পদার্থবিদ্যার মতো খটোমটো বিষয় বাদই থাক, বিজ্ঞানের নামেই যাদের জ্বর আসে তারাও ব্যাপারটা জানলে আগ্রহ না দেখিয়ে পারবেন না - এ কথা বলা যায় হলফ করেই। আস্ত অফিস হাতব্যাগে ভরে অথবা হাজার কয়েক প্রিয় গান স্রেফ পকেটে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন যাদের কল্যাণে তাদের ব্যাপারে মনোযোগ না দিয়ে কি পারা যায়! হ্যাঁ, পদার্থ বিজ্ঞানে এবারের নোবেলজয়ী অ্যালবার্ট ফের্ট এবং জার্মানির পিটার গ্রুয়েনবার্গের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে আইপড আর উচ্চ ক্ষমতার ল্যাপটপের মতো প্রযুক্তি তৈরি করা।
তথ্যের জয়যাত্রার এই যুগে আর যা কিছুরই অভাব থাক, তথ্যের আকাল আছে একথা বলার উপায় নেই। উল্টো তথ্যস্রোতে ভেসে যাওয়ার অবস্থা! কত কম যায়গায় কত বেশি তথ্য-উপাত্ত জমা রাখা যায় আজকের সমস্যা সেটা-ই। আর তথ্য সঞ্চয়ের মাধ্যমকে ছোটর চেয়েও আরও ছোট করে আনাই ছিল ইউরোপীয় ওই গবেষক জুটির লক্ষ্য।
তারা এ গবেষণায় সফল না হলে এমপি থ্রি প্ল্লেয়ার আর গিগাবাইট মেমোরির ল্যাপটপ স্বপ্নই হয়ে থাকতো।
নোবেল পুরস্কার যারা দেন সেই সুইডিশ রয়্যাল একাডেমি অব সায়েন্সেস এর বরিয়ে ইয়োহানসেনের কন্ঠেও তারই প্রতিধ্বনি, "তাদের এ আবিস্কার ছাড়া এমপি থ্রি আর আইপড ইন্ডাস্ট্রি বাস্তবে রূপ নিতো না। "
সাফলতা এসেছে আরো আগেই
১৯৮৮ সালে অ্যালবার্ট ফের্ট এবং পিটার গ্রুয়েনবার্গ এই দু'জনে আলাদাভাবে জায়ান্ট ম্যাগনেটোরেজিস্ট্যান্স (জিএমআর) নামে একটি ব্যাপার আবিস্কার করেছেন। জিএমআর ব্যবস্থায় চুম্বকত্বে খুব সামান্য পরিমাণ পরিবর্তনই তড়িৎ প্রতিরোধে অনেক বড় ধরণের পরিবর্তনের সূচনা করে। এর ফলে ডিজিটাল মেমোরি সিস্টেমের নকশা তৈরি এবং তাকে আরো ক্ষুদ্রতর হার্ড ডিস্কে রূপান্তর করা সম্ভব হয়।
অতি ক্ষুদ্র চুম্বকায়িত অংশে তথ্য সাংকেতিকরূপে ধারণ করা হয়। এরপর একটি হেডের মাধ্যমে তা রূপান্তর করা হয় তড়িৎ প্রবাহে। এই বিদ্যুৎ প্রবাহে রদবদলের মাধ্যমেই ডিজিটাল তথ্যের ১ এবং ০ এ সংখ্যা দুটি আসে।
১৯৯৭ সালে প্রথম জিএমআর রিডআউট হেড চালু হয়। নোবেল পুরস্কারের সম্মাননাপত্রে বলা হয়েছে, "জিএমআর প্রযুক্তির আবিস্কার হচ্ছে বিজ্ঞানের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র ন্যানো টেকনোলজির অন্যতম প্রথম সত্যিকারের প্রয়োগ।
"
যেভাবে জিএমআর কাজ করে
হার্ড ড্রাইভের ভেতর ঘুরন্ত ধাতব ডিস্কের ওপর ঝুঁকে থাকে শেষ মাথায় স্পর্শকাতর তড়িৎচুম্বকীয় হেড অলা একটি 'হাত'। ব্যাপারটা অনেকটা রেকর্ড প্লেয়ারের কাটার মতো। তবে এক্ষেত্রে কাটাটি ডিস্কের গায়ে লেগে থাকবে না। একেকটি কণার চুম্বকত্ব পরিমাপের মাধ্যমে ওই হেডটি উপাত্ত 'রিড' বা পাঠ করে।
ডিস্ক ড্রাইভের ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ওই চুম্বকীয় কণাগুলোর আকার অবশ্যই ক্ষুদ্রতর হতে হবে।
এতে করে একই সমান যায়গায় বেশি তথ্য ধারণ করা যাবে। কিন্তু এই অতি ক্ষুদ্র বস্তু যে চুম্বকীয় সিগন্যাল সৃষ্টি করে তা আবার বেশি দুর্বল হয় বলে ডিস্ক ড্রাইভের রিড-রাইট হেডকে আরো বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। ফের্ট ও গ্রুয়েনবার্গ আলাদা আলাদাভাবে গবেষণা করে যা আবিষ্কার করেছেন তা হলো, পরিবর্তনশীল ধাতুর অতি পাতলা স্তর চুম্বকত্বে খুব সামান্য পরিবর্তনও ধরে ফেলতে এবং একে বৈদ্যুতিক রোধকের বড় ধরণের পরিবর্তনে রূপান্তর করতে পারে।
সহজ কথায় বলতে গেলে, উপাত্ত সংরক্ষণে ব্যবহৃত কণাগুলো আরো অনেক বেশি ঘনীভূত হতে পারে। এত সংকুচিত হওয়া সত্ত্বেও কণাগুলো কম্পিউটারের পক্ষে 'পড়ার' উপযোগী ১ ও ০-র বৈদ্যুতিক সংকেত উৎপাদন করতে পারে।
১৯৮৮ সালে বিষয়টি আবিষ্কার করলেও কেতাবী বিজ্ঞান থেকে ডিস্ক মার্কেটে ঢোকার উপযোগী পণ্যে পরিণত হতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। আর এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে আইটি জায়ান্ট আইবিএম। আইবিএম এর গবেষক স্টুয়ার্ট পারকিন ফের্ট আর গ্রুয়েনবাগের গবেষণার ফলকে একত্র করে নতুন একটি ব্যয়সাশ্রয়ী ডিস্ক তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করেন।
উপাত্ত বা ডেটা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সামপ্রতিককালের অগ্রগতির সব কৃতিত্বই অবশ্য জিএমআর প্রযুক্তির নয়। যেমন হার্ড ড্রাইভের চেয়ে কম ক্ষমতাসম্পন্ন সলিড 'ফ্ল্যাশ' মেমোরিতে এটি ব্যবহৃত হয়না।
এক ইন্টারভিউতে ফের্ট এ নিয়ে কৌতুকও করেছেন। জ্যাজ সঙ্গীতের সংগ্রহে ভরা তার একটি আইপড বিগড়ে গেছে জিএমআর ব্যবহার করায়। রগড় করে ফের্ট বললেন, "এটা আমারই দোষ যে আইপডটি জিএমআর হার্ড ড্রাইভঅলা। সাধারণ ফ্ল্যাশ মেমোরিসহ আইপড হতো, দেখতেন মোটেই নষ্ট হতো না তা। "
আলবার্ট ফার্ট বৃত্তান্ত
আলবার্ট ফার্ট বর্তমানে ফ্রান্সের অরসেতে অবস্থিত 'ইউনিভার্সিটি প্যারিস-সুড' এর অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
পাশাপাশি তিনি থালেস গ্রুপ এবং ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার এর যৌথ গবেষনাগারের বৈজ্ঞানিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৭ সালে পিটার গ্রুনবার্গ এর সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনি।
প্যারিসের 'একোল নরম্যাল স্যুপেরিয়্যার' থেকে ১৯৬২ সালে ফার্ট স্নাতক লাভ করেন। তারপর ১৯৬৩ সালে 'ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিস' থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি এবং 'ইউনিভার্সিটি প্যারিস-সুড' থেকে ১৯৭০ সালে পিএইচডি লাভ করেন।
১৯৮৮ সালে ফার্ট জায়ান্ট ম্যাগনেটোরেজিস্টেন্স এফেক্ট (জিএমআর) আবিস্কার করেন।
তাছাড়া স্পিনট্রোনিকস এর ক্ষেত্রেও তিনি ব্যাপক অবদান রাখেন।
ফার্ট এর অর্জিত পুরস্কারগুলো
আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর নিউ ম্যাটারিয়ালস্ (১৯৯৪)
গ্রান্ড প্রিক্স ডি ফিজিক জিন রিচার্ড অফ দ্য ফ্রেন্চ ফিজিক্যাল সোসাইটি (১৯৯৪)
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ পিওর এন্ড এ্যাপ্লাইড ফিজিক্স ম্যাগনেটিজম এ্যাওয়ার্ড (১৯৯৪)
হিউলেট-প্যাকার্ড ইউরোফিজিক্স প্রাইজ (১৯৯৭)
সেন্টার ন্যাশনাল ডি লা রিসার্চ সাইন্টিফিক গোল্ড মেডেল (২০০৩)
ওলফ প্রাইজ ইন ফিজিক্স (২০০৬)
জাপান প্রাইজ (২০০৭)
ইলেক্টেড টু দ্য ফ্রেন্চ একাডেমী অফ সাইন্সেস (২০০৪)
নোবেল প্রাইজ ইন ফিজিক্স (২০০৭)
এক নজরে আলবার্ট ফার্ট
জন্ম : ০৭ মার্চ ১৯৩৮ সাল। কারকাসনি, ফ্রান্স।
বয়স : ৬৯
আবাস : প্যারিস, ফ্রান্স
জাতীয়তা : ফরাসী
কাজের ক্ষেত্র : পদার্থবিজ্ঞান
প্রতিষ্ঠান : ইউনিভার্সিটি প্যারিস-সুড
পরিচিতি : জায়ান্ট ম্যাগনেটোরেজিস্টেন্স এফেক্ট এর ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি
পিটার গ্রুনবার্গ বৃত্তান্ত
পিটার গ্রুনবার্গ একজন জার্মান পদার্থবিদ। তিনি আলবার্ট ফার্ট এর সঙ্গে যুগপৎ নোবেল পুরস্কার পান জায়ান্ট ম্যাগনেটোরেজিস্টেন্স আবিস্কারের জন্যে।
গ্রুনবার্গ জার্মানীর পিলসেনে জন্মগ্রহন করেন, যা কিনা নাৎসী অধ্যুষিত বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়ার আশ্রিত রাজ্য হিসেবে ছিল। বর্তমানে এটি চেক রিপাবলিকের অন্তর্গত। তাঁর বাবা ছিলেন একজন প্রকৌশলী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি পরিবারসহ হেসে এর লটারব্যাচ চলে আসেন।
গ্রুনবার্গ 'জোহান ওলফগ্যাং গোথে ইউনিভার্সিটি' থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৬২ সালে।
তাপর তিনি জার্মানীর 'ডার্মস্ট্যাড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি' থেকে পদার্থবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা করেন ১৯৬৬ সালে। একই ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৬৯ সালে তিনি পিএইচডি লাভ করেন। কানাডার অটোয়াতে অবসি'ত 'কার্লিটন ইউনিভার্সিটি'তে ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত পোষ্ট ডক্টরাল কাজ করেন। তারপর তিনি 'জুলিচ রিসার্চ সেন্টারে' যোগ দেন। এখানে তিনি ২০০৪ সাল পর্যন্ত চিকন ফিল্ম এবং মাল্টিলেয়ার ম্যাগনেটিজম ক্ষেত্রের প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করেন।
।
গ্রুনবার্গের গুরুত্বপূর্ণ কাজ
১৯৮৬ সালে এন্টিপ্যারালাল এক্সচেঞ্জ কাপলিং ফেরোম্যাগনেটিক লেয়ার আবিস্কার করেন, যা চিকন নন-ফেরোম্যাগনেটিক লেয়ার দ্বারা পৃথক। জায়ান্ট ম্যাগনেটোরেজিস্টেন্স এফেক্ট (জিএমআর) আবিস্কার করেন ১৯৮৮ সালে যার মাধ্যমে মাল্টিপল লেয়ারগুলোকে একসঙ্গে যুগলবন্দী করা যায়।
গ্রুনবার্গের নির্বাচিত প্রকাশনা
তাঁর মোট ১০ টি প্রকাশনা আছে। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে :
"দ্য ম্যাগনেটো-অপটিক্যাল এফেক্ট অফ সিআর (০০১) ওয়েজ্ড আলট্রাথিন ফিল্মস গ্রোন অন এফই(০০১)"।
১৯৯৭ সাল।
"লং রেঞ্জ এক্সচেঞ্জ ইন্টার্যাকশনস ইন এপিটাক্সিয়াল লেয়ার্ড ম্যাগনেটিক স্ট্রাকচারস"। ১৯৯৬ সাল।
"এনহ্যান্সড ম্যাগনেটোরেজিস্টেন্স ইন এফই-সিআর লেয়ার্ড স্ট্রাকচারস উইথ এন্টিফেরোম্যাগনেটিক ইন্টারলেয়ার এক্সচেঞ্জ"। ১৯৮৯ সাল।
এক নজরে পিটার গ্রুনবার্গ
জন্ম : ১৮ মে, ১৯৩৯ সাল। পিলসেন, বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়া এর আশ্রিত রাজ্য।
বয়স : ৬৮
জাতীয়তা : জর্মন
কাজের ক্ষেত্র : পদার্থবিজ্ঞান
প্রতিষ্ঠান : কার্লিটন ইউনিভার্সিটি
জুলিচ রিসার্চ সেন্টার
ইউনিভার্সিটি অফ কোলংনি
গুরুসদন : ডার্মস্ট্যাড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি
একাডেমিক এ্যাডভাইসর : স্টিফ্যান হাফনার
পরিচিতি : জায়ান্ট ম্যাগনেটোরেজিস্টেন্স এফেক্ট এর ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি
পুরস্কারসমূহ : ওলফ পুরস্কার (পদার্থবিজ্ঞান) (২০০৬)
বর্ষসেরা ইউরোপিয়ান আবিষ্কারক (২০০৬)
জাপান পুরস্কার (২০০৭)
নোবেল পুরস্কার (পদার্থবিজ্ঞান) (২০০৭)
ফুটনোট ১: পুরস্কারের মোট অর্থ ১০ মিলিয়ন স্যুইডিস ক্রোনার দুইজন পুরস্কার প্রাপ্তদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হবে।
ফুটনোট ২: রয়্যাল সুইডিস একাডেমি অফ সায়েন্সেস একটি স্বাধীন সংগঠন হিসেবে ১৭৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য বিজ্ঞানকে উন্নত করা এবং সমাজে এর প্রভাবকে শক্তিশালী করা।
ঐতিহ্যগতভাবে এটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং গণিতের উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে।
লিঙ্ক: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।