আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ড.আহমদ শরীফ: প্রথাবিরোধী বিদ্রোহী ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার নক্ষত্র

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

ড.আহমদ শরীফ। একটি নাম। একজন মানুষের নাম। সাহসী মানুষের নাম।

যে নামের সাথে দ্রোহ ও প্রথাবিরোধিতা অপরিহায্য উপাদান হিসেবে জড়িত। সমাজের সকল রকম অসঙ্গতি, অন্যায়-অনাচার-বৈষম্য, ধর্মান্ধতা-মতান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ-নিপীড়ন-দুঃশাসন এবং বিদেশী খবরদারী ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে প্রতিবাদ ও দ্রোহের প্রতীক ছিলেন তিনি। জ্ঞানের গভীরতায়, মৌলিক চিন্তায়, মুক্তবুদ্ধির চর্চায় এবং সর্বোপরি মানবতাবাদ প্রচারে নিষ্ঠাবান শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড.আহমদ শরীফ অনন্য উদাহরণ। তিনি ছিলেন ‘সাংস্কৃতিক জগতের মাওলানা ভাসানী’, ‘রেনেসাসের প্রতিনিধি’ অন্যদিকে বুদ্ধিজীবিদের বর্ণানায় বিতির্কত আর প্রতিক্রিয়াশীল মোল্লাদের কাছে ‘মুরতাদ’( ২১ অক্টোবর ১৯৯২সালে তিনি স্বদেশ চিন্তা সংঘের সেমিনারে ‘ইসলাম ও মুসলমান’ সম্পর্কে মত প্রকাশ করেন। এ জন্য তিনি মোল্লাদের দ্বারা মুরতাদ আখ্যায়িত হন, (দেখুন ইনকিলাব ২৪ অক্টোবর ১৯৯২)।

তাঁর জন্ম ১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী। চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার সূচক্রদণ্ডী গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আব্দুল আজিজ। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের প্রধানতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট স্কুলের একজন করনিক। মাতার নাম মিরাজ খাতুন।

পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ করে তিনি চট্টগ্রামের পটিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কিংবদন্তি আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ ছিলেন তাঁর চাচা। জন্মের পর হতে আহমদ শরীফ সাহিত্যবিশারদ ও তাঁর স্ত্রীর কাছে মানুষ হয়েছেন। মূলত এ কারণে অনেকেই আহমদ শরীফকে সাহিত্য বিশারদের সন্তান হিসেবে মনে করতেন।

১৯৩৮ সালে তিনি পটিয়া হাইস্কুল হতে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। এই কলেজ থেকে ১৯৪০ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪২ সালে কৃতত্বের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিভাগে।

১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ২য় বিভাগে ৪র্থ স্থান অধিকার করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে সৈয়দ সুলতান তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৪৪ সালে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। গ্রিভেন্সিভ অফিসার হিসেবে দুর্নীতি দমন বিভাগে চাকরি নেন। কিন্তু নীতি ও আদর্শের কারণে সেই চাকরি বেশিদিন করতে পারেননি।

তিনি ১৯৪৫-৪৮ সাল পর্যন্ত লাকসামের পশ্চিম গাঁও নওয়ার ফয়জুন্নেসা কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৭ সালের ৭ নভেম্বর সালেহা মাহমুদের সঙ্গে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৪৮-৪৯ সালের জুন পর্যন্ত তিনি ফেনী ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রিসার্চ অ্যাসিটেন্ট হিসেবে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর চাকরির শর্ত ছিল, তিনি আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের বিশাল পুঁথির সম্ভার বিনা অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দিবেন এবং তার বিনিময়ে ওই পুঁথি দেখভালের জন্য তাকে নিয়োগ করা হবে।

এই শর্তের সূত্রেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির ছাড়পত্র লাভ করেন। ১৯৫২-৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে বাংলা বিভাগের অস্থায়ী লেকচারার হিসেবে যুক্ত থাকেন। ১৯৫৭ সালে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৬২ সাল হতে তিনি সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালীন অধ্যাপকও ছিলেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিভাগের পাশাপাশি অধ্যাপনায় যোগ দেন।

১৯৬৯ সালে তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৮৩ সালের ৩১ অক্টোবর অবসরে যান। চাকরি জীবনে তিনি একাধিকবার আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন নির্বাচিত হয়েছিলে। ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারী তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ‘নজরুল অধ্যাপক পদে’ যোগ দেন। ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তিনি ওই পদে কর্মরত ছিলেন।

আহমদ শরীফের মানস চেতনা তৈরী হয়েছিল আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের দুর্লভ অমূল্য পুঁথির ভাণ্ডার ও সাময়িক পত্রপত্রিকার সম্ভারের মধ্যে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় তিনি ব্যয় করেছেন মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য। যা ইতিহাসের এক অন্যতম দলিল। বিশ্লেষণাত্মক তথ্য, তত্ত্ব ও যুক্তিসমৃদ্ধ দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের সমাজে ও সংস্কৃতির ইতিহাস বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে দিয়ে গেছেন যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর গাঁথা হয়ে থাকবে। তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক।

তাঁর প্রথম সম্পাদিত গ্রন্থ ‘লায়লী মজনু’, ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৯ সালে তিনি তাঁর মৌলিক গ্রন্থ ‘বিচিত চিন্তা’ প্রকাশ করেন। তাঁর কয়েকটি উল্লেখেযোগ্য গ্রন্থ হলোঃ স্বদেশ অন্বেষা, মধ্যযুগের সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, বাংলার সুফি সাহিত্য, বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা, বাংলার বিপ্লবী পটভূমি, এ শতকে আমাদের জীবনধারার রূপ রেখা, নির্বাচিত প্রবন্ধ, প্রত্যয় ও প্রত্যাশা এবং বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য (দুই খণ্ড)। মানবতাবাদ ও মাকর্সবাদের যৌগিক সমন্বয় প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণে এবং বক্তব্য ও লেখনীতে। তাঁর রচিত একশতের অধিক গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহে তিনি অত্যন্ত জোরালো যুক্তি দিয়ে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, বিশ্বাস ও কুসংস্কার পরিত্যাগ করেছিলেন।

পঞ্চাশ দশক হতে নব্বই দশকের শেষবধি সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন ও ইতিহাসসহ প্রায় সব বিষয়ে তিনি অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আন্তরিকভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেছেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। দ্রোহী সমাজ পরিবর্তনকারীদের কাছে আজো তার পুস্তকরাশির জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। উপমহাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অসামান্য পণ্ডিত, বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক যুক্তিবাদী, দার্শনিক, বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, মুক্তবুদ্ধির ও নির্মোহ চিন্তার এক অনন্য ধারক ছিলেন ড. আহমদ শরীফ। কুসংস্কার, ক্ষুধা, রোগ শোকে জর্জরিত, ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন অবহেলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দ্রোহী পুরুষ ড. আহমদ শরীফকে ধর্মান্ধরা শাস্ত্র ও প্রথা বিরোধিতার কারণে মুরতাদ ঘোষণা করেছিল।

১৯৯৫ সালে তিনি মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান করার কথা লিপিবদ্ধ করে রেখে যান। তাঁর স্মরণে ডঃ আহমদ শরীফ স্মৃতি পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রতি বছর এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনি ১৯৯৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।