কবিতা আসো এইখানে হও চরাচর
দাহ
ঘাস থেকে পতঙ্গের নিঃশ্বাস চুরি করেছিলে তুমি, প্রজাপতির পাখা থেকে
রোদ, কোকিলের কণ্ঠ থেকে কাকের ঈর্ষা
দাঁড়িয়ে এসেছো সারা পথ : আহা কান্তি, আর এই রাত? তুলোর ভেতর
ডুবে যেতে চায়।
হুকের বন্ধনে আঙুল... যে যুবক এসেছিলো, সে তোমার অনিচ্ছুক বুক
দুরন্ত শিশুর মতো চুষে পালিয়েছে সেই কবে... এখন সেখানে আয়না
মস্ত এক, সেও চুরি করে তোমার শরীর, প্রতিরাতে; তবুও নিজের কাছে
যাও, স্তনবৃন্তে ঝুলে আছে সেই ঠোঁট, আর, সেই কল্লোলিত করতল...
রাত্রি পুড়ে যায়, প্রতিবিম্বের দুঃখিত আগুনে।
-----------------------------------------------------------------
নিমজ্জন চিত্র
সে ফিরেছে তার জলমগ্ন ঘরে
মা ছিল নিদ্রিত সরল রেখায়, এসেছে শুভ্রতা থেকে
অন্ধকারে, অধমাঙ্গে অস্ত্রোপচারের পর; ‘ডেটলের গন্ধে
ঘুমোতে পারিনি সারারাত’- বলে ঊর্ধ্বমুখী হাই তুলে
নিমজ্জিত পুনরায়;
সে ফিরেছে চুক্তি-করা প্রেমিকের কাছ থেকে...
ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে, কিছু দূর, মর্মাপ্লুত আইসক্রিম, আপেল
আর হাই হিলে
‘এই নাও’- রাত্রিজাগা স্বর ব্যর্থ ঢেউ তোলে নিদ্রিত দেহের
দশ দিকে, দরজায় উঠে যাচ্ছে জল, আপেলের সব লাল
অন্ধকারে ঝরে যেতে থাকে,গড়ায় শুশ্রূষাকামী তলপেটে
গলছে আইসক্রিম;
‘এসছিস?’- নিদ্রাজড় চোখে কাঁপে জননীর শূন্য জলাশয়;
এখুনি কান্নার মধ্যে ডুবে যাবে সমস্ত দরজা
তার আগে একবার মেয়েটিকে যেতে হবে টয়লেটে...
--------------------------------------------------------------------------
অনিবার্য
একটি টিকটিকি
ছুটে গেলো আরেকটি টিকটিকির দিকে
একটি মোরগ প্রকাশ্য দুপুরে
উপগত হলো একটি মুরগির ওপর
একটি পাখির ঠোঁট
সংযুক্ত হলো আরেকটি পাখির ঠোঁটে
একটি কুকুর প্রকাশ্য উঠোনে
দখল করলো একটি কুকুরীর গুহ্যদেশ
একটি বিধবা
এইসব দৃশ্যকে পাহারা দিতে দিতে
স্বর্গে চলে যায়
--------------------------------------------------------------------
সিসিফাস
চূড়ায় উঠবো- একথা তো কখনো বলিনি
কেননা আমিও জানি যে পাহাড় মেঘে ডুবে থাকে
তার শীর্ষ কখনো-বা সমুদ্রেও নেমে যেতে পারে
রাত্রিগুলো ভিজেছিল অকালবৃষ্টির ছাটে
প্রকৃতিবিদের চোখে ঘুম নেই, দেহ ছিল বাতাসতাড়িত
তুমি ছিলে নিদ্রিত নদীর পাশে, চুলের তরঙ্গে-ঢাকা
নগ্নতার স্রোতে
ভুলে গেছি কতো আগে লঘুনাচে পেট-উরু-নাভিগহ্বর
জ্বলন্ত স্তম্ভের নিচে ভস্ম হয়েছিল
আর এই দৃশ্যহারা চোখ কঙ্কালের পদচ্ছাপ ধ’রে বহুদূর
সান্ত্বনারেখায় এসে স্থির;
চূড়ায় উঠবো- এ-দাবি তো করিনি কখনো
জলের উচ্চতা কতো, সারারাত উপত্যকা-মগ্নতার পরও বুঝিনি
তুমি বৃষ্টিতে বুজেছ চোখ, আর আমি শুষ্কতাকামী
তবুও দহন থেকে এ-শরীর বহুবার পালাতে চেয়েছে
গোলাকার পিচ্ছিল ও-মেঝে চুরমার ঘূর্ণিত তোমার
পায়ের মুদ্রায়
আর ভাসমান বাহুদের কেন্দ্র-লঙ্ঘন-করা বৃত্তের স্পর্শে
অন্ধ হয়েছি কতোবার
আলোর বলয় ঘেঁষে উড়ন্ত ও অস্থির পতঙ্গ আমি
স্নায়ুর পরিধি ছিঁড়ে বাতাসে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছি
চূড়ায় উঠেছে কেউ- এ কথা তো শুনিনি এখনো
পাদদেশে ডানাহারা বিষণœ পালক নেমে আসে ধীরে
নুড়ি ও পাথরে, সেই অবতরণের শব্দ অশ্রুত রয়ে যায়
পাখিদের কাছে
তারা শুধু সমুদ্রের ভাঁজ মন্থনের পর সবুজ ডাঙার দিকে
উড়ে আসে
এত জল, তবু স্মৃতিগুলো বাতাসমিশ্রিত, আর তাদের সমস্ত গান
কোলাহলে আদিগন্ত ঢেকে যায়
সেই সমুদ্রফেরত পাখিদের মুছে যাওয়া দেখে মনে পড়ে
একবার তোমার রক্তের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ অগ্নির সর্বোচ্চ লেলিহান
আরও উঁচু শূন্যে যে সূর্যাস্তের তীব্র লাল, আমার আঙুল
তাকে স্পর্শমাত্র খণ্ড-খণ্ড হয়ে পড়ে গেল, গেল ডুবে
উৎকণ্ঠ রাত্রির জলাশয়ে
এই আঙুলের পিছু-পিছু আমি আরো দূর নিচে, নক্ষত্রচ্যুত, অসাড়
আজ দেখো, বেদনার্ত রাজহাঁস এই কালো জলে তার শাদা গ্রীবা
আমর্ম ডুবিয়ে রাখে
চূড়ায় উঠেছি- এ-কথা তো ভাবিনি কখনো
আকাশের অনেক উঁচুতে এ-শরীর তবু সহাস্য উড়েছে সারারাত
প্রবল বৃষ্টির ভোরে উত্থিত মাংসের তাঁবু কী যে চায়
কাকে যেন ‘কাছে এসো, নেমে এসো’ বলে;
নিজেই এসেছে নেমে, পিপাসার্ত তার কাছে; সে তো কোনো
চূড়ায় ওঠে নি
-----------------------------------------------------------------------
বিলাসিতা
তিনি সবকিছু অগ্রিম চাইতেন:
বৃক্ষের আগে ফল,
সন্ধ্যার আগে চাঁদ–
নিদ্রার আগে স্বপ্ন আর
সূর্যের আগে সকাল।
বিয়ের আগেই তিনি সন্তান চাইলেন,
তার প্রেমিকা গর্ভবতী হলো।
ঘরের আগে চাইলেন জানালা–
আয়তাকার কাঠের ফ্রেমগুলো খুব
দুলতে লাগলো শূন্যে; আর
ছাদের আগে পাখা চাইলে
গোল হয়ে ঘুরতে লাগলো বাতাস।
যেদিন তিনি নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে দেখলেন:
তার চামড়ায় মালভূমির মতো ভাঁজ–
মৃত্যুর মিস্ত্রিকে ডেকে তিনি বানালেন
কারুকার্যময় কফিন আর কবর।
সেলাই না-করা শাদা পোশাকে শরীর গলিয়ে
এক লাফে ডিগবাজি খেলেন কফিনে
আর জুতার শব্দের মতো হাসতে লাগলেন–
তার প্রেমিকা ও সন্তানরা
কাঁধে নিয়ে চললো তাকে কবরের দিকে।
-----------------------------------------------------
স্ট্র্যাপ
তার ব্রা-র স্ট্র্যাপ থেকে সেই যে উড়ল
অজস্র রঙিন ঘুড়ি, আমার আকাশ
সেই দিন থেকে উদাসীন,
দোদুল্যমান। আর দ্যাখো, সে
হাসে-- সমস্ত লাটাই যেনো তার হাতে;
‘নামিব না, নামিব না’ বলে ঘুড়িদল
দোলে, ঘুমের ভেতর
আমাকে পেঁচিয়ে ফেলে গোপনতাকামী
আগুনের সুতোগুলি, যতই প্রকাশ্য
হতে চাই, চাপা পড়ি তার হাসির তলায়
অন্তর্বাস থেকে ছুটি নিয়ে
দ্যাখো, সে কেমন বেরিয়ে পড়েছে--
আর, স্বপ্নে হারিয়ে-ফেলা হাসিসহ
জড়িয়ে ধরেছে তাকে
বিরহলাঞ্ছিত প্রেমিকের দল
--------------------------------------------------------------
পাশ ফেরার গান-২
উপরে ওঠার কথা কেন যে ভাবো নি তুমি পথটা কি ছিল খুব বাঁকা
পাশ ফিরে চেয়ে দেখো, একটি লোহিত স্রোত হুইসেল দিতে দিতে
মুছে গেল পুরনো রেখায়
আরো চেয়ে দেখো তুমি ঘাট থেকে ছুটি নিয়ে নীল পটভূমি ধরে
উঠে গেল একটি জাহাজ
চাকার ঘষায় পথ কেন যে হয় না ক্ষয়; আরো দানবীয় তার চলা
ঘুমের টানেল ধরে আমরাও এসে গেছি শোণিতের খুব উঁচু পাহাড়চূড়ায়
উপরে ওঠার কথা ভাবো নি বলেই আজ তুমিও তো ভূপাতিত
নিরীহ নদীর তীরে, একা
----------------------------------------------------------------------------------
সুইসাইড-নোট
তোর শ্বাসচাপা চুমু আমি হেমন্তের বনশীর্ষে রেখে
আসি। ধূলির তরঙ্গ থেকে
যাচ্ছি শূন্যে ছুটি নিয়ে---
এমন তো নয়; কিন্তু কোথাও চাই না যেতে, গিয়ে
কী হবে? তার চেয়ে ভালো এই অনিদ্রার বন, আর
লুটিয়ে-পড়া পাতার শব্দ।
যত নিঃশ্বাস আমার---
সব গুঁজে দিই এই নিম্নগামী ঢেউয়ে। যত দূর থেকে
আসুক বাতাস, ঝরে-পড়ার আগে ব্যথায় বেঁকে
গেলে তোর মুখ আমিও দেখেছি;
এখন যে-মাছি
ওড়ে ওই চেহারার চারপাশে, তার ডানার কম্পনে
জেগে ওঠে নশ্বরতা; আর অনন্তের বনে
ঘুরে-ঘুরে
সরে যাব এই উপড়ানো হৃৎপিণ্ড নিয়ে, বহু দূরে...
-----------------------------------------------------------------------
রেললাইন শুধু রেললাইন-৪
নিদ্রা থেকে জাগরণে গিয়ে আমাদের রেলপথ পুনরায়
ঢুকে যায় ঘুমে
মাঝখানে রান্নাঘর, কারুকাজ-ভরা শয়নকুঠুরি আর
তরঙ্গিত আকাশের তল
রাতভর কাঁপে জল, স্থির ঘাটে কাঁপে চালকরহিত নৌকা
আর স্বপ্নের হাওয়াঢেউয়ে নিদ্রিত আমাদের চুল। ...
সূর্যের প্রসঙ্গ নেই, তবু ভোর আর গোধূলির টুকরোগুলি
আমাদের পথের দু’পাশে উদাসীন পাথরের মতো
পড়ে থাকে;
নৈঃশব্দ্য থেকে গান, নৈঃশব্দ্যে পুনরায়
গন্তব্যের গাম্ভীর্যকে ছুঁতে চায় আমাদের অন্যতর স্নায়ু...
অসংখ্য স্লিপারে আমরা রেখার ভারসাম্য রচনা করেছি;
তবু পটভূমি জাগরণে চৌচির, নিদ্রায় তলহীন নীল
কখনো-বা অন্ধকার, আর
আমাদের রেলগাড়ি স্টেশনবিমুখ, রাতভর প্রতিধ্বনিকামী
--------------------------------------------------------------------
রেললাইন শুধু রেললাইন-৭
মেনেছি প্রহেলিকা দেখেছি রাতভর
মানুষ ডুবেছিল কুয়াশাময় শীতে
প্রদোষ কেটে গেলে প্রয়োজনীয় স্বর
হারিয়ে যেতে থাকে আবহসঙ্গীতে...
ট্রেনের বাঁশি বাজে ঘুমের তীর থেকে;
বালক কান পেতে শুনেছে সেই গান
নিদ্রা নেই তার ব্যাকুল দুই চোখে
কিসের ব্যাকুলতা জানে না দেহযান!
কেন এ-চাকাগুলো এসেছে পুনরায়,
কেন যে প্রাণীদের জীবন সাময়িক?
ঘড়ির কাঁটা বেয়ে ট্রেনটি চলে যায়
স্টেশন নড়ে ওঠে ও-ঢেউ স্নায়বিক...
ফ্রেমের ছবিগুলো অপসৃয়মাণ---
নরম স্নায়ু ছাড়া কে বোঝে এই গান
--------------------------------------------------------------------------
চঞ্চল আশরাফ:
নব্বই দশকের যে দুয়েকজন শক্তিমান কবি আছেন, তাদের একজন।
জন্ম : ১২ জানুয়ারি, ১৯৬৯, ফেনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর।
প্রকাশিত চারটি কবিতার বই : চোখ নেই দৃশ্য নেই (১৯৯৩), অসমাপ্ত শিরদাঁড়া (১৯৯৬), ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে (২০০২), গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলো (২০০৮)। গল্পগ্রন্থ দুটি : শূন্যতার বিরুদ্ধে মানুষের জয়ধ্বনি (১৯৯৯), সেই স্বপ্ন, যেখানে মানুষের মৃত্যু ঘটে (২০০৮)। একটি উপন্যাস : কোনো এক গহ্বর থেকে (১৯৯৫)। এছাড়া সাহিত্য, ভাষাবিজ্ঞান, দর্শন ও নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে লিখেছেন প্রবন্ধ। আড়াইশ'রও বেশি গ্রন্থের সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন সাময়িকীতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।