মনের জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবনাগুলোর মিলিয়ে যাওয়া দেখি। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ হয়ে, ঐ দূর দিগন্ত পানে...
(আগের পর্ব)
পাঁচ
***
লাজ রক্ত হইল কন্যার পরথম যৈবন
- ময়মনসিংহ গীতিকা
আশ্বিনেতে ঝড় হাঁকিল, বাও ডাকিল জোরে,
গ্রামভরা-ভর ছুটল ঝাপট লট্পটা সব করে।
রূপ বাড়ির রুশাই-ঘরের ছুটল ছানি,
গোয়াল ঘরের খাম* থুয়ে তার চাল যে নিল টানি।
*খাম - থাম
ওগাঁর বাঁশ দশটা টাকায়, সে গাঁয় টাকায় তেরো,
মধ্যে আছে জলীয় বিল কিইবা তাহে গেরো।
বাঁশ কাটিতে চল্ল রূপাই কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া,
দুপুর বেলায় খায় যেন সে - মায় দিয়াছে কিরা।
মাজায় গোঁজা রাম-কাটারী চক্চকাচক্ ধার,
কাঁধে রঙিন গামছাখানি দুলছে যেন হার।
মোল্লা-বাড়ির বাঁশ ভাল, তার ফাঁপগুলি নয় বড়;
খাঁ-বাড়ির বাঁশ ঢোলা, করছে কড়মড়।
সর্বশেষে পছন্দ হয় শেখের বাড়ির বাঁশ;
ফাঁপগুলি তার কাঠের মত, চোকন-চোকন আঁশ।
বাঁশ কাটিতে যেয়ে রূপাই মারল বাঁশে দা,
তল দিয়ে যায় কাদের মেয়ে - হলদে পাখির ছা!
বাঁশ কাটিতে বাঁশের আগায় লাগল বাঁশের বাড়ি,
চাষী মেয়ের রুপ দেখে তার প্রাণ বুঝি যায় ছাড়ি।
লম্বা বাঁশের লম্বা যে ফাঁপ, আগায় বসে টিয়া,
চাষীদের ওই সোনার মেয়ে কে করিবে বিয়া।
বাঁশ কাটিতে এসে রূপাই কাটল বুকের চাম,
বাঁশের গায়ে বসে রূপাই ভুল্ল নিজের কাম।
ওই মেয়ে ত তাদের গাঁয়ে বদনা-বিয়ের গানে,
নিয়েছিল প্রাণ কেড়ে তার চিকন সুরের দানে।
"খড়ি কুড়াও সোনার মেয়ে! শুক্নো গাছের ডাল,
শুক্নো আমার প্রাণ নিয়ে যাও, দিও আখার জ্বাল।
শুক্নো খড়ি কুড়াও মেয়ে! কোমল হাতে লাগে,
তোমায় যারা পাঠায় বনে বোঝেনি কেন আগে?"
এমনিতর কত কথাই উঠে রূপার মনে,
লজ্জাতে সে হয় যে রঙিন পাছে বা কেউ শোনে।
মেয়েটিও ডাগর চোখে চেয়ে তাহার পানে,
কি কথা সে ভাবল মনে সেই জানে তার মানে!
এমন সময় পিছন হতে তাহার মায়ে ডাকে,
"ওলো সাজু! আয় দেখি তোর নথ বেঁধে দেই নাকে।
ওমা! ও কে বেগান মানুষ বাঁশের ঝাড়ে!"
মাথায় দিয়ে ঘোমটা টানি দেখছে বারে বারে।
খানিক পরে ঘোমটা খুলে হাসিয়া এক গাল,
বলল, "ও কে, রূপাই নাকি? বাঁচবি বহু কাল।
আমি যে তোর হইরে খালা, জানিসনে তুই বুঝি?
মোল্লা-বাড়ির বড়ুরে তোর মার কাছে নিস্ খুঁজি।
তোর মা আমার খেলার দোসর - যাক্গে ওসব কথা,
এই দুপুরে বাঁশ কাটিয়া খাবি এখন কোথা?"
রূপাই বলে, "মা দিয়েছেন কোঁচায় বেঁধে চিড়া"
"ওমা! ও তুই বলিস কিরে? মুখখানা তোর ফিরা।
আমি হেথা থাকতে খালা, তুই থাকবি ভুখে,
শুনলে পরে তোর মা মোরে দুষবে কত রুখে।
ও সাজু, তুই বড় মোরগ ধরগে যেয়ে বাড়ি,
ওই গাঁ হতে আমি এদিক দুধ আনি এক হাঁড়ি। "
চল্ল সাজু বাড়ির দিকে, মা গেল ওই পাড়া।
বাঁশ কাটিতে রূপাই এদিক মারল বাঁশে নাড়া।
বাঁশ কাটিতে রূপার বুকে ফেটে বেরোয় গান,
নলী বাঁশের বাঁশীতে কে মারছে যেন টান!
বেছে বেছে কাটল রূপাই ওড়া-বাঁশের গোড়া,
তল্লা-বাঁশের কাটল আগা, কালধোয়ানির জোড়া
বাল্কে কাটে আল্কে কাটে কঞ্চি কাটে শত,
ওদিক বসে রূপার খালা রান্ধে মনের মত।
সাজু ডাকে তলা থেকে, "রুপা-ভাইগো এসো"
-এই কথাটি বলতে তাহার লজ্জারো নাই শেষও!
কাজের ভারে হয়তো মেয়ে যেতেই পারে পড়ে,
রূপাই ভাবে হাত দুখানি হঠাৎ যেয়ে ধরে।
যাহোক রূপাই বাঁশ কাটিয়া এল খালার বাড়ি,
বসতে তারে দিলেন খালা শীতল পাটি পাড়ি।
বদনা ভরা জল দিয়ে আর খড়ম দিল মেলে,
পাও দুখানি ধুয়ে রূপাই বসল বামে হেলে
খেতে খেতে রূপাই কেবল খালার তারিফ করে,
"অনেক দিনই এমন ছালুন খাইনি কারো ঘরে। '
খালায় বলে "আমি ত নয় রেঁধেছে তোর বোনে,
লাজে সাজুর ইচ্ছা করে লুকায় আঁচল-কোণে।
এমনি নানা কথায় রূপার আহার হল সারা,
সন্ধ্যা বেলায় চল্ল ঘরে মাথায় বাঁশের ভারা।
খালার বাড়ির এত খাওয়া, তবুও তার মুখ,
দেখলে মনে হয় যে সেথা অনেক লেখা দুখ।
ঘরে যখন ফিরল রুপা লাগল তাহার মনে,
কি যেন তার হয়েছে আজ বাঁশ কাটিতে বনে।
মা বলিল, "বাছারে, কেন মলিন মুখে চাও?"
রূপাই কহে, "বাঁশ কাটিতে হারিয়ে এলেম দাও"
ছয়
***
ও তুই ঘরে রইতে দিলি না আমারে
- রাখালী গান
ঘরেতে রূপার মন টেকে না যে, তরলা বাঁশীর পারা,
কোন্ বাতাসেতে ভেসে যেতে চায় হইয়া আপন হারা।
কে যেন তাহার মনের তরীরে ভাটির করুণ তানে,
ভাটিয়াল সোঁতে ভাসাইয়া নেয় কোন্ সে ভাটার পানে।
সেই চিরকেলে গান আজও গাহে, সুরখানি তার ধরি,
বিগানা গাঁইয়ের বিরহিয়া মেয়ে বেয়ে আসে যেন তরী!
আপনার গানে আপনার প্রাণ ছিঁড়িয়া যাইতে চায়,
তবু সেই ব্যথা ভাল লাগে যেন, একই গান পুনঃ গায়।
খেত-খামারে মন বসেনাকো; কাজে কামে নাহি ছিরি,
মনের তাহার কি যে হল আজ ভাবে তাই ফিরি ফিরি।
গানের আসরে যায় না রূপাই সাথীরা অবাক মানে,
সারাদিন বসি কি যে ভাবে তার অর্থ সে নিজে জানে!
সময়ের খাওয়া অসময়ে খায়, উপোসীও কভূ থাকে,
"চির দিন তোর কি হল রূপাই" বার বার মায় ডাকে।
গেলে কোনখানে হয়ত সেথাই কেটে যায় সারাদিন,
বসিলে উঠেনা উঠিলে বসেনা, ভেবে ভেবে তবু ক্ষীণ।
সবে হাটে যায় পথ বরাবর রুপা যায় ঘুরে বাঁকা,
খালার বাড়ির কাছ দিয়ে পথ, বাঁশ-পাতা দিয়ে ঢাকা।
পায়ে-পায় ছাই বাঁশ-পাতাগুলো মচ্ মচ্ করে বাজে;
কেউ সাথে নেই, তবু যে রূপাই মরে যায় যেন লাজে।
চোরের মতন পথে যেতে যেতে এদিক ওদিক চায়
যদিবা হঠাৎ সেই মেয়েটির দুটি চোখে চোখ যায়।
ফিরিবার পথে খালার বাড়ির নিকটে আসিয়া তার,
কত কাজ পড়ে, কি করে রূপাই দেরি না করিয়া আর।
কোনদিন কহে, "খালামা, তোমার জ্বর নাকি হইয়াছে,
ও-বাড়ির ওই কানাই আজিকে বলেছে আমার কাছে।
বাজার হইতে আনিয়াছি তাই আধসেরখানি গজা;"
"বালাই! বালাই! জ্বর হবে কেন? রূপাই করিলি মজা;
জ্বর হলে কিরে গজা খায় কেহ?" হেসে কয় তার খালা,
"গজা খায়নাক, যা হোক এখন কিনে ত হইল জ্বালা;
আচ্ছা না হয় সাজুই খাইবে। " ঠেকে ঠেকে রুপা কহে,
সাজু যে তখন লাজে মরে যায়, মাথা নীচু করে রহে।
কোন দিন কহে, "সাজু কই ওরে, শোনো কিবা মজা, খালা!
আজকের হাটে কুড়ায়ে পেয়েছি দুগাছি পুঁতির মালা;
এক ছোঁড়া কয়, 'রাঙা সূতো নেবে? লাগিবে না কোন দাম';
নিলে কিবা ক্ষতি, এই ভেবে আমি হাত পেতে লইলাম।
এখন ভাবছি, এসব লইয়া কিবা হবে মোর কাজ,
ঘরেতে থাকিলে ছোট বোনটি সে ইহাতে করিত সাজ।
সাজু ত আমার বোনেরই মতন, তারেই না দিয়ে যাই,
ঘরে ফিরে যেতে একটু ঘুরিয়া এ-পথে আইনু তাই। "
এমন করিয়া দিনে দিন যেতে দুইটি অরুণ হিয়া,
এ উহারে নিল বরণ করিয়া বিনে-সূতী মালা দিয়া।
এর প্রাণ হতে ওর প্রাণে যেয়ে লাগিল কিসের ঢেঊ,
বিভোল কুমার, বিভোল কুমারী, তারা বুঝিল না কেউ।
-তারা বুঝল না, পাড়ার লোকেরা বুঝিল অনেকখানি,
এখানে ওখানে ছেলে বুড়ো মিলে শুরু হল কানাকানি।
সেদিন রূপাই হাট-ফেরা পথে আসিল খালার বাড়ি,
খালা তার আজ কথা কয়নাক, মুখখানি যেন হাঁড়ি।
"রুপা ভাই এলে?" এই বলে সাজু কাছে আসছিল তাই,
মায় কয়, "ওরে ধাড়ী মেয়ে, তোর লজ্জা শরম নাই?"
চুল ধরে তারে গুড়ুম গুড়ুম মারিল দ'তিন কিল,
বুঝিল রূপাই এই পথে কোন হইয়াছে গরমিল।
মাথার বোঝাটি না-নামায়ে রুপা যেতেছিল পথ ধরি,
সাজুর মায়ে যে ডাকিল তাহারে হাতের ইশারা করি;
"শোন বাছা কই, লোকের মুখেতে এমন তেমন শুনি,
ঘরে আছে মোর বাড়ন্ত মেয়ে জ্বলন্ত এ আগুনি।
তুমি বাপু আর এ-বাড়ি এসো না। " খালা বলে রোষে রোষে
"কে কি বলে? তার ঘাড় ভেঙে-দেব!" রুপা কহে দম কসে
"ও-সবে আমার কাজ নাই বাপু, সোজা কথা ভালবাসি,
সারা গাঁয়ে আজ ঢি ঢি পড়ে গেছে, মেয়ে হল কুল-নাশী।
"
সাজুর মায়ের কথাগুলো যেন বঁড়শীর মত বাঁকা,
ঘুরিয়া ঘুরিয়া মনে দিয়ে যায় তীব্র বিষের ধাকা।
কে যেন বাঁশের জোড়-কঞ্চিতে তাহার কোমল পিঠে,
মহারোষ-ভরে সপাং সপাং বাড়ি দিল গিঠে গিঠে।
টলিতে টলিতে চলিল রূপাই একা গাঁর পথ ধরি,
সম্মুখ হতে জোনাকীর আলো দুই পাশে যায় সরি।
রাতের আধাঁর গলি ভরা বিষে জমাট বেঁধেছে বুঝি,
দুই হাতে তাহা ঠেলিয়া ঠেলিয়া চলে রুপা পথ খুঁজি।
মাথার ধামায় এখনও রয়েছে দুজোড়া রেশমী চুড়ি,
দুপায়ে তাহারে দলিয়া রূপাই ভাঙিয়া করিল গুঁড়ি।
হাটের সদাই জলীর বিলেতে দুহাতে ছুঁড়িয়া ফেলি,
পথ থুয়ে রুপা বেপথে চলিল, ইটা খেতে* পাও মেলি।
চলিয়া চলিয়া মধ্য মাঠেতে বসিয়া কাঁদিল কত,
অষ্টমী চাঁদ হেলিয়া হেলিয়া ওপারে হইল গত।
*ইটা খেত - চষা খেত।
প্রভাতে রূপাই উঠিল যখন মায়ের বিছানা হতে,
চেহারা তাহার আধা হয়ে গেছে চেনা যায় কোন মতে।
মা বলে, "রূপাই কি হলরে তোর?" রূপাই কহে না কথা
দুখিনী মায়ের পরাণে আজিকে উঠিল দ্বিগুণ ব্যথা।
সাত নয় মার পাঁচ নয় এক রূপাই নয়ন তারা,
এমনি তাহার দশা দেখে মায় ভাবিয়া হইল সারা।
শানাল* পীরের সিন্নি মানিল খেতে দিল পড়া-পানি,
দেহের দৈন্য দেখিল জননী, দেখিল না প্রাণখানি।
সারা গায়ে মাতা হাত বুলাইল চোখে-মুখে দিল জল,
বুঝিল না মাতা বুকের ব্যথার বাড়ে যে ইহাতে বল।
*শানাল - পূর্ব বঙ্গের বিখ্যাত পীর শাহলাল।
আজকে রূপার সকলি আধাঁর, বাড়া-ভাতে ওরে ছাই,
কলঙ্ক কথা সবে জানিয়াছে, কেহ বুঝি বাকি নাই।
জেনেছে আকাশ; জেনেছে বাতাস, জেনেছে বনের তরু;
উদাস-দৃষ্টি যত দিকে চাহে সব যেন শূনো মরু।
চারিদিক হতে উঠিতেছে সুর, ধিক্কার! ধিক্কার!!
শাঁখের করাত কাটিতেছে তার লয়ে কলঙ্ক ধার।
ব্যথায় ব্যথায় দিন কেটে গেল, আসিল ব্যথার সাঁজ,
পূবে কলঙ্কী কালো রাত এল, চরণে ঝিঁঝির ঝাঁজ!
অনেক, সুখের দুখের সাক্ষী বাঁশের বাঁশীটি নিয়ে,
বসিল রূপাই বাড়ির সামনে মধ্য মাঠেতে গিয়ে।
মাঠের রাখাল, বেদনা তাহার আমরা কি অত বুঝি?
মিছেই মোদের সুখ-দুখ দিয়ে তার সুখ-দুখ খুঁজি।
আমাদের ব্যথা কেতাবেতে লেখা, পড়িলেই বোঝা যায়;
যে লেখে বেদনা বে-বুঝ বাঁশীঁতে কেমন দেখাব তায়?
অনন্তকাল যাদের বেদনে রহিয়াছে শুধু বুকে,
এ দেশের কবি রাখে নাই যাহা মুখের ভাষায় টুকে;
সে ব্যথাকে আমি কেমনে জানাব? তবুও মাটিতে কান;
পেতে রহি যদি কভু শোনা যায় কি কহে মাটির প্রাণ!
মোরা জানি খোঁজ বৃন্দাবনেতে ভগমান করে খেলা,
রাজা-বাদশার সুখ-দুঃখ দিয়ে গড়েছি কথার মেলা।
পল্লীর কোলে নির্ব্বাসিত এ ভাইবোনগুলো হায়,
যাহাদের কথা আধ বোঝা যায়, আধ নাহি বোঝা যায়;
তাহাদেরই এক বিরহিয়া বুকে কি ব্যথা দিতেছে দোল,
কি করিয়া আমি দেখাইব তাহা, কোথা পাব সেই বোল?
-সে বন-বিহগ কাঁদিতে জানে না, বেদনার ভাষা নাই,
ব্যাধের শায়ক বুকে বিঁধিয়াছে জানে তার বেদনাই।
বাজায় রূপাই বাঁশীটি বাজায় মনের মতন করে,
যে ব্যথা বুকে ধরিতে পারেনি সে ব্যথা বাঁশীতে ঝরে।
'আমি কেনে বা পিরীতিরে করলাম।
(আমার ভাবতে জনম গেলরে,
আমার কানতে জনম গেলরে। )
সে ত সীন্তার সিন্দুর নয় তারে আমি কপালে পরিব,
সে ত ধান নয় চাউল নয় তারে আমি ডোলেতে ভরিবরে,
আমি কেনেবা পিরীতিরে করলাম।
আগে যদি জানতাম আমি প্রেমের এত জ্বালা,
ঘর করতাম কদম্বতলা, রহিতাম একেলারে;
আমি কেনেবা পিরীতিরে করলাম। '
- মুর্শিদা গান
বাজে বাঁশী বাজে, তারি সাথে সাথে দুলিছে সাঁজের আলো;
নাচে তালে তালে জোনাকীর হারে কালো মেঘে রাত-কালো।
বাজাইল বাঁশী ভাটিয়ালী সুরে বাজাল উদাস সুরে,
সুর হতে সুর ব্যথা তার যেন চলে যায় কোন্ দূরে!
আপনার ভাবে বিভোল পরাণ, অনন্ত মেঘ-লোকে,
বাঁশী হতে সুরে ভেসে যায় যেন, দেখে রুপা দুই চোখে।
সেই সুর বেয়ে চলেছে তরুণী, আউলা মাথার চুল,
শিঁথিল দুখান বাহু বাড়াইয়া ছিঁড়িছে মালার ফুল।
রাঙা ভাল্ হতে যতই মুছিছে ততই সিদুঁর জ্বলে;
কখনও সে মেয়ে আগে আগে চলে, কখনও বা পাছে চলে।
খানিক চলিয়া থামিল তরুণী আঁচলে ঢাকিয়া চোখ,
মুছিতে মুছিতে পারে না, কি যেন অসহ শোক!
করুণ তাহার করুণ কান্না আকাশ ছাইয়া যায়,
কি যেন মোহের রঙ ভাসে মেঘে তাহার বেদন-ঘায়।
পুনরায় যেন খিলখিল করে একগাল হাসি হাসে,
তারি ঢেউ লাগি গগনে গগনে তড়িতের রেখা ভাসে।
রূপার মায়ের রুঠা কথায় উঠল বুড়ীর কাশ,
একটু দিলে তামাক পাতা, নিলেন বুড়ী শ্বাস।
এমন সময় ওই গাঁ হতে আসল খেঁদির মাতা,
টুনির ফুপু আসল হাতে ডল্তে তামাক পাতা।
ক'জনকে আর থামিয়ে রাখে? বুঝল রূপার মা
রুপা তাহার সত্যি করেই এতটুকুন না।
বুঝল মায়ে কেন ছেলে এমন উদাস পারা,
হেথায় হোথায় কেবল ঘোরে হয়ে আপন হারা।
ওপাড়ার ও দুখাই মিঞা ঘটকালিতে পাকা,
সাজুর সাথেই জুড়ুক বিয়ে যতকে লাগুক টাকা।
শেখ বাড়িতে যেয়ে ঘটক বেকী-বেড়ার কাছে,
দাঁড়িয়ে বলে, "সাজুর মাগো, একটু কথা আছে। "
সাজুর মায়ে বসতে তারে এনে দিলেন পিঁড়ে,
ডাব্বা হুঁকা লাগিয়ে বলে, "আস্তে টান ধীরে। "
ঘটক বলে, 'সাজুর মাগো মেয়ে তোমার বড়,
বিয়ের বয়স হলো এখন ভাবনা কিছু কর।
'
সাজুর মা কয় "তোমরা আছ ময়-মুরব্বি ভাই,
মেয়ে মানুষ অত শত বুঝি কি আর ছাই!
তোমরা যা কও ঠেলতে কি আর সাধ্য আছে মোর?"
ঘটক বলে, "এই ত কথা, লাগবে না আর ঘোর।
ও-পাড়ার ও রূপারে ত চেনই তুমি বোন্,
তার সাথে দাও মেয়ের বিয়ে ঠিক করিয়ে মন। "
সাজুর মা কয়, "জান ত ভাই! রটছে গাঁয়ে যা তা,
রূপার সাথে বিয়ে দিলে থাকবে না আর মাথা। "
ঘটক বলে, "কাঁটা দিয়েই তুলতে হবে কাঁটা,
নিন্দা যারা করে তাদের পড়বে মুখে ঝাঁটা।
রুপা ত আর নয় এ গাঁয়ে যেমন তেমন ছেলে,
লক্ষ্মীরে দেই বউ বানায়ে অমন জামাই পেলে।
"
ঠাটে ঘটক কয় গো কথা ঠোঁট-ভরাভর হাঁসে;
সাজুর মায়ের পরাণ তারি জোয়ার-জলে ভাসে।
"দশ খান্দা জমি রূপার, তিনটি গরু হালে,
ধানের-বেড়ী ঠেকে তাহার বড় ঘরের চালে।
সাজু তোমার মেয়ে যেমন, রুপাও ছেলে তেমন,
সাত গেরামের ঘটক আমি জোড় দেখিনি এমন। '
তার পরেতে পাড়্ল ঘটক রূপার কুলের কথা,
রূপার দাদার' নাম শুনে লোক কাঁপত যথা তথা।
রূপার নানা সোয়েদ-ঘেঁষা মিঞাই বলা যায়-
কাজী বাড়ির প্যায়দা ছিল কাজল-তলার গাঁয়।
রূপার বাপের রাখত খাতির গাঁয়ের চৌকিদারে,
আসেন বসে মুখের কথা-গান বাজিত তারে।
রূপার চাচা অছিমদ্দী, নাম শোন নি তার?
ইংরেজী তার বোল শুনিনে সব মানিত হার।
কথা ঘটক বল্ল এঁটে, বল্ল কখন ঢিলে,
সাজুর মায়ে সবগুলি তার ফেল্ল যেন গিলে।
মুখ দেখে তার বুঝল ঘটক - লাগছে ওষুধ হাড়ে,
বল, "তোমার সাজুর বিয়া ঠিক কর এই বারে। "
সাজুর মা কয়, "যা বোঝ ভাই, তোমরা গ্যা তাই কর,
দেখো যেন কথার আবার হয় না নড়চড়।
"
"আউ ছিছি!" ঘটক বলে, "শোনই কথা বোন,
তোমার সাজুর বিয়া দিতে লাগ্বে কত পণ?
পোণে দিব কুড়ি দেড়েক বায়না দেব তেরো,
চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় এই গে ধরো বারো।
সবদ্যা* হল দুই কুড়ি এ নিতেই হবে বোন,
চাইলে বেশী জামাইর তোমার বেজার হবে মন। "
সাজুর মা কয়, "ও-সব কথার কি-ইবা আমি জানি,
তোমরা যা কও তাইত খোদার শুকুর বলে মানি। "
সাধে বলে দুখাই ঘটক ঘটকালিতে পাকা,
আদ্য মধ্য বিয়ের কথা সব করিল ফাঁকা।
*সবদ্যা - সব দিয়া
চল্-চলা-চল্ চল্ল দুখাই পথ বরাবর ধরি,
তাগ্-ধিনা-ধিন্ নাচে যেন গুন্গুনা গান করি।
দুখাই ঘটক নেচে চলে নাচে তাহার দাড়ি,
বুড়ো বটের শিকড় যেন চল্ছে নাড়ি নাড়ি;
লম্ফে লম্ফে চলে ঘটক দম্ভ করে চায়,
লুটের মহল দখল করে চলছে যেন গাঁয়!
ঘটকালিরই টাকা যেন ঝন্-ঝনা-ঝন্ বাজে,
হন্-হনা-হন্ চল্ল ঘটক একলা পথের মাঝে।
ধানের জমি বাঁয় ফেলিয়া, ডাইনে ঘন পাট,
জলীর বিলে নাও বাধিঁয়া ধর্ল গাঁয়ের বাট।
"কি কর গো রূপার মাতা, ভাবছ বসি কিবা,
সাজুর সাথেই ঠিক কইরাছি তোমার ছেলের বিবা।
সহজে কি হয় সে রাজি, একশ টাকা পণ,
এর কমেতে বসেইনাক সাজুর মায়ের মন।
আমিও আবার কুড়ি তিনেক উঠিয়ে তার পরে,
সাজুর মায়ও নাছোড়-বান্দা, দিলাম তখন ধরে;
আরেক কুড়ি, তয় সে কথা হইল হাসি হাসি,
আমি ভাবি, বিয়ার বুঝি বাজ্ল সানাই বাঁশী।
এখন বলি, রূপার মাতা, আড়াই কুড়ি টাকা,
মোর কাছেতে দিবা, কথা হয় না যেন ফাঁকা!
আস্ব দিয়ে গোপনে তায়, নইলে গাঁয়ের লোকে,
মেজবানী দাও বলে তারে ধরবে চীনে-জোঁকে।
বিয়ের দিনে নিবে সে তাই তিরিশ টাকা যেচে,
যারে তারে বল্তে পার এই কথাটি নেচে।
চিনি সন্দেশ আগোড় বাগোড় তার লাগিবে ষোলো,
এই ধরগ্যা রূপার বিয়া আজই যেন হল। "
রূপার মায়ের আহ্লাদে প্রাণ ধরেইনাক আর,
ইচ্ছা করে নেচে নেচে বেড়ায় বারে বার।
"ও রুপা, তুই কোথায় গেলি? ভাবি্সনাক মোটে,
কপাল গুণে বিয়ে যে তোর সাজুর সাথেই জোটে!"
এই বলিয়া রূপার মাতা ছুটল গাঁয়ের পানে,
ঘটক গেল নিজের বাড়ি গুন্-গুনা-গুন গানে।
আট
***
"কি কর দুল্যাপের মালো; বিভাবনায় বসিয়া,
আসতাছে বেটীর দামান ফুল পাগড়ী উড়ায়া নারে। "
"আসুক আসুক বেটীর দামান কিছুর চিন্তা নাইরে,
আমার দরজায় বিছায়া থুইছি কামরাঙা পাটী নারে।
সেই ঘরেতে নাগায়া থুইছি মোমের সস্র বাতি,
বাইর বাড়ি বান্দিয়া থুইছি গজমতী হাতী নারে। "
- মুসলমাআন মেয়েদের বিবাহের গান
বিয়ের কুটুম এসেছে আজ সাজুর মায়ের বাড়ি,
কাছারী ঘর গুম্-গুমা-গুম্, লোক হয়েছে ভারি।
গোয়াল-ঘরে ঝেড়ে পুছে বিছান দিল পাতি;
বসল গাঁয়ের মোল্লা মোড়ল গল্প-গানে মাতি।
কেতাব পড়ার উঠল তুফান; - চম্পা কালু গাজী,
মামুদ হানিফ সোনাবান ও জয়গুণ বিবি আজি;
সবাই মিলে ফির্ছে যেন হাত ধরাধর করি,
কেতাব পড়ার সুরে সুরে চরণ ধরি ধরি।
পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোড়ল নাচিয়ে ঘন দাড়ি,
পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোল্লা মাঠ-ফাটা ডাক ছাড়ি।
কৌতুহলী গাঁয়ের লোকে শুন্ছে পেতে কান,
জুমজুমেরি* পানি যেন কর্ছে তারা পান!
দেখছে কখন মনের সুখে মামুদ হানিফ যায়,
লাল ঘোড়া তার উড়্ছে যেন লাল পাখিটির প্রায়।
কাতার কাতার সৈন্য কাটে যেমন কলার বাগ,
মেষের পালে পড়ছে যেন সুন্দর-বুনো বাঘ!
স্বপন দেখে, জয়গুন বিবি পালঙ্কেতে শুয়ে,
মেঘের বরণ চুলগুলি তার পড়ছে এসে ভূঁয়ে;
আকাশেরি চাঁদ সুরুজে মুখ দেখে পায় লাজ,
সেই কনেরে চোখের কাছে দেখ্ছে চাষী আজ।
দেখ্ছে চোখে কারবালাতে ইমাম হোসেন মরে,
রক্ত যাহার জম্ছে আজো সন্ধ্যা-মেঘের গোরে;
কারবালারি ময়দানে সে ব্যথার উপাখ্যান;
সারা গাঁয়ের চোখের জলে করিয়া গেল সান।
*জুমজেমেরি - জমজম কূপের পানি
উঠান পরে হল্লা-করে পাড়ার ছেলে মেয়ে
রঙিন বসন উড়ছে তাদের নধর তনু ছেয়ে।
কানা-ঘুষা করত যারা রূপার স্বভাব নিয়ে,
ঘোর কলিকাল দেখে যাদের কানত সদা হিয়ে;
তারাই এখন বিয়ের কাজে ফির্ছে সবার আগে,
ভাঙা-গড়ার সকল কাজেই তাদের সমান লাগে।
বউ-ঝিরা সব রান্না-বাড়ায় ব্যস্ত সকল ক্ষণ;
সারা বাড়ি আনন্দ আজ খুশী সবার মন।
বাহিরে আজ এই যে আমোদ দেখ্ছে জনে জনে;
ইহার চেয়ে দ্বিগুণ আমোদ উঠ্ছে রূপার মনে।
ফুল পাগড়ী মাথায় তাহার 'জোড়া জামা' গায়,
তেল-কুচ্-কুচ্ কালো রঙে ঝলক্ দিয়ে যায়।
বউ-ঝিরা সব ঘরের বেড়ার খানিক করে ফাঁক,
নতুন দুলার রুপ দেখি আজ চক্ষে মারে তাক।
এমন সময় শোর উঠিল - বিয়ের যোগাড় কর,
জল্দি করে দুলার মুখে পান শরবত ধর।
সাজুর মামা খট্কা লাগায়, "বিয়ের কিছু গৌণ,
সাদার পাতা* আনেনি তাই বেজায় সবার মন। "
রূপার মামা লম্ফে দাঁড়ায় দম্ভে চলে বাড়ি;
সেরেক পাঁচেক সাদার পাতা আন্ল তাড়াতাড়ি।
কনের খালু উঠিয়া বলে "সিদুঁর হল ঊনা।
"
রূপার খালু আনিয়া দিল যা লাগে তার দুনা।
*সাদার পাতা - তামাক পাতা।
কনের চাচার মন উঠে না, "খাটো হয়েছে শাড়ী। "
রূপার চাচা দিল তখন 'ইংরেজী বোল ছাড়ি'।
'কিরে বেটা বকিস নাকি?" কনের চাচা হাঁকে,
জালি কলার পাতার মত গা কাঁপে তার রাগে।
"কোথায় গেলি ছদন চাচা, ছমির শেখের নাতি,
দেখিয়া দেই দুলার চাচার কতই বুকের ছাতি!
বেরো বেটা নওশা* নিয়ে, দিব না আজ বিয়া;"
বলতে যেন আগুন ছোটে চোখ দুটি তার দিয়া
বরপক্ষের লোকগুলি সব আর যে বরের চাচা,
পালিয়ে যেতে খুঁজছে যেন রশুই ঘরের মাচা।
*নওশা - বর
মোড়ল এসে কনের চাচায় অনেক করে বলে,
থামিয়ে তারে বিয়ের কথা পাড়েন কুতূহলে।
কনের চাচা বসল এসে বরের চাচার কাছে,
কে বলে ঝড় এদের মাঝে হয়েছে যে পাছে!
মোল্লা তখন কলমা পড়ায় সাক্ষী-উকিল* ডাকি,
বিয়ে রূপার হয়ে গেল, ক্ষীর-ভোজনী বাকি!
তার মাঝেতে এমন-তেমন হয়নি কিছু গোল,
কেবল একটি বিষয় নিয়ে উঠল হাসির রোল।
এয়োরা সব ক্ষীর ছোঁয়ায়ে কনের ঠোঁটের কাছে;
সে ক্ষীর আবার ধরল যখন রূপার ঠোঁটের পাছে;
রুপা তখন ফেলল খেয়ে ঠোঁট-ছোঁয়া সেই ক্ষীর,
হাসির তুফান উঠল নেড়ে মেয়ের দলের ভীড়।
ভাব্ল রূপাই - ওমন ঠোঁটে যে ক্ষীর গেছে ছুঁয়ে,
দোজখ যাবে না খেয়ে তা ফেলবে যে জন ভূঁয়ে।
পরের পর্ব
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।