(ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুরের এ লেখাটি ১৯৪৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর (২৩শে অগ্রাহায়ণ ১৩৫৬ বাংলা) ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ এর ২য় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। লেখাটির শেষের কিছু অংশ পাওয়া যায় নি। )
পূর্ব পাকিস্তানের তমদ্দুনের গলা টিপিয়া মারিবার জন্য এক শয়তানী চক্রান্ত শুরু হইয়াছে। বাজারে জোর গুজব, ঢাকাতে আগামী ১৪ই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের যে সভা বসিবে তার একটি প্রস্তাবে বাংলা ভাষার আরবী হরফ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে। গুজবটি সত্য হইলে, কর্তৃপক্ষকে হুঁশিয়ার করিয়া দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলিয়া আমরা মনে করি।
বাংলা ভাষার জন্য আরবী হরফ গ্রহণ যে কতটা অবৈজ্ঞানিক ও জাতীয় জীবনের পক্ষে কতটা মারাত্মক হইবে, তাহা লইয়া দেশের হিতকামী শিক্ষাবিদ ও ভাষাবিদ সৈনিকে ও অন্যান্য পত্রিকায় ঢের আলোচনা করিয়াছেন। এ সম্বন্ধে পুনরায় আলোচনা করা নিস্প্রয়োজন। দেশের সকল দূর-দৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষাবিদই এক বাক্যে স্বীকার করিয়াছেনঃ আরবী হরফ গ্রহণ করিলে পূর্ব পাকিস্তানের তমদ্দুনকে গলা টিপিয়া মারা হইবে, তার প্রগতি ব্যাহত হইবে।
তবুও যে সব অকালকুম্মান্ড “দেশপ্রেমিক” আরবী হরফের পোশাক পরাইয়া উহাকে জাতে তুলিবার জিগির তুলিয়াছেন, তাদের প্রধান যুক্তি হইল এইঃ পাকিস্তানের অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষাগুলো এবং মুসলিম দেশগুলোর অধিকাংশ ভাষাই আরবী হরফে লিখিত হয়। অতএব বাংলাকেও ·············।
বাংলা ভাষায় ইসলামী আদর্শ প্রচারের জন্য ইহাই না কি একমাত্র পন্থা। অকাট্য যুক্তিই বটে! এতদিন আমরা জানিতাম, কোনো আদর্শ প্রচারের জন্য প্রগতিশীল রাষ্ট্রবিদগণ সাধারণতঃ ভাষার সহজতম রূপটিই বাছিয়া নেন, কারণ জনগণের মনে প্রভাব বিস্তার করতে “জনগণের ভাষা”ই সবচেয়ে বেশী ফলদায়ক। অতএব অপরিচিত আরবী হরফের বেড়াজালে বাংলাকে আবদ্ধ রাখিয়া পূর্ব পাকিস্তানের তামদ্দুনিক প্রগতিকেই ব্যাহত করা হইবে। ইহা দেশদ্রোহিতা তথা রাষ্ট্রদ্রোহিতারই শামিল।
এখানে স্বভাবতই একটা প্রশ্ন জাগেঃ দেশে তথাকথিত “ইসলাম প্রেমিক দল” কি করিয়া এমন মারাত্মক কাজে কোমর বাঁধিতে পারিলেন? কি করিয়া ইহা তাঁহাদের পক্ষে সম্ভব হইল? ······· সম্ভব হইয়াছে, তাহার কারণ আছে।
ইসলামের মর্মকথাকে পদাঘাত করিয়া যাহারা খোলশ লইয়া টানাটানিতে ব্যস্ত, তাহাদের পক্ষে ইহাই সম্ভব, স্বাভাবিক। দুই বছরেরও বেশী হয়, পাকিস্তান কায়েম হইয়াছে, ইহার মধ্যে নেতারা পূর্ব ওয়াদা মাফিক ইসলামী সাম্যবাদের আদর্শ যে কতটুকু কার্য্যকরী করিয়াছেন, তাহা কাহারও অজানা নাই। তাছাড়া শোষণের-তো সীমাই নাই। ইসলামের বিপ্লবী আদর্শ প্রচারের “অপরাধে” গত আজাদী দিবসে চাটগাঁ ও ঢাকায় তমদ্দুন মজলিস কর্মীদের গ্রেফতার করা হইয়াছিল, তাহা দেশবাসী ভুলিয়া যায় নাই। এই সেদিনও পাকিস্তানের সেরা সৈনিক ভাসানীর মওলানাকে সম্পূর্ণ অকারণে গ্রেফতার করা হইল।
তাঁরও “অপরাধ” ছিল এই যেঃ পাকিস্তানে খাঁটি ইসলামী গণরাষ্ট্র কায়েমের দাবী তিনি তুলিয়াছিলেন। এইসব ঘটনা হইতে শুধু ইহাই প্রমাণ হয় যে, ইসলামকে গলা টিপিয়া মারিয়া, ইসলামের মর্মকথাতে পদাঘাত করিয়া ············ কায়েমী স্বার্থবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের গদি রক্ষা করিবার জন্য ইসলামের নাম ব্যবহার করাই ইহাদের একমাত্র পেশা। এই জন্যই এই স্বার্থান্ধরা বরাবর ধর্মের খোলশ লইয়া ইসলামের নামে জনগণকে মোহাচ্ছন্ন করিবার প্রয়াস পাইতেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।