আমি সুমাইয়া বরকতউল্লাহ। ছাত্রী। লেখালেখি করা আমার ভীষণ পছন্দ। আমি ছড়া, গল্প লিখি। পত্রিকায় নিয়মিত লিখি।
লেখালেখি করে বেশ কয়েকটা পুরস্কারও পেয়েছি। শিশু অধিকার রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ (প্রিণ্ট মিডিয়া) পর পর ৩ বার জাতিসংঘ-ইউন
’আসতে পারি স্যার। ’ কথাটা শুনেই সবার চোখ পড়ল শ্রেণী কক্ষের দরজার দিকে। চটপটে ধরনের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে হলুদ কামিজ আর প্রিন্টের সেলোয়ার।
স্যার বাংলা দ্বিতীয় পত্র পড়াচ্ছিলেন। স্যার হাসিমুখে সমাদরের ভঙ্গিতে বললেন, হা এসো এসো। মেয়েটি একটা লাফে চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে সোজা চলে এলো কক্ষে। আমরা হা করে তাকিয়ে রইলাম নবাগত মেয়েটির দিকে।
মেয়েটি স্যারের আদরে গদগদ হয়ে স্যারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
স্যার মেয়েটির দিকে ইঙ্গিত করে আমাদের বললেন, ’এই যে দেখছ মেয়েটি, তার নাম নাদিয়া। ঢাকার একটা নামকরা স্কুলে পড়ত। তার নাকি ঢাকা একটুও ভালো লাগে না। সে সোজা চলে এসেছে মফস্বলের এই স্কুলে। ভর্তি হয়ে গেছে।
তোমাদের সাথেই পড়বে সে। আচ্ছা সবাই জোরে তালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানালে কেমন হয়। স্যারের বলা শেষ না হতেই তালি শুরু হয়ে গেল। ওমমা, মেয়েকেও দেখি হাসিমুখে তালি দিচ্ছে আমাদেও সাথে। ’ স্যার বললেন, 'ধনবাদ সবাইকে।
' তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুমি সিটে গিয়ে বসো। '
’কোথায় বসব স্যার?’ ইতস্তত করে মেয়েটি পশ্ন করতেই স্যার সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ’সুমাইয়া তোমার পাশের সিটটা খালি আছে দেখছি। আজ সে এখানেই বসুক। ’ মেয়েটি ছুটে এসে আমার পাশের সিটে পটাপট বসে পড়ল। আমার পাশের যে মেয়েটি বসতো সে আজ আসেনি।
আমি একটু সরে গিয়ে তাকে বসতে দিলাম। মেয়েটি কাধের ব্যাগটা বেঞ্চিতে রাখল। তারপর খুশি খুশি মুখে চট করে আমাকে বলল, 'তোমার নাম কি?
সুমাইয়া', বললাম আমি।
ভেরি কমোন নেম। তবে নামটা আমার খুব পছন্দ।
কারণ সুমাইয়া হলেন প্রথম শহীদ নারী। সে পাশের আরেকটা মেয়েকেও বলল, 'তোমার নাম কি?' মেয়েটা জবাব দেয়ার আগেই স্যার বললেন, 'নাদিয়া, তুমি নতুন এসেছ। সবার সাথেই পরিচয় করবে। ক্লাস শেষ হলে পরে আলাপ পরিচয় করো, ঠিক আছে?'
’জ্বী সার। ’ বলে আমরা চুপচাপ স্যারের দিকে মন দিলাম।
নদীয়া ঢাকার একটা নামকরা স্কুলে পড়ত। তাও তার ভালো লাগে না। সে শখ কওর চলে এসেছে এই স্কুলে। মনে মনে ভাবছি, 'নাদিয়া অবশ্যই বড়লোকের মেয়ে। ইশ, যদি ঢাকা গিয়ে পড়তে পারতাম, নামকরা স্কুলে পড়তে পারলে কত দাম।
' এসব ভাবছি আর ক্লাস টিচারের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা মেয়েটির দিকে এমন ভাবে তাকাতে লাগলাম যে, নামকরা স্কুলের ছাত্রীর দিকে যেভাবে তাকাতে হয় ঠিক সেভাবেই।
টিচার চলে গেলেন। নদীয়া পাগলের মতো দুহাত উপরে তুলে আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, 'উফ আমার যে কী ভালো লাগছে না, বলতে পারব না। আসো আসো আমরা পরিচয় হয়ে নিই আগে। ' আমরা সবাই এগিয়ে এলাম।
নাদিয়া বলছে, 'তোমরা অনেক ভালো। তেমাদের পেয়ে আমি অনেক খুশি। আচ্ছা আমাকে পেয়ে তোমাদের কেমন লাগছে বলো না একটু। ' আবদার আর অভিমানে মেয়েটি কথা বলে অল্প সময়েই সবার আপন হয়ে গেল।
আমরা ঘিরে বসলাম তাকে।
সে মুগ্ধ হয়ে বার বার বলছে, ’ইশ কী সুন্দর তোমাদের স্কুল, কত বড় মাঠ। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। ছুটির পর আমি ইচ্ছেমতো ছুটোছুটি করব। আমার সাথে থাকবে না তোমরা, বলো। '
আমরা বললাম, 'ছুটির পরে থাকে পেটে রাজ্যের খিদে।
তখন ছুটোছুটিটা কেমন লাগবে তোমার। ' নদীয়া বলে, 'তোমরা জানো না, এই খোলা আকাশ, বাতাস, মাঠ, পথঘাট আমি শহরে একটিও পাইনি। দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। এখন আমি মুক্ত। আমি দৌড়াব, পালাব, চিৎকার করব।
তোমরা আমার পাশে থেকো ভাইটি। ' তার আবদারে কেউ না করতে পারল না। সুযোগ পেলেই ছুটে বেড়াই এদিক সেদিক। আনন্দে ভরে গেল আমাদের মন।
একদিন ক্লাসের সবাই বসে জম্পেস আড্ডা দিচ্ছিলাম।
নাদিয়াকে প্রশ্ন করলাম, 'তুমি শহরে বড় হওয়া একটি মেয়ে; শুধু শুধু গ্রামের টানে শহরের সুখ-শান্তি আনন্দ, এত এত সুযোগ-সুবিধা আর ভালো একটা স্কুল ফেলে এভাবে চলে আসতে পারো গ্রামে? তোমার কি শহরের উন্নত জীবনের কথা মনে হয় না নাদিয়া?'
সে আমাদের কৌতূহল আর প্রশ্নের মানেটা বেশ বুঝতে পেরেছে। সে কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। নাদিয়া চট করে ঠিক আমার মুখোমুখি হয়ে বসে বলল, 'তোমাদের কথা শুনে মনে হয়, শহরে মধু আছে, মধু। তোমাদের কথা শুনে মনে হয়, শহরের মানুষের জীবন সুখ-শান্তি আর আনন্দে ভরা। শহরে থাকলে বুঝতে, কত শান্তি সেখানে।
আযাব। '
আমি বললাম, 'জীবনে যা কিছু পাওয়ার সবই তো শহরে পাওয়া যায়। আমরা তো দেখি, লেখাপড়া জানা লোক শহরে না গেলে জীবনটাই বৃথা মনে করে। তুমি এমন উল্টাপাল্টা বলছ কেন নাদিয়া। '
সে একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলল, 'জানো, এখানে এসে এই কয়দিনে যা পেলাম, শহরে তা পাওয়া যাবে না।
শহরে বড় হলাম, আজও চোখ বন্ধ করে প্রাণ খুলে একটা দৌড় দিতে পারিনি। স্কুলে মাঠ নেই। বাসার আশেপাশে মাঠ নেই এমনকি একটু খোলা জায়গাও নেই। স্কুলে যাওয়া-আসা করব, রোড জ্যাম। এক ইঞ্চি জায়গা পাবে না যেখানে সিমেন্ট নেই।
আর সবুজ মাঠ, এই নরম ঘাস, খোলা আকাশ আর শান্তির বাতাস? কোনোদিন পাইনি। '
তার কথা শুনে আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। বললাম, 'এই তোমাদের শহুরে জীবন?'
'হা গো হা। তো কী বলছি সোনা, তোমরা বোঝো না কেন?' বলল সে।
আসলে গ্রামে থাকি বলে গ্রামের কদর বুঝিনা।
নাদিয়ার কথা শুনে শহরের প্রতি যে মোহ ছিল তা ধীরে ধীরে কোথায় জানি হারিয়ে গেল।
আমি একবার আকাশের দিকে তাকালাম, নীল আকাশে মেঘেরা দৌড়াচ্ছে। তারপর চারদিকটা আবার দেখে নিলাম। সবুজ মাঠ, কৃষক, গরু, ছাগল, খোলা হাওয়া আমার কাছে নতুন করে ভালো লাগতে থাকে। আমি আমাদের গ্রাম নিয়ে মনে মনে গর্ব করছি আর সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এই ভালোলাগাটুকু একাই অনুভব করতে লাগলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।