধল সড়কটি শাহ আব্দুল করিম সড়ক হিসেবে নাম করণের দাবী
স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর কাছে জানাবেন বলে এলাকাবাসী কে আশ্বস্ত করেন। এসময় তিনি তার ব্যাক্তিগত তহবিল থেকে আব্দুল করিম সংগীতায়লয়ের উন্নয়নের জন্য নগদ ৫০ হাজার টাকা বাউল তনয় নূর জালালের হাতে তুলে দেন। শাহ আব্দুল করিমের স্মৃতিকে ধরে রাখতে তিনি সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা করার আশ্বাসদেন।
এর আগে তিনি শাহ আব্দুল করিম ও মা সরলার কবর জিয়ারত করেন।
এলাকাবাসীর দাবী:
শাহ আব্দুল করিমের নামে একটি একাডেমী ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা, উজানধল সড়কটির নাম শাহ আব্দুল করিম সড়ক হিসেবে নাম করণ করা।
বাউল মনে করিম :
শাহ আব্দুল করিম কেয়ামত পর্যন্ত মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। করিম তার একটি গানে বলেছেন, আমি আছি আমার মাঝে, আমি করি আমার খবর,আমি থাকলে সোনার সংসার, আমি মরলে শূন্য বাসর, আবার বলেছেন, করিম কয় মরাই মরে, আমি নিত্য, আমি অমর। করিম মরেন নাই তিনি আমাদের মধ্যে আছেন,থাকবেন।
আমরা তার সৃষ্টি কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবো। তারা বর্তমান সরকারের কাছে শাহ আব্দুল করিমের সৃষ্টিগুলো সংরণ করে বাঁচিয়ে রাখা ও করিম একাডেমী স্থাপনের দাবী জানান। ###
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।