বাংলার আলো-জলে ধূলো মেখে বেড়ে ওঠা মুক্তি
ক্রসফায়ার সমর্থনকারী মিডিয়ার ভূমিকা ঃ
ক্রসফায়ারে বাপ্পী হত্যার পর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা বাপ্পীকে সন্ত্রাসী অবিহিত করে সংবাদ পরিবেশন করে। পরে অবশ্য তারা এজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। এই হলো আমাদের মিডিয়া।
৩৭ বছরের বাংলাদেশে সরকার সমর্থিত মিডিয়াকর্মীরা জনগণকে বারবার জানান দিয়েছে দেশের আলোচিত দুইটি বিভাগ সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। উক্ত জনপদের জনগণ এসব বেআইনি, নিষিদ্ধ দলের কাছে জিম্মি।
অভিযোগকে কয়েকটি পয়েন্টে বিভক্ত করে কিছু পর্যালোচনা আমরা করতে পারি।
প্রথমত, ৩৭ বছরের বাংলাদেশে কোন সরকার, কত সালের, কোন তারিখে, কত নম্বর আইনি প্রজ্ঞাপন জারি করাসহ সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে উল্লিখিত দলগুলোকে বেআইনি এবং তাদের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে? তাছাড়া, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমাদেরকে নির্দিষ্ট করে এবং আইনি প্রজ্ঞাপন জারি করে আজো জানানো হয় নি আলোচিত রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশ আমলে।
পত্রিকাগুলোতে আলোচিত এসব দলকে নিষিদ্ধ ঘোষিত বেআইনি দল এবং ওইসব দলের রাজনৈতিক কার্যক্রমকে নিছক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও র্যারের গুলিতে কেউ মারা গেলেই তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করতে দেখেছি বলেই প্রশ্নটা আসছে।
এখন প্রশ্ন হলো ৩৭ বছরের বাংলাদেশে যদি কোনো সরকার আইনি প্রজ্ঞাপন জারি করে আলোচিত দলগুলোকে বে-আইনি এবং ওইসব দলের রাজনৈতিক কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি না-দিয়ে থাকে তাহলে, মিডিয়াগুলোর সম্পাদক ও সংবাদকর্মী বা র্যাব পুলিশের কর্মকর্তারা ঘোষণা দিলেই কি দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যাবে ?কেউ অপরাধ না করেও যদি র্যাবের লিস্টেড হয়ে যায় তবে তাকে অপরাধী বলার অধিকার কে দিয়েছে মিডিয়াকে? জনগণের দিক থেকে এ প্রশ্নটা উত্থাপন হতেই পারে?
একইভাবে কে দিয়েছে মিডিয়া কর্মকর্তাদের এ-ধরনের প্রপাগান্ডা চালানোর অধিকার? তাদের ঘোষিত এসব কর্মকান্ড ও প্রচারণা কি সাংবিধানিকভাবে গণতন্ত্র রক্ষার নামে আধুনিক ফতোয়াবাজি নয়? সাংবিধানিকভাবেই কি তাদের এসব প্রচারণা সংবিধান পরিপন্থি এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে না?
তাছাড়া, প্রশ্নগুলো তোলা হলো এই করণে যে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে যত খুন হয়েছে, সেই সব খুনের প্রত্যক্ষ মদদ যুগিয়েছে মিডিয়ার রিপোর্ট বা প্রতিবেদনগুলো। সাংবাদিকদের সাথে কখা বলে জানা যায়, এবং এখনও তা করে চলেছে মিডিয়াগুলো।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডর পরিসংখ্যান ও ফলাফল ঃ
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক ) জরিপ অনুসারে , ২০০৯ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যা ২০০শ, ধর্ষণ ৪৩৯ নারী, সেনা হেফাজতে মৃত্য ৪৭ জন ।
২০০৮ সালে ১৭৫ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও ২০০৯ সালের অক্টোবরেই এ সংখ্যা দুইশ’ ছাড়িয়ে গেছে। সেনা হেফাজতে মারা গেছে ৪৭ জন। রাজনৈতিক সহিংসতা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ৩৭ জন নিহত হয়েছে।
এ সময়ে ১৭৫ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
পাশাপাশি ৩ জন নিহত হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার ৪৩৯ জন নারীর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ৬২ জনকে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার গত এক বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
অধিকারের ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়- ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৫১ জন ব্যক্তি নিহত ও ১৫৫৫৯ জন আহত হন।
পাশাপাশি এই এক বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছে ১৫৪ জন।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নিহত ১৫৪ জনের মধ্যে র্যাবের হাতে ৪১ জন, পুলিশের হাতে ৭৫ জন, যৌথভাবে র্যাব-পুলিশের হাতে ২৫ জন, সেনাবাহিনীর হাতে ৩ জন এবং আনসারের হাতে ২ জন, জেল পুলিশের হাতে ১ জন, বনরক্ষীদের হাতে ১ জন, বিডিআর’র হেফাজতে ৫ জন এবং কোস্টগার্ডের হাতে ১ জন নিহত হয়েছে।
উল্লিখিত ১৫৪ জনের মধ্যে ৩৫ জন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে থাকাকালে মারা গেছেন। তাছাড়া বিডিআর বিদ্রোহের পর থেকে ৩১ শে ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত মোট ৫১ জন বিডিআর সদস্য মারা গেছেন। এর মধ্যে হেফাজতে মারা গেছেন ২৬ জন। উক্ত ২৬ জনের মধ্যে ৬ জন নির্যাতনে মারা গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে,২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সালের মে পর্যন্ত বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড হয়েছে ১২৫২ জনের, আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ৫৫৮ জনের কথা।
তারপরও ২০০৯ সালে আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বছরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন কোন উন্নতি চোখে পড়েনি। তারমানে ক্রসফায়ার চলছে এবং সেইসাথে চলছে অপরাধ বৃদ্ধির প্রবনতা।
মানবাধিকার ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঃ
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে হত্যা সন্ত্রাস আর আতঙ্ক ছড়িয়ে সাধারন মানুষদের পরিনত করা হচ্ছে তাদের সহজ লক্ষ্য বস্ততে। সাধারন নাগরিক হিসাবে আমি রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা চাই- ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিচার চাই-যে আমার ক্ষতি করেছে তার শাস্তি চাই।
আর এই চাওয়াটা আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে- আমার মানবাধিকার । আমরা জানি না এ থেকে আমাদের নিজদের-আমাদের পরিবার- আমাদের শিশুদের বাঁচানোর কার্যকর পন্থা কি? মানবতার বিরুদ্ধে মানুষদের লাশের উপর দাড়িয়ে যারা তাদের লক্ষ্য হাসিলের রাস্তা খুঁজে নিচ্ছে- তাদের আমরা কি ভাবে মোকাবিলা করবো???
র্যাবের মহাপরিচালক কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থাকে বলেছেন, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ভূল হয়ে গেছে। এজন্য তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। এগুলো জনসমক্ষে প্রচার করলে র্যাব, পুলিশ নৈতিক মনোবল হারাবে।
আমার কথা হলো, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেনা ।
এতে সাধারণ জণগনও আইন নিজের হাতে তুলে নেবে। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে আদালতের দরকার কি। মামলার দরকার হবেনা। আইন বলে দেশে কিছু থাকবেনা। অপরাধীর অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত।
তবে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। বিচারে ফাঁিস হলে তাকে অবশ্যই ফাঁসি দিতে হবে।
দেশে ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা পরোপুরি কার্যকর করতে না পারায় রাষ্ট্র হত্যাকারীদের দায়মুক্তির সুযোগে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটে চলছে। এ ঘটনা মানবাধিকারের সুষ্পষ্ট লংঘন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তিও এতে ক্ষুণœ হয়।
এ কারণে দেশের স্বাধীনত লাভের পর এ পর্যন্ত যত বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটেছে তার বিচার হওয়া প্রয়োজন।
ক্রসফায়ারের কাছে নতজানু বিচার বিভাগ :
বিচার বিভাগের বাইরে কোন বিভাগ কারো বিচার করার অধিকার রাখে না। আমার কথা হলো, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেনা । এতে সাধারণ জণগনও আইন নিজের হাতে তুলে নেবে। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে আদালতের দরকার কি।
মামলার দরকার হবেনা। আইন বলে দেশে কিছু থাকবেনা।
সেই সভ্যতার ঊষা লগ্ন থেকে সভ্যতা অটুট রাখার জন্য আইন প্রণয়ন করেছে মানুষ, তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। সেই আইনে এক জনও নিরপরাধ মানুষ যেন সাজা না পায় তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের টাকায় বছরের পর বছর বিচারপতিগণ শিক্ষা লাভ করেছেন। তারা যেন ভুল না করেন সেজন্য নানাবিধ সামাজিক যাচাই-বাছাই শেষেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তাদের কলমের খোঁচায় যেন একজন নিরপরাধ মানুষের ফাঁসি না হয় সেজন্য তারা দিনের পর দিন যুক্তিতর্ক, সাওয়াল জবাব এবং পূঙ্খানুপূঙ্খরূপে একজনের অপরাধ তুল্য দন্ডে ফেলে পুনঃপুনঃ যাচাইয়ের পরই তার শাস্তি নিশ্চিত করেন। ক্রসফয়ারেই সব সমাধান হলে আইন বিভাগের পিছনে সরকারের এত টাকা অপব্যয় করার দরকার কি?????
শেষকথাঃ
আমরা ক্রসফায়ারে নিহত লাশগুলোর ছবি দেখি পত্র-পত্রিকায় । কোন নিহত ব্যক্তির পিছনে গুলি দেখা যায়না। একই সাজানো কাহিনী-একই ক্লাইমেক্স-একই উপসংহার। লাশের মিছিল বাড়ছেই।
সিরিয়াল কিলিং চলছে এখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়।
লোকজন ক্রস ফায়ারে খুশী হয় এটা ঠিক। তবে এর কারণ রয়েছে। তারা সন্ত্রাস নির্মূল চায়। সন্ত্রাসীদের সুষ্ঠু বিচার হলেই কোন মানুষকে আর মারতে হবেনা।
প্রতিটি হত্যার দায়ভার নিতে হবে এই রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রের শাসকদেরকে, কেননা যে সরকার তার সাংসদদের দিয়ে আইন বানিয়ে সেই আইন প্রতিষ্ঠা করার জন্য আদালত বানিয়ে সেই আদালতে সুশিক্ষিত বিচারক এবং আইনজীবী বসিয়ে রেখেছে, সেই আইনের আওতায় আনার জন্য জনগণের করের টাকায় বিভিন্ন বাহিনী তৈরি করা হয়েছে, সেই বাহিনীর কাজ কি হবে তা নির্ধারণের জন্য সরকারী একাধিক দপ্তর খুলে রাখা হয়েছে, সমাজের যে শিক্ষিত অংশ বা সুশীল সমাজ বা এলিট ক্ষমতাবান শ্রেণী যে আইন আর সংবিধানের সমর্থক-হেফাজতকারী, যারা এই রাষ্ট্রটিকে আধুনিক বলে আরো আধুনিক করার জন্য ‘জনগণের’ জান-মাল রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের প্রত্যেককেই এই ‘ক্রসফায়ার’ বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের দায়ভার নিতে হবে।
সেটা যতদিন না হবে ততদিন এই রাষ্ট্র বা এই সমাজকে কোন ভাবেই কলঙ্কমুক্ত করা যাবেনা। রাষ্ট্র দিন দিন মধ্যযুগীয় বর্বর রাষ্ট্রের কলঙ্ক বহন করে চলবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।