আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..
মাহবুবুর শাহরিয়ারের বইয়ের কাহিনী বহির্ভূত বিষয় আমাকে বরাবরই টানে। যেমন, গত মেলায় প্রকাশিত 'মহাপৃথিবী' উপন্যাসের উৎসর্গপত্রটি দারুণ লেগেছিল। তাই এবছর বই হাতে নিয়ে সবার আগে উৎসর্গপত্রে নজর দিয়েছিলাম। এবার অবশ্য আলাদা কিছু পেলাম না, তবে ভূমিকা অংশে ভাল লাগার উপকরণ পেলাম লেখকের সোজাসাপ্টা জবানবন্দিতে। কৃত্রিমতা, ন্যাকামি কিংবা অহেতুক ঢঙ একদমই সহ্য করতে পারিনা।
তাই লেখকের শুরুর বিবৃতিটা আমাকে মুগ্ধ করেছে: "প্রথমবার লেখার পর গল্পটা আমার নিজেরই পছন্দ হচ্ছিলনা। তারপর অনেকবার অনেক কাটাকাটি, ঘষামাজার পর অবশেষে একটা সন্তোষজনক অবস্থায় পৌছালো। গল্পটা নিয়ে আমি নিজে মোটামুটি সন্তুষ্ট। এ কথা বলার অর্থ হয়না যে পাঠকের ভাল লাগলে লেখা সার্থক হবে। নিজের আনন্দের জন্য লিখি, তাই পাঠকের ভাল লাগা না লাগার সার্থকতা বা ব্যর্থতার সম্পর্ক দেখিনা'।
লেখকের লেখা পড়তে গিয়ে তার মনস্তাত্ত্বিক ভাবনাটাও পড়ার চেষ্টা করি। তাই উপন্যাসটার নাম এবং লেখকের আরও কয়েকটা লেখা পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করছিলাম এটা বোধহয় বাস্তব-পরাবাস্তবের মধ্যবর্তী 'নো ম্যানস ল্যান্ড' একটা কিছু হবে। আগেও দেখেছি, লেখকের একটু অতিপ্রাকৃতিকতার দিকে পক্ষপাত আছে। নৈর্ব্যক্তিক ভাবনা ভাবার প্রবণতা আছে, যেটা হয়ত কম-বেশি সবার চিন্তার গভীরেই থাকে, কিন্তু তিনি সেটাকে অবলম্বন করে কাহিনীর বুনন ঘটান, এটাই মূল পার্থক্য। যাহোক, বইয়ের ফ্ল্যাপ পড়ে আমার এই বিশ্বাসটাই জোরালো হচ্ছিল।
ফ্ল্যাপের কিছু অংশ তুলে দেয়া যেতে পারে : 'আকাশ থেকে মুঠো মুঠো ঝরে পরে জ্যোৎস্নার বৃষ্টি। পরী রাজকুমারী দু]হাত বাড়িয়ে জ্যোৎস্নার বৃষ্টি গায়ে মেখে নেয়। ........জ্যোৎস্না আর পানিতে মিলে মিশে যায়। এরকম সময়ে কি কাহিনী লেখা হয় পৃথিবীর পথে?'
সন্দেহ নেই, ফ্ল্যাপ হিসেবে চলনসই। তবে কেউ যদি ফ্ল্যাপ দেখে গল্প বুঝতে চান , তাদের জন্য এটা একটা মুলো ছাড়া কিছুই হবেনা।
কারণ ফ্ল্যাপটা গল্পের সম্পর্কে কোন ধারণাই দিচ্ছেনা, দিলেও ভূলভাবে অনূদিত হবে। তাই ফ্ল্যাপ পড়ে বুঝবার উপায় নেই গল্পের মূখ্য চরিত্র হাসান, যুথী, আর সহযোগী চরিত্র লাবলুদা, মহিন, গায়ক সুমনরা কখন কিভাবে গল্পে আসবে, আবার হারিয়ে যাবে।
উপন্যাসে কোন অতিমানবীয়, মর্মস্পর্শী কিঙবা অভিনব গল্প বলতে চাওয়া হয়নি। মহাজীবনের বিশাল ক্যানভাসে যে অসঙখ্য খন্ড খণ্ড অণুজীবন থাকে, তারই কয়েকটাকে আকার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই অনুজীবনে হাসান এক ত্রিশ পেরুনো তরুণ, যে মনে করল অন্য অনেক কিছুর মত জীবনে বিয়েটাও একবার করে দেখা উচিৎ।
কনে তার অপরিচিত নয়, একই মহল্লায় হওয়ার সুবাদে অনেক আগে থেকেই তাকে দেখেছে, হয়তবা টুকটাক দূর্বলতাও ছিল ভাবীবধুর প্রতি, তবে সে নিজে নিশ্চিত ছিল মেয়েটা তাকে গ্রাহ্যই করতনা। সেই মেয়ে নিজেই বিয়েতে মত দিয়েছে এটা শুনে সে অবাকই হয়েছিল। তার ভাবী বুধূটিই যুথী।
মহিন যুথীর ভাই, লাবলুদা মহল্লার বড়ভাই, সুমন ঐ মহল্লারই উঠতি ব্যান্ডগায়ক....একটা চিরায়ত মহল্লার ছবি এখানেই দেখতে পাই। এরপর উপন্যাসের গল্পটা অনেকক্ষণ ধরেই নাই হয়ে যায়, গল্পের স্থলে ঢুকে পড়ে অহেতুক নিম্নমানের রসিকতা।
কখনো কখনো রসিকতাগুলো পড়তে পড়তে ক্লান্তি চলে আসে, কিন্তু রসিকতার ভীড়েও হাসান-যুথী রয়ে যায়, ফলে গল্প হারিয়ে গেলেও পাঠক হারিয়ে যায়না। সাধারণ জীবনের কাহিনী এগুতে থাকে।
এই উপন্যাসের মূল থিমটা বুঝতে আমরা যুথীর কথাটা বিবেচনা করতে পারি : বড় বড় মানুষদের স্বপ্ন, কাজ সবই বড়। কিন্তু আমরা তো খুব সাধারণ মানুষম খুব বড় তো কিছু আমরা নই। অনেক বড় কোন ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটেনা।
স্মরণীয় সুহূর্ত খুব বেশি আসেনা আমাদের জীবনে। আমাদের নিয়ে কোন ইতিহাস লেখা হয়নাম কোন কাব্য লেখা হয়না, কোন গান বাথা হয়না আমাদের নিয়ে। ইতিহাসের কোথাও আমরা থাকিনা। আমরা খুব সহজেই হারিয়ে যাই।
এই অনুচ্ছেদটাকে চ্যালেঞ্জ করেই গল্পটা এগিযেছে।
এখানে গল্পটা একটা দ্বিমাত্রিক গতিতে ছুটেছে। একমাত্রায় আমরা হাসানদের দেখি, অন্যমাত্রায় বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা দীঘি, জ্যোৎম্না, পরী রাজকন্যা এদের দেখি। কিন্তু এই মাত্র্রাটা এসেছে, আবার হারিয়েও গেছে, সম্ভবত এই মাত্রাটা নিয়ে লেখকের কোন পরিকল্পনা ছিলনা, তিনি গল্পের চলার পথটাকে মসৃণ করতে একে শুধু একটা বৈচিত্র আনার কৌশল হিসেবে রেখে দিয়েছেন। কৌশলের জন্য সাধুবাদ। কিন্তু গল্পের যে চলার পথকে মসৃণ করতে এতকিছু করা, সেই পথটাকেই আমার এবড়ো-থেবড়ো মনে হয়েছে।
সেরকম কিছু এবড়ো-থেবড়োতার দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে :
# গল্পের শুরুতে হাসান তার অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী বন্ধু রুমেলকে মেইল করছে। মেইলের দৈর্ঘ্য হিসেবে ৪ পুষ্ঠা একটু বেশীই দীর্ঘ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে পরিমিতবোধটা এখানেই একটা ফ্যাক্টর হয়ে উঠে। গাছের চেয়ে আগাছাকে প্রাধান্য দিলে আখেরে কোন ফলই হয়না।
# আগেও নিম্নমানের রসিকতা প্রসঙ্গে বলেছি।
এই রসিকতাগুলো গল্পকেই গ্রাস করে ফেলেছে। কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে : 'বিয়ের প্রথম রাতে বিড়াল মারতে হবে' এই পুরনো চটুল মীথটাই সারাগল্পে ঘুরেছে। হাসান তার হবু শ্যালক মাহীনের কাছে বিড়ালের খোজ করছে। মাহীন বলছে, সে পিশাচ সাধনা করবে নাকি বিড়াল দিয়ে। এরপর বিড়াল খুজতে লাবলুদার বাড়ি যাওয়া।
সেখানে গিয়ে বিড়াল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আরও অপ্রাসঙ্গিক রসিকতা চলে আসা। যেমন 'পান থেকে চুন খসা' কথাটা বলতে বোঝায় তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাতামাতি করা। কিন্তু গল্পে এই কথাটাকেই সিরিয়াসলি ধরে নিয়ে কথা চলে অনেকক্ষণ- পান খান কেন, চুন ঠিকমত লাগাতে পারেননা কেন, এইসব দীর্ঘ প্যানপ্যানানিই বলব। ছড়ি ঘুড়ানো, গায়ে হলুদের বদলে গায়ে মরিচ....এইসব রসিকতাগুলো হুমায়ূন আহমেদের নাটকে দেখতে দেখতে । নেক আগেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছি আমরা।
তাই এতদিন পরে এইসব ব্যাপার-স্যাপার পড়ার সময়ও ঘুম চলে আসতে পারে।
এছাড়া মাহীন যুথীকে এসে বলছে হাসান ভাই তোর বিয়েতে বিড়াল কুরবান করবে। এ কথা শুনে সবাই ভাবছে, হাসানরা খরচ বাচাতে বিড়াল কুরবানী দেবে, বিড়ালের মাঙস হালাল নাকি হারাম, এইসব প্যানপ্যানানি চলে অনেকক্ষণ। প্যানপ্যানানি শব্দটা শুনতে ভাল নয়, কিন্তু তবুও এতবার লেখার কারণ বিড়ালটা মিউমিউ করতে করতে পাঠকের মনোযোগ নষ্ট করেছে অনেক জায়গায়। যেমন, লাবলুদা তার বন্ধুদের নিয়ে চিড়িয়াখানায যায় বিড়াল খুঁজতে, বিড়াল মারা দিবসের ইঙরেজি কী হবে এই নিয়ে দীর্ঘ প্যাচাল, এবঙ গায়ক সুমনের বিড়াল মারা নিয়ে দীর্ঘ গান...এই বিষয়গুলো ভাল লাগবার মত নয় কিছুতেই।
এত দির্ঘ গান পুরোটা লিখে দেয়া সম্ভব নয়; কয়েক লাইন লিখে দিচ্ছি:
'মারো বিড়াল মারো
পয়লা রাতে তুমি বিড়াল মারো
মারো বিড়াল মারো
পয়লা রাতে মারো
.....
অন্যরাতে বিড়াল মেরে লাভ নেই
পয়লা রাতে বিড়াল মারা চাই
প্রথম বাসরে তোমার হাত দিয়ে তাই
বিড়াল মেরে করো ফর্দাফাই
.......
মোট ২৭ লাইনের গান। বিড়াল নিয়ে আরও প্রহসন আছে : বাসর ঘর থেকে হাসানকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খোলামাঠে। সেখানে অনেকগুলো বিড়াল জমা করা হয়েছে। তার হাতে লাঠি দেয়া হয়েছে, সে বিড়াল মারতে ছুটছে। সুমন বিড়ালমারা গান গাইছে, লাবলুদারা বাদ্যের তালে তালে হাটছে।
এইসব দৃশ্যচিত্রের পেছনে কী বার্তা আছে তা বোধগম্য নয়, তবে যেটা বোধগম্য তা হল, সম্ভবত পুরো বইটাতেই চটুল হাসি-তামাশার ছলে গভীর একটা জীবনবোধ বোঝানোর প্রায়াস ছিল। কিন্তু তামাশা আর চটুলতার বাড়াবাড়ি বৃদ্ধিতে বোধের গভীরতা হাটুজলের সমান হয়ে গেছে ক্ষেত্রবিশেষে।
তবে লেখকের জবানবন্দিটাকে ভিত্তি ধরেই বলবো, অন্তত একটা শ্রেণীর পাছকের কাছে তিনি পৌছাতে পেরেছেন। যেমন, রিভিউ লিখতে পিসির সামনে বসে আর বইটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, ভাবলাম পরে লিখবো। এসময় আমার জুনিয়র রুমমেটকে দেখলাম একটা বই পড়ে প্রচণ্ড হাসছে।
বইয়ের নাম জিজ্ঞেস করতেই ও বইটা দেখাল- রূপালী রাত। ওকে বললাম, ভাই বইটা কিছুক্ষণ পরে পড়, একটা রিভিউ লিখে নিই।
পাঠকের বিভাজন করছিনা, রসবোধ নিয়েও প্রশ্ন তুলছিন। প্রতিটি মানুষেরই প্রতিটি ঘটনা দেখবার ও বঝবার ক্ষেত্রে আলাদা চোখ ও বোধ থাকে। সেই বোধ-চোখকে মাপবার মত চোখ বা বোধ কোথাও নেই।
উপন্যাসের প্লট হিসেবে কিছু মধ্যবিত্ত সাধারণ জীবন বেছে নেয়াটা ঠিকই আছে। জীবনের প্রবাহমানতায় ছোটখাট অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্র চলে আসাটাও গল্পে টুইস্ট এনেছে ক্ষেত্রবিশেষে। যেমন, হাসান মফঃস্বল শহরের যে বাসায় ভাড়া থাকে, সেই বাড়িওয়ালার বাবাকে রাতের বেলা দেখে ভুত মনে করার বর্ণনাটা যেভাবে রহস্য করে দেয়া হয়েছে, তা বেশ আগ্রহ জাগায়। কিন্তু যখন থেকে 'বিড়াল মারা তত্ত্ব' ঢুকে পড়েছে তখন থেকেই গল্প বিড়ালের মিউমিউ ডাকের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। তাই রূপালী রাত হাসান , যুথী কিঙবা পরী রাজকন্যার কথা বলতে চেয়েও বিড়ালের মিউমিউ ডাকে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেই যেন কান চেপে ধরেছে।
জানিনা এই রাত রূপালী, নাকি বিড়ালী। । ।
..................
মাহবুবুর শাহরিয়ার নিজেও একজন ব্লগার
ব্লগে তার নিক রোডায়া
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।