আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কী করে ভুলিবো তাহাদের কথা ?

বুকের ভেতর বহু দূরের পথ...

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হওয়ার সুবাদে আমার অল্পবিস্তর লেখালেখির অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু দেশের দু’দুটো স্বনামধন্য পত্রিকায় কাজ করলেও এখন পর্যন্ত সম্পাদক/সম্পাদনা শব্দ থেকে ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তার পেছনে অবশ্য যথেষ্ট কারন রয়েছে। পত্রিকায় অনেক সময় খবর লিখে পাঠিয়ে দেখি পরদিন তা হয়তো বেরোয়নি । অনেক সময় যা আসে তা হয়তো আমি নিজেই চিনতে পারিনা আদৌ তা লিখেছিলাম কিনা।

এক কথায় যাকে বলে পোস্টমর্টেম। মাথা আছে তো লেজ নেই, লেজ আছে তো শরীর নেই অবস্থা আর কী। এ দুঃখের কথা কাকে বলি কেই বা তা শোনে ? তার উপর আছে শিকসহ বন্ধুদের টিপ্পনী ‘সাংবাদিক সাহেব (অবশ্যই তখন মোটেও সম্মান দেখিয়ে কেউ সাংবাদিক বলেনা) কোথাও পান থেকে চুন খসলে তা পত্রিকায় সংবাদ হয়ে যায় কিন্তু আমাদের খবর ছাপাতে আপনার এতো অনীহা কেন?’ একগাল হেসে আমাকে বলতে হয় ভাই পত্রিকা আমার পৈত্রিক সম্পত্তি না যে তোমরা যা চাও তাই ছাপিয়ে দিবো। আর মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি নিজের ব্যর্থতাকে মেনে নিবো না ভাগ্যকে? তবে এতসব কেন বলছি? আর তা বলারই বা কী দরকার ছিলো? বন্ধু নাসের তারুন্য উৎসবের প্রকাশনার জন্য আমাকে একটা লেখা দিতে বললো। লেখাই যায়।

কিন্তু মনে সেই একই ভয়। এখানেও সম্পাদক মশায় না আবার আমার আবেগকে ত-বিত করার জন্য ছুরিতে শান দিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন! কিন্তু উপায় নেই। বন্ধুর অনুরোধ ফেলার জো কোথায়? খাতা-কলম নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। আর বন্ধু নাসের ঢাকা চলে গেলো প্রকাশনার কাজ সারতে। যাওয়ার আগে বলে গেলো ভারিক্কী গোছের কিছু লিখে পাঠিয়ে দিতে।

সীমিত শব্দের মধ্যে লিখতে বলতেও ভুল করলোনা। যদিও এতণে তার অনেকখানিই আমি এসব আবোল-তাবোল লিখে জলাঞ্জলি দিয়েছি। লিখতে বসে ভাবছি কী লিখবো? মৌলিক কিছু লেখা যাবেনা কারন আমি কোন প্রতিষ্ঠিত লেখক না। কোন একটা বিষয়ে ছোটখাটো গবেষণা চালিয়ে তার উপর লিখে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু আলসেমীর কারনে তাও হয়ে উঠলোনা।

এ পর্যন্ত লিখে বসে থাকলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম এ পর্যন্ত যতটুকু লিখেছি তা মোটামুটি আত্মকাহিনী। আর তখনই আবার আঁতকে উঠলাম। আমি কে যে এসব হাবিজাবি স্মৃতিচারণ করে বেড়াচ্ছি? এত ধৃষ্টতা বা দুঃসাহস কোনটাই আমার নেই। সম্পাদক মশায় হয়তো অলরেডী আমাকে গালাগাল দেওয়া শুরু করেছেন।

এতক্ষণ ধরে তার মূল্যবান সময় নষ্ট করছি বলে। আবার পরণেই ভাবলাম যার যা ইচ্ছা বলুক আমি এ লেখাটা লিখবো। ক্যাম্পাস জীবনের সূর্য প্রায় অস্ত যাওয়ার পথে। আজ যদি না বলি আর কখনই হয়তো এসব বলার সুযোগ হবেনা। চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি ক্যাম্পাসে তারুন্য উৎসব করছে ।

আর সেজন্যই এ প্রকাশনার আয়োজন। আজ আমি সে সব তরুণের কথাই লিখবো। সেসব তরুন যাদের ভুল করেও ভুলতে পারবোনা। সেসব তরুন যাদের জন্য নিজেকে আমি অনেকাংশেই পরিপূর্ণ বোধ করি। যাদের সংস্পর্শে এসে নিজেকে চিনেছি নতুন করে ।

রক্তের সম্পর্কহীন এসব তরুন আত্মার সম্পর্কে আমার ভাই, প্রাণের সম্পর্কে বন্ধু। কী করে ভুলবো সেই বাউলকে যার দরদমাখা কন্ঠে হাছন-লালনের গান শুনে প্রতিদিন আমার ঘুম ভাঙ্গত। নিজের ব্যাচমেট সেই বাউলকে আজীবন বড়ভাই বড়ভাই বলে ডাকলাম। মজার বিষয় ক্যাম্পাসের অনেক সিনিয়ররাও তাকে বড়ভাই বলেই ডাকতো। কেমন করে ভুলবো আমার রুমমেট নাহিদের কথা।

কলেজ জীবন পর্যন্ত কখনও কারো সাথে ঝগড়া করিনি। কিন্তু এ ছেলেটার সাথে ঝগড়া করিনি এমন কোন দিন নেই। এখন রীতিমত তা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ওর সাথে ঝগড়া না হলে একটা দিন ঠিকমতো শেষই হলোনা বলে মনে হয়। অসাধারন ছবি আঁকতে পারা ছেলেটা বোধহয় ভুল করে প্রকৌশলী হতে চলেছে।

মনে পড়ে বড় ভাই একদিন ডেকে বললো চল নাটক নামাই। কোন কিছু না ভেবেই বললাম চলেন। পাগলামির সহযোগী হিসেবে পেলাম রায়হান, শিবলী, দিপু, কামরুল,পলাশ রুমি আর সাদিয়াকে । দুই ঘন্টার মধ্যে আট-দশজন মিলে একটা নাটক লিখে ফেললাম। কামরুল সঙ্গেই সঙ্গেই নাটকের ইনট্রোর জন্য একটা কবিতা লিখে দিলো।

রিহার্সালে মনে পড়ে রায়হানের সংলাপ ছিলো ‘দরজা খুলো, আমি মুক্তিযোদ্ধা আজাদের বন্ধু’। বেটা মঞ্চে উঠে বললো, ‘দরজা খুলো, আমি বাঘ, হালুম ’। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। কিন্তু ল্য করলাম সাদিয়া আর ছোটবোন মৌসুমী চিন্তিত মুখে বসে আছে। জিজ্ঞেস করতেই বললো, রায়হান ভাই যে উদাসীন মানুষ! এখন ফাজলেমি করতেছে।

কিন্তু আসল সময়ে না ঠিকই হালুম বলে ফেলে। কথাটা শুনে আমিও একটু চিন্তায় পড়লাম। রায়হানকে তো চিনি। গিয়ে ঝাড়ি দিলাম। বড়ভাই আমাকে বললো চিন্তা করিস না আমার সাহসে রায়হান উঠবে আর রায়হানের সাহসে আমি।

দেখিস ভীষন হবে নাটকটা। মূল মঞ্চায়নের সময় এরা এমন অভিনয় দেখালো যে বলতে বাধ্য হলাম ‘জাহাপনা তু’সি গ্রেট হো’। এসব স্মৃতি আমাদেরকে একটা সময় তাড়িয়ে বেড়াবে, চোখ ভরিয়ে দিবে অশ্রুতে, বুকের বাম কোণে হয়তো সূ ব্যথা অনুভব করবো দিনগুলো হারিয়ে ফেলার বেদনায়। কিন্তু ভুলতে দেবেনা কাউকেই। ক্যাম্পাসে যখনই আমরা কোন অনুষ্ঠান করতে চাই একটা ছেলে নিরলসভাবে কোন কিছু পাওয়ার আশা না করেই অমানুষিক পরিশ্রম করে যায়।

ছেলেটির নাম পলাশ। এরকম আরো আছে খুশবু, স্বচ্ছ, মাশরুক। অবাক হই ওদের দেখে। কখনই নিজের নাম ফুটানোর কোন ইচ্ছাই দেখিনি ওদের কারো মধ্যে। কিন্তু যখনই ভালো কিছু করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ওরা প্রস্তুত নিজেদের শতভাগ উজাড় করে দিতে।

আরো আছে সব সময় শতকরা একশত ভাগ পারফেকশন চাওয়া সাকিব, অভিমান করে চলে যাওয়া দীপু, কামরুল আর মাসুদ। দীপুকে আমরা রাজপুত্র বলি। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সুদর্শন আর আলাভোলা ছেলেটা মনে হয় ওই-ই। বাড়ির চারতলায় বসে হাসতে থাকলে নীচতলা পর্যন্ত যার হাসির শব্দ শোনা যায়। সে হাসির শব্দ পৃথিবীর যেখানেই থাকিনা কেন যুগ যুগ ধরে আমরা কানে বাজবে।

আর একটা ছেলে যাকে আমি, শান্তনু আর সাকিব সব সময় ডাকি ভাই বলে। আমাদের মুসা ভাই। সাদাসিধা একটা মানুষ। ওর জীবনের প্রতি মুহূর্তের ঘটনাই যেনো এক একটা জীবন্ত কমেডি। মুসা একবার সিদ্ধান্ত নিলো পাশ করে জার্মানী যাবে।

এ উপলে পরদিনই সে কিনে আনলো হিটলারের জীবনী। আর শান্তনু ছেলেটা আজীবন হা-হুতাশ করে আর নিজের কপাল খারাপ ভেবে জীবনটা পার করে দিলো। এ ছেলেটাকে সংজ্ঞায়িত করার কোন ভাষা খুঁজে পাইনা। কিন্তু জানিনা কেন সব সময়ই মনের গহীনে একটা টান অনুভব করি ওর জন্য। অনেক সম্ভাবনাময় এ ছেলেটা সমাজবিধির বেড়াজালে আটকে পড়ে কেন জানি সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে লাগলো।

আর বলবো সাকিবের কথা। আমার পার্টনার। চুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা এক সাথে দিয়েছি, একই সাথে একই হলের একই রুমে উঠেছি, কাসে আমাদের রোল নম্বরও পাশাপাশি। মোটামুটি বলা যায় মানিকজোড়। ওর ডাকনাম আমরা দিয়েছি ঝুনা।

এর কারন ও অসম্ভব বুদ্ধিমান একটা ছেলে। আরো বলতে হয় ভীষণ জাহিদ, মামু এরশাদ, আর লৌহমানব হান্নানের কথা। শিবলী ছেলেটা ভবিষ্যতে চুয়েটের শিক হবে। ফার্স্ট বয় মাত্রই যে আঁতেল না শিবলী তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। যারা ওকে জানে তারা বলবে ওর মতো অলরাউন্ডার কমই আছে।

যদিও মাইক্রোপ্রসেসর ওর কাছে উপন্যাসের মতো, ডিএসপি ওর কাছে ছোটগল্পের মতো আর ডাটা কমিউনিকেশন কাব্যের মতো!! আমাদেও কাছে এগুলো বিভীষিকার নামান্তর। আর সাদিয়া-রুমি এ মেয়ে দু’টি যেন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। সাদিয়া সব সময় একটা কথাই বলে চল ক্যাম্পাসের জন্য কিছু একটা করি । এত উদার মানসিকতার মেয়ে খুব কমই দেখেছি। আর পাগলী রুমিটার কান্ডকারখানা সব সময়ই আমাদের হাসির খোরাক যোগায়।

ও এমন একটা মানুষ যাকে দেখলে সবসময় মনটা ভালো হয়ে যায়। এ ছেলেমেয়েগুলোর অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন আজ পূরণ হতে চলেছে। ক্যাম্পাসে তারুন্য উৎসব আয়োজন করতে পারার। কত শত হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর এ অনূষ্ঠানটি হতে চলেছে। একটা সময় পর হয়তো কেউ এদের মনে রাখবেনা।

কিন্তু আমি কী ভুলতে পারবো? আমরা কী পারবো এক অপরকে ভুলে থাকতে? এত কথা, এত সুর, এত হাসাহাসির মুহূর্ত, অভিমান ,আবার অভিমান ভুলে একই পথে চলা, কষ্টের সময়গুলো একসাথে পাড়ি দেওয়া। লিখতে লিখতে কেন জানি চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। নিজেকে অসহায় মনে হয়। আর ক’টা দিন পর আমরা কে কোথায় থাকবো? আর কী কখনো সুযোগ হবে সবাই মিলে একটা কিছু করার। আর কী কখনো মাথায় পাগলামী ভর করলে কেউ বলবে দোস্ত পাগলামী হলে হবে, চল করে ফেলি।

আর কী কখনো গলায় গলায় মিলিয়ে একই সুরে গাইতে পারেবা? অনেক কিছু লিখলাম কিন্তু তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বাদ দিলাম। এ গল্প তো বলে শেষ হবেনা। এ যে চোখের দেখা প্রাণের কথা, সে কী শেষ হয়? সে কী ভোলা যায়?#

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।