Miles to go before I sleep.....
তেমন কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। শহীদ মিনারের ছবি দেখলে মনে হচ্ছে সে আজ জীবন্ত। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে অবজ্ঞাভরে। গতরাতেই আমরা এখানে বাংলাদেশী কমিউনিটির লোকজন ছোট আকারে একুশ ফেব্রুয়ারী পালন করলাম। কিছু গান, কিছু কথা আর তুহিনের লিখিত ছোট্ট একটা নাটিকা।
হিল্লোল দাদা, কবির ভাই, নাসিম ভাই দারুন অভিনয় করেছে। তাদেরকে মন থেকে অভিনন্দনও জানালাম। তবে অনুষ্ঠানে বরাবরের মতই আমি গোবেচেরা টাইপ পিছনের দিকে বসে ছিলাম। তবে বরাবরের মতই "আমার ভাইয়ের রক্তে রাংগানো" যখন গাওয়া হচ্ছিল, আমার চোখ ভিজেছিল। কবির ভাই একুশের প্রথম কবিতা আবৃত্তি করেছিল, এবং ভাল হয়েছে আবৃত্তি খুবই।
অনেকদিন সেই বিখ্যাত কবিতাটা পাওয়া যায়নি, প্রথমে অনেকদিন আগে ব্লগে পড়েছিলাম। গতকাল আবার শুনে রক্ত গরম হয়েছিল সাময়িক, তবে একটু পরেই আবার লজ্জায় রক্ত হিমও হয়ে গিয়েছিল। মাথা নত হয়েছিল অবিচারের কান্নায়, আর কোনদিন একুশের গৌরব আমাকে উদ্বেলিত করবেনা। একুশ এখন আর অধিকার আন্দোলনের প্রতীক না, একুশ এখন অধিকার হরণ করার চিহ্নও।
এবার চোখ শুধু সালাম, জব্বার, বরকতের প্রতি শ্রদ্ধায় আর কৃতজ্ঞতায় ভিজেনি।
এবার তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা ছাড়াও আমার চোখে ছিল স্বজাতির প্রতি অভিমান। বুকে ছিল স্বজাতির হিংস্রতার প্রতি ঘৃণা। আর অক্ষমতার বেদনা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের "রেখেছ বাংগালি করে, মানুষ করনি" আরেকবারের মত সত্যি মনে হল। তাই আমি আর একুশের গৌরবের সংগী হবনা কোনদিন।
যে মহান ভাষা কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে আমার পূর্বপুরুষেরা রক্ত দিয়েছিল, সে ভাষাভাষী মানুষ আজ আমার পাহাড়ী ভাইদের প্রার্থনাঘর পুড়িয়ে দেয়। আমার পাহাড়ী ভাইরা আজ অসহায়ভাবে দেখছে তাদেরই ভাই, বোন, বাবারা "সেটলার" দের হাতে মারা পড়তেছে। রাষ্ঠ্রযন্ত্র সবরকম সহায়তা দিচ্ছে "সেটলার"-রা যাতে ঠিকই জিতে যায়। রাষ্ঠ্রযন্ত্র আর রাষ্ঠ্রের মানুষগুলো ভুলে গেছে যে নিজের দেশের মানুষ হত্যা করে পাকিস্তানিদের কি অবস্থা হয়েছিল। আমি বাংলাদেশের মানচিত্রে সেই লাল টকটকে বৃত্তে ঘোরলাগা চোখে হঠাৎ চাঁদ-তারার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি, যে চাঁদ-তারা পতাকা আমার ভাই সালাম-বরকতের বুকে গুলি চালিয়েছিল।
আমি তাই বিচার দিতে এসেছি। কর্পরেট সংস্কৃতি যখন আমার দেশের সবচেয়ে বড় গৌরবগুলোকে একে একে ধর্ষন করে বিকিয়ে দিচ্ছে, একুশে ফেব্রুয়ারী যখন গ্রামীনফোনের কাছে বলাৎকার হচ্ছে আর আমার দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা দাঁত কেলিয়ে হাসছে, তখন আমি বিচারের কান্না নিয়ে হাজির হয়েছি। আমি তাই আমার স্বজাতির প্রত্যেক ভাই-বোনকে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করতে চাই তারা কেন নির্বিকার। আমি শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে চাই আমার স্বজাতির কাছে, আমি আমার প্রশ্নের জবাব চাই, আমি হাহাকার আর চিৎকার মিশ্রিত কন্ঠে প্রশ্ন করতে চাই, "তোমাদের লজ্জা করেনা?" যে একুশকে নিয়ে গর্ব করে মিছিল বের করেছ, সেই একুশেরই দিনেই আমার পাহাড়ী ভাইদেরকে মাটিতে লুঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তোমাদের লজ্জা করেনা? তোমাদের বুকে কি একবারও মনে পড়েনা সালাম-বরকতকে যখন ওরা গুলি করেছিল তখন তাদের কিরকম লেগেছিল?
আমি সালামের মৃত আত্মার কাছেই বিচার চাইব আজ। কারন আমার স্বজাতির জীবিত আত্মারা অন্ধকারে কলুষিত।
আমি সালামের কবরে গিয়ে বিচার চাইব। আমি সালামকে জিজ্ঙেস করব তার লজ্জা করে কিনা। আমি সালামের আত্মাকে দুহাতে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জানতে চাইব এজন্যই সে রক্ত দিয়েছিল কিনা। আমি সালামকে বলব তাদেরকে যখন পাকিস্তানি পুলিশি হামলায় মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে হয়েছিল সেই মৃত্যুর আজ কোন মানে আছে কিনা।
আমি রফিকের কাছে যাব।
তার কবরে দাড়িয়ে আমি জিজ্ঞেস করব সে তার স্বজাতির জিঘাংসাই লজ্জিত কিনা। রফিকের আত্মার কাছে আমি চিৎকার করে প্রশ্ন করব তার বাংলা ভাষাভাষীরা "সেটলার" হোক সেটা সে চেয়েছিল কিনা। আমি রফিকের আত্মাকে তার কবর থেকে নিয়ে আসব। তাকে নিয়ে যাব পার্বত্য চট্টগ্রামে তার স্বজাতির কর্মকান্ড দেখার জন্য। তার বোবা আত্মার মুখে আমি কথা ফুটাব আর জিজ্ঞেস করব কেন তার স্বজাতিরা আজ নির্বিকার।
বরকত-জব্বারকে আমি জিজ্ঞেস করব ভাষা আন্দোলন অধিকার আদায়ের আন্দোলন ছিল নাকি অধিকার হরণ করার? আমি মুক্তাংগনের মূর্তীদের চোখে কাল কাপড় বেঁধে দিব। স্বজাতির বিবেক বিক্রি হয়ে গেছে, তাই মূর্তিগুলোর চোখ খোলা রাখার কোন অধিকার নেই। আমি বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধে যাব, তাদের মৃত আত্মার কাছে আমি জানতে চাইব ১৪ ডিসেম্বরে তাদেরকে যে রাজাকার গংরা হত্যা করেছিল সেই পাপের চেয়ে পাহাড়ী ভাইদের হত্যার পাপ কোন অংশে কম কিনা। আমি তাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করব আমার পাহাড়ী ভাইদের রক্ত কোন অংশে কম পবিত্র কিনা। আমি শহীদ আজাদের মায়ের কাছে যাব।
তাকে জিজ্ঞেস করব তার শহীদ ছেলের রক্তের চেয়ে পাহাড়ী ভাইদের রক্ত কোন অংশে কম লাল কিনা।
আমি আজ শহীদ মিনারে যাব শ্রদ্ধা-অবনত দৃষ্টিতে নয়। আমি শহীদ মিনারে যাব চোখে আগুন নিয়ে। আমি বোবা শহীদ মিনারকে কথা বলার জন্য বলব। শহীদ মিনারকে আমি জিজ্ঞেস করব তার মাথা কি আজ লজ্জায় অবনত হয়েছে? আমি তাকে জিজ্ঞেস করব তার মাঝখানে যে লাল টকটকে রক্তের গোলবৃত্ত সেটা কি শুধু সালাম-বরকতের রক্তকেই প্রতিনিধিত্ব করে, নাকি আমার পাহাড়ী ভাইদের রক্তও সমান দামী? আমি শহীদ মিনারের কাছে জানতে চাইব কতজন চলেশ রিচিলকে স্বজাতির হাতে বলি হতে হবে?
আমি রাতের অন্ধকারে কান ফাটানো আওয়াজে চিৎকার করব সারা বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায়।
আমি জিজ্ঞেস করব তাদের কি হয়েছে? তারা কেন এরকম হয়ে গেল? তাদের কেন কোন বিকার নেই? তাদেরকে জিজ্ঞেস করব তাদের আরামে ঘুমাতে লজ্জা লাগছেনা কেন যখন আমার পাহাড়ী ভাইদের ঘুম কেড়ে নেওয়া হচ্ছে? আমি তাদের ছোট বাচ্চার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকাতে বলব আর জিজ্ঞেস করব আমার পাহাড়ী ভাইদের নিষ্পাপ বাচ্চারা তাদের বাবাকে যখন হারাচ্ছে তাদের লজ্জা লাগছে কিনা।
আমি জানি আমার এ আর্তচিৎকারে কারও ঘুম ভাংবেনা। আমার পাহাড়ী ভাইদের মৃত্যুর বিরুদ্ধে কেউ মিছিল বের করবেনা ঢাকার রাস্তায়। আমি জানি আবার আমরা একুশে ফেব্রুয়ারী আসলে সেখানে পাহাড়ী ভাইদের মৃত্যুর কথা কেউ বলবনা। কোন মানবাধিকার সংস্থা মানব-বন্ধন করবেনা।
কোন বুদ্ধিজীবি বিবৃতি দিবেনা। কোন ছাত্রসংঘটন বিচার চাইবেনা। কোন লেখক পত্রিকায় কলাম লিখে এই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বন্ধ করার আহ্বান জানাবেনা। আমি জানি আমরা কয়দিন পরই ভুলে যাব এসব। রাতে সুস্বাদু খাবার খেয়ে হিন্দি সিনেমা নিয়ে বসে যাব আর আরামের ঢেকুড় তুলব।
তবে পাহাড়ী ভাইদের বুকের দগদগে ঘা ঠিকই থেকে যাবে। তাদের এতিম বাচ্চাদের নিবৃতে কান্না পাহাড়ের দেয়াল বেয়ে আমাদের সভ্যজগতে পৌঁছাবেনা। আমি জানি যে দেশে জাতির জনকের হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয় সেখানে চলেশ রিচিলের কথা কেউ মনে রাখবেনা।
তাই আমি আমার স্বজাতির কাছে বিচার চাইবনা। আমি সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের মৃত আত্মার কাছেই বিচার চাইব।
আমি আমার সৃষ্টিকর্তার কাছেই বিচার চাইব। আমি সৃষ্টিকর্তাকে জিজ্ঞেস করব তার আরশ কেঁপে উঠে কিনা। আর স্বজাতির জন্য আমি একদলা থুথু ছিটিয়ে দিলাম। আমি যদি পারতাম তাহলে বাংলাদেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে গিয়ে প্রত্যেক মানুষের মুখে থুথু ছিটিয়ে আসতাম।
খোদার কসম, এ জাতির কোনদিন উন্নতি হবেনা যতদিন এ জাতি ন্যায়বিচার না শিখে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।