বাবা-মায়ের ধরণ ও শিশুর মনোজগৎ
ডা. আহমেদ হেলাল ছোটন
বাবা-মা তো সবসময় তাদের সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। তারা চান তাদের সন্তানটি বেড়ে উঠুক সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে; সফল হোক তাদের ভবিষ্যৎ জীবন। এই আশা থেকেই তারা শিশুকে লালন করেন, ভালাবাসেন, স্নেহ দেন আবার কখনোবা শাসনও করেন। উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই- শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ। কিন্তু উদ্দেশ্য মহৎ হলেও অনেক সময় শিশুর প্রতি সঠিক আচরণ করা হয়ে উঠেনা, যখন দরকার স্নেহ আর ভালোবাসা তখন হয়ত শাসন করে বসেন আবার যখন শাসন করা দরকার তখন ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যান কোনো কোনো বাবা-মা।
সামগ্রিক বিচার বিবেচনা করে মনোবিজ্ঞানীগণ শিশুর প্রতি বাবা-মার আচরণকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন।
ভাগগুলো হচ্ছে-
১. “তোমাকে এটা করতেই হবে, নইলে......” :
সবসময় শিশুর প্রতি কর্তৃত্ব। কড়া শাসনের বেড়াজালে তাকে আটকে রাখা। ‘এটা করতে হবে’, ‘ওটা করতে পারবে না’, ‘এখুনি পড়তে বস’, ‘যাও বলছি ঘুমাতে যাও’, ‘খবরদার...’, ইত্যাদি বাচনভঙ্গি এ ধরণের বাবা-মায়ের নিত্য সংগি। সাধারণত দেখা যায় বাবা- মায়ের মধ্যে একজন সাধারণত এ ধরণের কর্তৃত্বগুলি করেন আর আরেকজন গোবেআরা হয়ে তার সন্তানের সাথে সাথে নিজেও কর্তৃত্বের শিকার হয়! আবার কখনো দেখা যায় বাবা-মা দুজন মিলেই সন্তানের উপর চরম খবরদারি করেন।
তাদের মতের ব্যত্যয় ঘটলে সন্তানের উপর নেমে আসে শাস্তি। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের কথামত না চললে যখন তখন চড়টা-থাপড়রা সন্তানের পাওনা হয়ে দাড়ায়। এধরণের বাবা- মাকে বলা হয় ‘অথরিটরিয়ান’ বা র্কতৃত্বপরায়ণ বাবা মা। এধরণের বাবা-মায়েদের সন্তানের মনোজগৎ অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে উঠে, আত্মবিশ্বাস কমে যায়, সমাজের সাথে মিশতে পারে না এবং ভবিষ্যৎ জীবনে পিছিয়ে পড়ে, অসুখি হয়ে যায়। এ বাবা-মায়েরা সন্তানের জন্য কঠিন কঠোর নিয়ম কানুন করে দেন কিন্তু এই নিয়ম মেনে চললে কি সুফল পাবে তা সন্তানকে ব্যাখা করেন না , ‘ আমি বলছি তাই এটা করতে হবে, কোনো প্রশ্ন করা চলবে না, এখুনি এটা করো, নইলে আজ তোমার কপালে পিটুনি আছে’।
কর্তৃত্বপরায়ণ বাবা-মায়েরা মনে করেন, আমরাই সন্তানের সবচাইতে ভালো চাই, তাই আমরা যেভাবে চাচ্ছি সেভাবেই ওর চলা উচিৎ।
২. “না মানে হচ্ছে না, তবে তুমি ভেবে দেখো কোনটা ভালো..”:
সন্তানের প্রতি নিয়ম কানুন আরোপ করেন, তবে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তির পরিবর্তে সন্তানকে নিয়মের গুরুত্ব ব্যাখা করেন। বুঝিয়ে বলেন কেন একটি কাজ করা উচিৎ নয় আর কেনই বা এরকটি কাজ করতে হবে। এ ধরণের বাবা-মায়েরা সন্তানের আকাক্সিক্ষত আচরণকে উৎসাহিত করেন, পুরস্কৃত করেন। অনাকাক্সিক্ষত আচরণের জন্য শাস্তি দেন না।
সবসময় ধমকের সুরে কথা বলেন না। সন্তানের বিষয়ে অনেক সিদ্ধান্ত তারা সন্তানের সাথে আলোচনা করেই নেন। বাবা-মায়েদের এ ধরণটিকে বলা হয় ‘অথরিটেটিভ-রেসিপ্রোকাল’ বা পারস্পরিক নির্ভরযোগ্য । চার ধরণের বাবা-মায়েদের মধ্যে এরাই আদর্শ। এদের সন্তানের আত্মবিশ্বাস বেশি হয়, সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল হয়ে গড়ে উঠে এবং ভবিষ্যৎজীবন সাফল্যমন্ডিত হয়, মানসিক চাপ ও প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলায় দক্ষ হয়ে উঠে এবং নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জিত হয়।
এ ধরণের বাবা-মায়েরা অনেকটা স্বাধীনভাবে সন্তানকে বেড়ে উঠতে দিলেও নিয়ম নীতির বাইরে তারা যাতে যেতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক নজর রাখে। এই বাবা-মায়েদের সন্তানেরা বন্ধু সুলভ হয়, সামাজিকতা পালন করে আর ভবিষ্যতে তারা নিজেরাও ভালো বাবা/মা হিসেবে পরিগণ্য হয়।
৩. “ তুমি যা চাও তাই কর..., যা চাও তাই দেব তোমায়”:
সন্তানের প্রতি এ ধরণের বাবা-মাযেদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সন্তান যা খুশি তাই করে। ঢালাও প্রশ্রয় পায় বাব-মাযেদের কাছে।
কোনো বাসায় যেয়ে ইচ্ছামত ভাংচুর, দুষ্টামী অতি চঞ্চলতা করলেও এ ধরণের বাবা-মায়েরা সন্তানের কোনো আচরণকেই নিয়ন্ত্রণ করেন না, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সন্তানের চাহিদা মত টাকা পয়সা দেন, যখন যা চায় তাই কিনে দেন। খুব বেমি ভালোবাসায় গদগদ হয়ে সন্তানের কোনো আচরণকেই চ্যালেঞ্জ করেন না। সাধারণত বেশি বয়সে বাবা-মা হলে সন্তানের প্রতি এমন মনোভাব দেখা যায়। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বাবা-মায়ের এ আচরণকে বলা হয় ‘ইনডালজেন্ট-পারমিসিভ’ বা প্রশ্রয়পূর্ণ আচরণ। অনেককিছুকে প্রশ্রয় দিতে দিতে কখনোবা সন্তানের সামান্য বিচ্যূতিতে তারা অসামঞ্জস্যপূর্ণ কঠিন শাস্তি দিয়ে বসেন।
এ ধরণের বাবা-মায়েদের সন্তানেরা উগ্র মেজাজেজর হয়, হতাশাগ্রস্ত হয়ে উঠে, হঠকারী আচরণ করে, ভবিষ্যৎ জীবন বাধাগ্রস্ত হয়; ভালো বন্ধু গড়ে উঠেনা, বয়ঃসন্ধিতে নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে, নেশা ও বিভিন্ন অপরাধমূলক তৎপরতায় লিপ্ত হতে পারে।
৪. “তুমি তোমার ইচ্ছামত চলো, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না...”:
এ ধরণের বাবা-মায়েরা সন্তনকে প্রায় উপেক্ষা করেন। সন্তান কী করে , কোতায় যায়, কী চায় এ সব নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। সন্তানের সাথে তাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। এধরণের আচরণকে বলা হয় ‘ইনডালজেন্ট-নেগলেক্টফুল’ বা উপেক্ষাপূর্ণ আচরণ।
‘ইনডালজেন্ট-পারমিসিভ’ এর সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে এখানে সন্তানকে অধিক ভালোবেসে নয় বরং উপেক্ষা করে তার সব আচরণকে প্রকারন্তরে প্রশ্রয় দেয়া হয়। এধরণের বাবা মাযের সন্তানেরা সামাজিকতা শিক্ষা পায় না, উগ্র মেজাজের হয়, আত্মবিশ্বাস কমে যায়।
বাবা-মায়েদের যে চার ধরণের আচরণের কথা বলা হলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিশ্র ধরণের আচরণ হতে পারে, কখনো বাবার এক ধরণের আবার মায়ের এক ধরণের হতে পাারে। কিন্তু সন্তানের মনোজগৎ সঠিকভাবে গড়ে তুলতে আর ভবিষ্যৎজীবন সুন্দর করতে বাবা-মায়ের আচরণ হতে হবে ব্যালেন্সড এবং হিসেবী। অপরিমিত কঠোরতা , অন্ধ স্নেহ বা উপেক্ষা সন্তানের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
সন্তানের সাথে কী আচরণ করবেন?
- তাকে যে ভালোবাসেন তা সরাসরি প্রকাশ করুন, কোলে নিন, চুমু দিন, তার দিকে তাকিয়ে হাসুন।
- সে যখন আপনাকে কোনো কিছু বলতে চায় তখন তার দিকে মনোযোগ দিন। বিরক্তভাব না দেখিয়ে হাতের কাজ ফেলে তারদিকে তাকিয়ে তার কথা শুনুন। পত্রিকা পড়া সাময়িক বন্ধ করে বা টিভির কোনো অনুষ্টান এর দিক থেকে সামান্য সময়ের জন্য মনোযোগ সরিয়ে সন্তানের দিকে মনোযোগ দিন।
-সন্তানকে খানিকটা ঝুঁকি নিতে শেখান।
দৌড়ালে পড়ে যাবে এভয়ে তাকে দৌড়াতে দেবেন না সেটি হবে না। সাইকেল চালাতে গেলে ব্যথা পাবে ভেবে সাইকেল চড়তে না দেয়াটা বোকামী হবে।
- কেবল সফলতা নয়- কখনো ব্যর্থতার সাথেও তাকে পরিচয় করিয়ে দিন। নাচে-গানে আপনার সন্তানকে ফার্ষ্ট হতেই হবে, আর্ট কম্পিটিশনে পুরষকার আনতেই হবে এ মনোভাব না নিয়ে তাকে প্রতিযেগিতায় অংশগ্রহণের গুরুত্ব বোঝান, পুরস্কারের গুরুত্ব নয়। ব্যর্থতায় তার সমালোচনা করবেন না- বরং সফলতার মত ব্যর্থতাও যে একটা অনুষংগ তা বুঝতে সাহায্য করুন।
- শিশুদের প্রতি ‘হ্যাঁ’ তো বলবেনই কিন্তু কখন কোন পরিস্থিতিতে তাকে কোন কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে সেটা মনে রেখে কখনো ‘না’-ও বলুন।
- কীসে সে খুশি হয়, কীসে দুঃখ পায় বোঝার চেষ্টা করুন ও সেই মত আচরণ করুন।
- তার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে তার নিজের জগৎ গড়ে তুলতে সাহায্য করুন।
- তার ভালো কাজের জন্য তাকে উৎসাহ দিন আর অনাকাক্সিক্ষত আচরণের জন্য শাস্তির বদলে পুরস্কার প্রত্যাহার করুন।
- তার সামনে কোনো অপরাধ করা থেকে বা অপরাধের পক্ষ নেয়া থেকে বিরত থাকুন।
- শিশুর সামনে পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখুন, দাম্পত্য কলহ থেকে বিরত থাকুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।