আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২০ জানুয়ারি পল্টন বোমা-হত্যাকাণ্ড দিবস

সত্য সব সময়ই সত্য, তবে আপেক্ষিকতার নিরিখে।

২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি। রাজধানীর ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে কমিউনিস্ট পার্টির মহাসমাবেশ। সারা দেশ থেকে কৃষক-শ্রমিক-ক্ষেতমজুর-শ্রমজীবী-পেশাজীবী লাখো মানুষ সমবেত হয়েছেন নতুন দিক-নির্দেশনায় উজ্জীবিত হয়ে শোষণমুক্তির সংগ্রাম শক্তিশালী করার প্রত্যয়ে। সেদিন পল্টন ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য।

শুধু সিপিবির সদস্য, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীরাই নন, হাজার হাজার সাধারণ মানুষও সেদিন সমবেত হয়েছিলন প্রচলিত রাজনীতির বৃত্ত ভেঙ্গে শুভ ও সুন্দর রাজনীতির প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করতে। এসেছিলেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট নাগরিকরা। সেই সমাবেশ স্বপ্ন দেখিয়েছিল নতুন দিনের। সমাজ বদলের। লাখো মানুষের সমবেত শ্লোগান জানান দিয়েছিল জনতার ঐক্যবদ্ধ শক্তির।

আর তাতেই ভীত হয়ে উঠেছিল প্রগতিবিরোধী অন্ধকারের শক্তি। বিপুল জনসমাবেশে শক্তিশালী বোমা পেতে রেখে তা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ব্যাপক প্রাণহানীর ঘটনা ঘটানো হয়। এতে তাৎক্ষণিক কমরেড হিমাংশু-মজিদ-হাশেম-মোক্তার-বিপ্রদা নিহত হন। এদেশে বোমা হামলা শুরু হয় ১৯৯৯ সালের মার্চে যশোরের উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। এরপর থেকে যে সকল জনসমাবেশে বোমা বিস্ফোরণের নৃশংস ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় প্রতিটিই ছিল সাম্রাজ্যবাদ, মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল সামপ্রদায়িক শক্তি সংগঠিত হামলা।

পল্টনে সিপিবির লাখ জনতার মহাসমাবেশ ছিল এই অপশক্তির জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। উদীচীর সম্মেলন ছিল অপশক্তির বিরুদ্ধে শোষিত-বঞ্চিত প্রগতিশীল মানুষের গণজোয়ারের আহ্বান। আবহমানকাল থেকে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বাঙালি বাংলা নববর্ষকে বরণ করে আসছে। রমনার বটমূলের বর্ষবরণ মেলাই শুধু নয়, বাঙালি সংস্কৃতির সকল আচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বরাবরই প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে চলেছে। সিনেমা হল, ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসী উপাসনালয়, বিভিন্ন মত ও পথের রাজনৈতিক চর্চা মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কখনই মেনে নিতে পারে না।

এই অপশক্তির বিরুদ্ধে গড়ে উঠা যে কোনো প্রতিবাদ প্রতিরোধকে ভেঙে দিতেই এ ধরনের বোমা হামলাগুলো চালানো হয়েছে। পল্টন ময়দানে সিপিবির মহাসমাবেশের লক্ষ্যও ছিল সাম্রাজ্যবাদ, সামপ্রদায়িকতা এবং লুটপাটতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা। সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন নিয়ে মিছিলে-শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে একের পর এক জনতার কাফেলার আগমনে পল্টন ময়দান যখন উপচে পড়ছিল, তখন অপশক্তিও প্রস্তুতি নিচ্ছিল মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার। ঘড়ির কাটায় ৫টা ১০ মিনিট। মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম নেতা কমরেড মোর্শেদ আলী।

ঠিক- তখনি হঠাৎ সমাবেশস্থলে গর্জে উঠল ঘাতকের বোমা। বিস্ফোরিত বোমার সিপ্রন্টারের আঘাতে লুটিয়ে পড়ল একদল বিপ্লবী। জরাজীর্ণ সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়ার সংগ্রামে শহীদদের তালিকায় যুক্ত হলো কমরেড হিমাংশু-মজিদ-হাশেম-মোক্তার-বিপ্রদাসের নাম। ঘাতক বোমার আঘাতে জীবন দিলেও সেদিন কাস্তে-হাতুড়ি খচিত মুক্তির লালপতাকা হাতছাড়া করেননি কমরেড হিমাংশু মণ্ডল। দীর্ঘ ৯ বছরেও পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র মহাসমাবেশে বোমা হামলা ও হত্যা কাণ্ডের তদন্ত শেষ করতে পারে নি পুলিশ।

শুধু তাই নয়, কমরেড হিমাংশু, মজিদ, মোক্তার, হাশেম ও বিপ্রদাসের জীবন কেড়ে নেয়া ওই বর্বর ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করারও নানা অপচেষ্টা করা হয়েছে। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে পল্টন হত্যা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেয়ারও চেষ্টা হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে পুনরায় মামলার তদন্ত শুরু হয়। পরবর্তীতে বোমা হামলার নেপথ্যের কিছু কিছু তথ্য বেরিয়ে এলেও এখনো তদন্ত শেষ করতে পারে নি গোয়েন্দারা। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, পল্টন ময়দানে সিপিবির মহাসমাবেশে বোমা হামলা ও হত্য কাণ্ডের মামলাটি বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)’র তদন্তাধীন রয়েছে।

জোট সরকারের আমলেও একই বিভাগ মামলার তদন্তের দায়িত্বে ছিল। বিভিন্ন সময়ে সিআইডির ৭ জন কর্মকর্তা মামলাটির তদন্ত করেন। তবে বিগত জোট সরকারের আমলে সত্য উদঘাটনের চেয়ে মামলাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাই ছিল প্রধান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় মামলার তদন্ত শুরু হলে বোমা হামলার পেছনে মুফতি হান্নানের হরকাতুল জেহাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা ইতোমধ্যে ২০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।

এ তালিকায় আগের তিন তদন্ত কর্মকর্তাও রয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে আটক জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা যে তথ্য পেয়েছেন তাতে দেখা যায়, সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার পরিকল্পনা ছিল দীর্ঘদিনের। প্রশিক্ষিত জঙ্গিরাই এ হামলায় অংশ নেয়। হামলার আগে চট্রগ্রামের উখিয়ার একটি জঙ্গি ক্যাম্পে মুফতি মাওলানা আব্দুস সালামের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি জঙ্গি দল বোমা হামলা ও বিস্ফোরক বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়। ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি বিকাল ৫টায় রাজধানীর পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে ভয়াবহ বোমা হামলা চালানো হয়।

হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ২২ জানুয়ারি পুলিশ ৯ জনকে গ্রেফতার করে। ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩ সদস্যের তদনত্ম কমিটি গঠন করে। ২০০৩ সালে বিএনপি-জামাত জোটের শাসনামলে ওই তদন্ত কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই সময়ই তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপত্তি ওঠে। পরবর্তীতে বিএনপি-জামাত সরকার তদনেত্মর নামে মামলা হিমাগারে পাঠিয়ে দেয়।

শুধু তাই নয়, মামলায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৪ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতিও দেয়া হয়। এমনকি হামলার বিষয়টি দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দলের জের ধরে এ ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পরবর্তীতে উচ্চ আদালত মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন। মামলার সপ্তম তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসাবে বর্তমানে সিআইডির পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) মৃণাল কান্তি সাহা তদন্তের দায়িত্বে আছেন।

দ্রুত মামলাটির চার্জশিট দাখিলের চেষ্টা চলছে বলে তিনি পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।