১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ তারিখটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? প্রশ্নটা শুনলে ইতিহাসের যে কোন ছাত্রই হয়ত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠবেন— কেন, ওই দিনইতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। যারা একটু বেশি মন দিয়ে পড়েছেন তারা হয়ত বুক ফুলিয়ে সময়টাও বলে দেবেন। কলারে একটা ঝাকুনি দিয়ে হয়ত বলে বসবেন, ঠিক ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে জার্মান যুদ্ধজাহাজ শ্লেসউইগ হলস্টেইনের কামানগুলো পোল্যান্ডের ওয়েস্টারপ্লাট নৌঘাঁটিতে গোলাবমি শুরু করে। এরপরই শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
হ্যা, এমনটাই এতদিন জেনে এসেছে গোটা বিশ্ব।
যুদ্ধ শুরুর সময় ভোর পৌনে ছয়টায় বলে নািস নায়ক হিটলারও দাবি করেছিলেন। কিন্তু, হেরমানের জবাব, এটা ডাহা মিথ্যা। প্রথম গোলাতো আমরাই ছুড়েছিলাম। সময়টা ছিল ৪ টা ২০। তারপর? জীবন্ত ইতিহাসের মুখ থেকে গল্প শোনার আগ্রহ কে-ই বা ছাড়তে পারে? আগ্রহ হেরমানেরও কম না।
কিছুটা অনুশোচনা থেকেই হয়ত ভুলে ভরা ইতিহাসের বাঁকগুলো শুধরে দিতে চান।
‘হিটলারের অজস্র মিথ্যার এটাও অন্যতম। লড়াই শুরুর সময় আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। প্রথম গোলা তো আমরাই ছুড়েছিলাম। ’— দাবি শতবর্ষে পা রাখা নািস যোদ্ধা হেরমান গারডুর।
সে-ই তো শ্লেসউইগ হলস্টেইনের একমাত্র জীবিত সেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ২৭ বছরের টগবগে যুবক হেরমানের কথা— যুদ্ধটা ভোর ৫ টা ৪৫ মিনিটে নয়, শুরু হয়েছিল আরও ৫৫ মিনিট আগে।
সাত দশক পার হয়ে গেছে, তবুও সাবেক যোদ্ধার স্মৃতিপটে একটুও মলিন হয়নি লড়াইয়ের অজস্র ঘটনা। মাত্র ৫০০ গজ দূর থেকে কীভাবে কামান দেগে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ওয়েস্টারপ্লাট— বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন তিনি। গল্প বলে উড়িয়েও দেওয়া যায় না হেরমানের দাবিকে।
১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯-এ যে ক’জন জার্মান সেনা হাজির ছিলেন শ্লেসউইগ হলস্টেইনের ডেকে, তাদের মধ্যে যে হেরমানও ছিলেন।
ঘটনার ৭৩ বছর পর হেরমান ইতিহাসটাকে একটু ঝাকুনি দেওয়ায় ইতিহাসবোদ্ধারাও একটু নড়েচড়ে বসেছেন। ঘাটতে শুরু করেছেন পুরনো যতসব দলিল-পত্র। তাহলে এতদিনের যত জানা তার সবই কি ভুল? বলে চললেন, না, সময়টা ভোর ৫টা ৪৫ নয়, ওটা হবে ভোর ৪টা ৫০। পোল্যান্ডের ওয়েস্টারপ্লাট নৌঘাঁটি থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরে জার্মান যুদ্ধজাহাজ শ্লেসউইগ হলস্টেইন।
নৌঘাঁটিতে তখন দু’চার জন নৌ-সেনা হয়ত তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে দায়সারা ডিউটি পালন করছিলেন। আবছা আলোয় বাইনোকুলারের নব ঘুরিয়ে পুরো নৌ-ঘাটিটিকে মনে হচ্ছিল ঘুমন্ত পুরী। আমরা জাহাজের ডেকে কামানের পেছনে দাড়িয়ে নিঃশব্দ অপেক্ষায়- কখন অর্ডার আসবে। ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে ওয়ারলেসে ভেসে আসল বার্তা। মুহূর্তের মধ্যে পোড়া কয়লায় পরিণত হল নৌ-ঘাটিটি।
স্মৃতিচারণ করতে করতে ঝাপসা হয়ে আসছিল শতবর্ষে পা রাখা হেরমান গারডুর চোখ দু’টি। সাত দশক পরও স্বজন হারানোর বেদনা তাকে তাড়িয়ে ফেরে। দ্ব্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হয়ে যে কয়েক লাখ অনামি হাতিয়ার ধরেছিলেন, হেরমান তাদের অন্যতম। একের পর এক জয়ের সংবাদ জানিয়েছেন কমাণ্ডারকে। ১৯৪১ সালে হেরমানকে বদলি করা হয় অন্য এক যুদ্ধজাহাজ বিসমার্কে।
ওই বছরই ব্রিটিশ রণতরী রডনির আক্রমণে সলিলসমাধি হয় বিসমার্কের। হেরমান গারডু ছাড়া রক্ষা পেয়েছিলেন হাতেগোনা কয়েক জন। তিন বছর পর আবারও নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হন এই জার্মান সেনা। ততোদিনে তিনি ফিরে গেছেন শ্লেসউইগ হলস্টেইনের সেই পুরনো ডেকে। রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বোমার আঘাতে কমপক্ষে ৮০০ নাবিকসহ ডুবে যায় ওই জাহাজটিও।
মিত্রশক্তির হাতে বন্দী হন হেরমান। প্রথমে ব্রিটেন, পরে আমেরিকার কারাগারে বন্দি অবস্থায় কাটিয়ে দেন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো বছর।
জীবনের পড়ন্ত বেলায় অনুশোচনার আগুনে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছেন হেরমান গারডু। মনে করেন, যে যুদ্ধ লাখো মানুষের মৃত্যু ডেকে আনে, চোখের জলে ভাসায় স্বজনদের তা কখনও কল্যানের হতে পারে না। আফসোস- যে যুদ্ধ সারা পৃথিবীকে বদ্ধভূমিতে পরিণত করল তা শুরুর সময় নিয়ে এত বড় একটা ভুল কিভাবে ইতিহাসবিদদের নজর এড়িয়ে গেল।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।