আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফরজ গোসল!


তিন দিনের জন্য তাবালীগে যাবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার...দীনের দাওয়াত দিতে আল্লার রাস্তায় তিন দিন! তবে এটি ধর্ম বিষয়ক কোন পোস্ট নয় বলে সে বিষয়ে বিষদ অবতারনা না করাই ভাল। তবে সব মিলিয়ে.... তাবলীগ-এর মুরুব্বীদের নিষ্ঠা, সততা ও বিশ্বাস দেখে আমি অবাক হয়েছি...শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছি। এবার কাজের কথায় আসি। ওবায়েদ ভাই আমার পাড়ার বড় ভাই.... গতবার ভাল কোন ভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ পাননি...এবার আবার আদা-জল খেয়ে লেখাপড়া করছেন, ভর্তি কোচিং করছেন! আর... আমি তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায় দিন গুনছি। দু'জনই তখন নিয়মিত আছর আর মাগরিব...এই দুই ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামাতে পড়ি... আর ভাল রেজাল্ট-এর জন্য আল্লাহ আল্লাহ করি! এহেন আমরা দুই কুতুব.....পাড়ার এক মুরুব্বীর চোখে পরে গেলাম।

একরকম বাধ্য হয়েই তিনদিনের জন্য তাবলীগে যেতে সম্মত হলাম। প্রথমে কাকরাইল মসজিদ..তারপর ঐ দিনই সন্ধ্যায় মানিকনগর জামে মসজিদ। আমি বলছি ১৯৮৩ সালের কথা.... তখন মানিকনগর এত জনবহুল এলাকা ছিলনা.... সবে আশ-পাশের এলাকা ডেভলপ হতে শুরু করেছে মাত্র। প্রথম দিনেই কুলুখ নেয়ার কায়দাটা শিখে গেলাম! তারপর যথারিতী আছরের পর গাস্ত, মাগরেবের পর বয়ান, আর.... এশার পর তালীম। প্রথম দিনেই গাস্ত-এ গিয়ে মজার একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম।

তাবলীগ বিষয়ে যারা অবগত নন, তাঁদের জন্য এখানে একটু বলে নেয়া ভাল...... সাধারণতঃ আছর নামাজের পর তাবলীগের একটা দল দীনের দাওয়াত দিতে বের হয়। সারিবদ্ধভাবে রাস্তার এক পাশ দিয়ে হেঁটে চলে দলটা...একেই বলে গাস্ত-এ বের হওয়া। সারির একবোরে সম্মুখে থাকেন রাহুবার, যিনি একজন স্থানীয় বাসিন্দা এবং তিনিই এলাকার লোকজনকে মুতাকাল্লিম-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। মুতাকাল্লিম-এর কাজ হলো... পরিচয় পর্বের পর সেই লোককে ধর্মের কথা বলা এবং দীনের পথে আসতে আহবান (দাওয়াত) জানানো। আর সারির একবারে শেষে থাকেন দলের নেতা বা আমীর।

তিনি সারির একেবারে পিছনে থেকে দলকে পরিচালনা করেন। আমীর যদি পেছন থেকে বলেন..'' বাঁয়ে চেপে চলি ভাই...ডানে কাঁদা''; তার মানে বুঝতে হবে... ডানে রাস্তা কর্দমাক্ত...আরও একটু বাঁয়ে চেপে হাঁটতে হবে। প্রথম দিনের গাস্তের এক সময় হঠাৎ আমীর বল্লেন...'' ডানে না তাকাই ভাই"। তার মানে হচ্ছে ডানে তাকানো যাবেনা। কিন্তু আমি আঁড়চোখে ডানে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম...বোঝার চেষ্টা করলাম, হেতুটা কি?! দেখি....চমৎকার একটা সুন্দরী মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে! আমীর আরও উচ্চস্বরে বল্লেন...'' ডানে ফেতনা ফাতের.... ডানে না তাকাই ভাই''।

আমি বুঝে গেলাম.... আমি যদি কোন কারনে মিস-ও করি, আমীর সাহেব এরকম আওয়াজ দিলেই ডান দিকে তাকাতে হবে...তাতে ফায়দা আছে! আমার এই অবাধ্য আচরণের জন্য... রাতে আমীর সাহেব আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে কথা বললেন, আমাকে অবশ্য পালনীয় বিষয়ে আরও বিষদ বুঝানোর প্রয়াস পেলেন। আমি বল্লাম..'' হুজুর, ডানে না তাকানোর জন্য আপনি আহবান জানাচ্ছেন বটে...কিন্তু আপনি-তো ঠিকই দেখে নিচ্ছেন!" আমীর সাহেব রাগ করলেন না... আমার মত নালায়েক-কে দীনের পথে আনার জন্য তাঁর কি অসীম ধৈর্য! তিনি বল্লেন..."একবার দেখা জায়েয আছে"। পরের দিন যথাসময়ে আবারও গাস্ত-এ বের হয়েছি! এবার আমি যা দেখার... একবারেই ভালভাবে দেখে নেবার নিয়ত পাক্কা করলাম.... একবার দেখা জায়েয! দেখার মত কোন কিছু যেন বাদ না যায়.... তজ্জন্য তৎপর হলাম! তাঁর কথার গলদ ফায়দা নেয়ায় আমীর সাহেব মাইন্ড করলেন.... কিন্তু কিছু বললেন না। গাস্ত থেকে ফিরেই তিনি এলান করলেন...... '' আগামী কাল নাদিম হবে মুতাকাল্লিম''। আমি ধরা! কান্নাকাটি অবস্থা! ওবায়েদ ভাই-এর সাথে আলোচনা করে রাতেই ঠিক করে রাখলাম... দীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে কি কি বলা যেতে পারে।

আছর থেকে মাগরেব পর্যন্ত গাস্ত চললো... রাহুবার এক একজন করে স্থানীয় লোকজনের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আমি পরিচিত হয়ে হাত মেলাই (হাত আর ছাড়িনা).....'' মাগরীব-এর পর ঈমান ও আখলাক-এর উপর জরুরী বয়ান হবে ভাই। আমরা সকলেই শরীক হওয়ার চেষ্টা করি.... আল্লাহ-কে যদি রাজি-খুশি করতে পারি, তবে আখেরে বহুত ফায়দা!''। আমীর সাহেব আজ আমার উপর খুশি হলেন, বাহাবা দিলেন। নবীশ মুতাকাল্লিম হিসেবে পারফর্মেন্স তাহলে একবারে খারাপ হয়নি... আত্মতৃপ্তি অনুভব করলাম।

মাগরেবের পর ভাল করে খেয়াল করলাম....বয়ানে উপস্থিত মুসুল্লীদের সবার চেহারা মোবারক খুঁটে খুঁটে দেখতে লাগলো আমার উৎসুক চোখ! আমার পারফর্মেন্সের আলটিমেট ফলাফল ...একবারে 'শুন্য"! যাদের আজ বিকালে দাওয়াত দিয়ে এসেছি...তাদের একজনও বয়ান শুনতে বসেননি! আমি হতাশ হলাম! তিন দিন পার হয়ে গেছে। এশা'র পর তালীম শুনে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছি। কাল ফজর নামাজ পড়েই বাসায় ফিরে যাব। মসজিদের মেঝেতে চাদর বিছিয়ে কম্বল গায়ে ঘুমাতে একটু কষ্ট হলেও... খারাপ লাগতোনা। ওবায়েদ ভাই-এর সাথে টুক টুক করে গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি মনে নেই।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। আশে পাশে কিছু একটা নড়াচড়ার শব্দেই ঘুম ভেঙেছে বুঝতে পারি। তখনও রাতের আকাশ অন্ধকার! আন্দাজ করি.... ভোর হতে এখনও খানিকটা বাকি। বাম দিকে পাশ ফিরে দেখি ওবায়েদ ভাই দাঁড়িয়ে উবু হয়ে কিছু একটা করছেন। অবাক হয়ে দেখলাম...ওবায়েদ ভাই মসজিদের মেঝেতে প্রথমে একটা গামছা পাতছেন, গামছার উপর দাঁড়িয়ে তারপর একটা লুঙ্গি পাতছেন।

তারপর লুঙ্গির উপর দাঁড়িয়ে আবার গামছা পাতছেন...এবং এভাবে উনি মসজিদের মেঝেতে শরীর স্পর্শ না করে গামছা-লুঙ্গী, লুঙ্গী-গামছা করে মসজিদের দরজার দিকে গেলেন। তারপর দরজার ওপাশে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। আমি অবাক তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে চেয়ে চেয়ে দেখলাম! ঘুমের ঘোরে ওবায়েদ ভাইয়ের অপকর্ম-টা যে কি হয়েছে...আমি তখনও ঠাওর করতে পারিনি! পাঁচ-সাত মিনিট পরে আমিও ওবায়েদ ভাইয়ের পিছু নিলাম। মসজিদের টয়লেটের দিকটায় গিয়ে দেখলাম ....ওবায়েদ ভাই মাত্র গোসল করে গামছা দিয়ে শরীর মুছছেন। ৬০ ওয়াটের একটা ঘোলাটে বাল্বের আলোয় পরিস্কার দেখলাম.... প্রচন্ড শীতে তিনি ঠক-ঠক করে কাঁপছেন! শীতে খালি গায়ে জুবুথুবু অবস্থা...হুহুহু...কাঁপাকাঁপি! আমাকে দেখে অপ্রস্তুত হলেন।

আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ইতস্তত ভঙ্গিতে অস্ফুট গলায় বললেন...'ফরজ গোসল'! 'ফরজ গোসল' কি জিনিস... এই শর্মা তখনও তা বোঝেই না! সেদিনই প্রথম শুনেছিলাম এই আজব কথাটা! এখন বুঝি, শীতের সকালে... ফরজ গোসল.....কাহাকে বলে..কত প্রকার ও কি কি!?! সময় হলে.... আপনারাও বুঝবেন! শুভ কামনা!
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।