আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রোল নম্বর ৫৮ : অসম্ভব সুন্দর লেখাটি পড়তে পড়তে চোখ ভিজে আসছিল·····

যদি আমি ঝঁরে যাই একদিন কার্তকের নীল কুয়াশায়

২০০৭ সাল। কলা ভবনে খ ইউনিটের ভাইভা চলছে। সেখানে প্রথম পরিচয়। আলাপে আলাপে দেখা গেল দু'জনের মধ্যে অনেক মিল। মাধ্যমিকে দুজনেরই রেজাণ্ট ৩.৭৫।

উচ্চমাধ্যমিকেও একই_৪.৮০। আর কি আশ্চর্য্য বিশ্ববিদ্যালয়েও দুজনেই পেয়েছেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। বরাদ্দ এফ. রহমান হল! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, থাকতেনও তারা পাঁচতলায়। এতসব মিলের সঙ্গে মনের মিলও তুমুল হওয়ায় অচিরেই আবু বকর সিদ্দিক ও মোহাম্মদ ফারুক আহমেদ হয়ে উঠলেন হরিহরাত্দা। আবু বকর মাঝে মধ্যেই বন্ধুকে বাড়িতে নিতে চাইতেন।

নানা কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি ফারুকের। তবে শেষপর্যন্ত তিনি বকরের বাড়িতে গিয়েছেন। বন্ধুর লাশ কাঁধে নিয়ে। খুব সিরিয়াস : 'আগের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়েছিল। পড়ালেখা ছাড়া কিছুই বুঝত না বকর।

রুমে গেলেই বই হাতে টেবিলে দেখা যেত তাকে'_বলছিলেন ফারুক। 'খুব অসুস্থতা ছাড়া কখনো ক্লাস মিস করতে দেখেনি কেউ। বসতও ক্লাসের সামনের সারিতে। ' আরেক বন্ধু সাজু বললেন, 'সময়মতো ক্লাসে আসা, নোট নেওয়া_সবকিছুতেই ও খুব সিরিয়াস। স্যারের কোনো লেকচার মিস করলে ছটফট করত, কখন অন্যদের কাছ থেকে লিখে নেবে।

পড়াশোনায় এত আগ্রহের কারণে স্যাররাও তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। তৌফিকুল হায়দার স্যার, বাছির স্যার তো খুবই স্নেহ করতেন। ' বইয়ের পোকা : পড়তে খুব ভালোবাসতেন আবু বকর। নতুন সেমিস্টারের শুরুতেই খোঁজ নিতেন এবার কোন কোন কোর্স পড়তে হবে, কী কী বই লাগবে। ফারুক বললেন, "শুধু একাডেমিক বিষয় বলে নয়, ইতিহাস পড়তে মন থেকেই সে ভালোবাসতো।

ইরান ও মধ্য এশিয়ার ইতিহাস ছিল খুব পছন্দের বিষয়। সাহিত্যের প্রতিও ছিল খুব আগ্রহ। " এখনো কেউ যদি তার রুমে ঢুকে পড়েন তাহলে দেখবেন টেবিলে গল্পগুচ্ছ, বেগম রোকেয়া রচনা সমগ্র, শেক্সপিয়ার থরে থরে সাজানো। হ্যালো, টিচার : এফ. রহমান হলের ৪০৪ নম্বর রুম। দেয়ালে টাঙানো লাল কাগজে লেখা_'লাইফ ইজ এ টেল, টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট, ফুল অব ফিউরি সিগনিফাইং নাথিং...।

' তাঁর টেবিলে আগের মতোই সাজানো আছে বই, টুপি, চার্জার। কিন্তু রুমটির 'টিচার'ই নেই। পরীক্ষার ফল, পড়ার আগ্রহ দেখে রুমমেটরা তাঁকে 'টিচার' নামেই ডাকতেন। ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর মিডটার্ম পরীক্ষা। ১ তারিখ রাতেও রুটিনমাফিক পড়া শেষ করে ঘুমাতে গেছেন।

তখন কে জানত, মৃত্যু এসে স্থগিত করে দেবে তার সব পরীক্ষা! জীবন এক যুদ্ধ : তাঁর কাছে বড় ছিল পরিবার। আর্থিক অসঙ্গতির পাশাপাশি পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য_সব মিলিয়ে মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপে থাকতেন আবু বকর। 'এই চাপে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত ও। ক্লাস-পরীক্ষা-পড়াশোনার বাইরে টিউশনি করতে গিয়ে হল থেকে মিরপুর আসা-যাওয়ায় প্রায়ই দুর্বল হয়ে পড়ত। তারপরও পরিবারের স্বপ্ন পূরণে গুনে গুনে দিন পার করছিল সে।

বই কেনারও সামর্থ্য ছিল না। ' বন্ধুর মুখ এভাবেই তুলে ধরেন ফারুক। বন্ধুদের অনেক বই এখনো পড়ে আছে তাঁর টেবিলে। একই বিছানার সঙ্গী শিহাব জানান, 'পুরো ফার্স্ট ইয়ার একটি শার্ট-প্যান্টে পার করেছে সে। ' নির্জনতায় ভালোবাসা : চুপচাপ, লাজুক আবু বকর ক্লাস শেষে সোজা চলে আসতেন রুমে।

বিভাগের বন্ধু সাজু জানালেন, 'আমাদের মতো আড্ডা দিত না সে। ঘনিষ্ঠ দুই-একজন ছাড়া কারো সঙ্গে তেমন কথা বলত না। ' রেজা বলেন, 'সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইত। হয়তো আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অন্যদের সঙ্গে মিশতে চাইত না। ' কিন্তু ভেতর ভেতর দারুণ রোমান্টিক ছিল।

ফারুক জানান, "মাঝে মধ্যেই দেখতাম 'কুছ কুছ হোতা হ্যায়' গানটি শুনতে শুনতে খুব উদাস হয়ে যেত। কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিত না। " নানা ঘটনা এখন ফিরে ফিরে আসে ফারুকের স্মৃতিতে। সেই প্রথম বর্ষ থেকে এই সেদিন পর্যন্ত আবু বকরের নোট দিয়ে পরীক্ষায় পাস করেছেন তিনি। প্রতিবার পরীক্ষার আগের রাতে নোট নিতে বন্ধুর কাছে যেতেন ফারুক।

'জানের দোস্ত'ও এই স্বভাবের কারণে তার সঙ্গে খুব রাগারাগি করত। বলত, 'কাল পরীক্ষা। তুই এখন এসেছিস নোট নিতে। ছি! ছি!' বকাঝকা করে শেষ পর্যন্ত অবশ্য নোট দিয়ে পড়া বুঝিয়ে দিত। গুরুর চোখে : প্রতিদিন ঠিক সময়ে ক্লাসে হাজির হওয়া, বন্ধুবৎসল ছেলেটিকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ।

এই বিভাগের শিক্ষক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'সহজ-সরল, মেধাবী একটি ছেলে যে এভাবে হঠাৎ চলে যাবে, এটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। এই মৃত্যু আমাদের হতবিহ্বল করে দিয়েছে। ' আরেক শিক্ষক নুসরাত ফাতেমা বলেন, 'ক্লাসে সব সময়ই বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করত। কোর্সের জন্য কী কী বই পড়তে হবে জানতে চাইত। ' ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মিডটার্ম পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন সহযোগী অধ্যাপক নুসরাত ফাতেমা।

রোল নম্বর ফিফটি এইটের খাতায় এসে তাঁর চোখ আটকে গেল। খুব মনোযোগ দিয়ে খাতাটি আবার দেখতে শুরু করলেন। লাল কালির একটি দাগও দিতে পারলেন না! খাতার মালিক যে খাতা দেখার আগেই চলে গেছেন বহুদূরে। তাঁর বিদায়ের পর প্রথম ক্লাসের দিন বৃহস্পতিবার খাতাটি অন্য শিক্ষকদের দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নুসরাত ম্যাডাম বারবার বলছিলেন, 'দেখুন স্যার, কিভাবে এই খাতায় কম নম্বর দেওয়া যায়...'!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।