আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভু টু ক চা নে র ডা য় রি ✍ যে শহরে আমার কোনো বন্ধু নেই!



⌚যেখানেই যেতাম, কোনো না কোনো আত্ত্বিয়তা থাকতোই। যার সাথে দেখা হতো তার সাথেই একটা পূর্বসূত্র থাকতো। পারিবারিক কোনো বন্ধন না থাকলেও সবচেয়ে বড় বন্ধনটা থাকতো বন্ধুত্বের। হ্যাঁ, আমার সেই মফস্বল শহরটা আমার বেশ প্রিয় ছিল। সেই শহরের অলিগলি, মানুষগুলো বেশ চীরচেনা আর আত্নার কাছাকাছি ছিলো।

সবই আমার আর আমি সবার। কিন্তু মনের ভেতর তবুও একটা খটকা থাকতো, শহরটার প্রতি মুগ্ধতা থাকলেও আমি ছিলাম তার অদৃশ্য প্রেমিকের মতো। শহরের সাথে জড়িত প্রতিদিনকার জীবন আর আমার ভালবাসা মিশে থাকলেও সেই শহরের প্রতি তখনো আমার কোনো অধিকার ছিলো না। আমি সেই যোগ্যতায় যেতে পারিনি। কারণ আমার চোখ তখনো যে, ‘বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে’ সাইনবোর্ড খোঁজে! তখনো আমি আমার প্রিয় শহরটাতে ভাড়াটিয়া পরিচয়ে বেড়ে উঠছি, বড় হচ্ছি! আর এই বিষয়টা যখন মাথায় আসতো, আমার ভাবনায় কেবল একটা শূণ্যতা সৃষ্টিকারী লাইন চলে আসতো।

মাথার ভেতর বার বার উচ্চারিত হতো, এ শ-হ-র আ-মা-র ন-য়! আজ আমি আততায়ীর মতো যে শহরে ঘুরি, সেই শহরটা আমার। প্যারিসের মায়াজাল আর তার জাদুময় মমতার ছিটেফোটা আমার উপরও বর্ষিত হয়েছে। আমিও আর্শিবাদপুষ্ট হয়েছি আর সকল দূর্ভাগাদের মতো। কিন্তু এই শহরের মানুষগুলো যে আমার নয়! এই শহরের আলো বাতাস আমার কিন্তু প্রিয় কোনো মানুষের নিশ্বাসের উষ্ণতা পাই না এখানে। বাড়িয়ে দেয়া হাতগুলো বন্ধুর পরিবর্তে পেশাগত পরিচয় নিয়ে হাজির হয়।

কেউ কলিগ, কেউ পরিচিত বাঙালি বা কেউ নিতান্তই পথচারী। কারো কাছে আমি বিদেশী আর আমার কাছে অন্যরা। এ শহরে আমার কোনো বন্ধু নেই; কেউ নেই। শহর আমার হয়ে গেলো ঠিকই কিন্তু মানুষগুলো পর গেলো! এখানে আমি সংকোচিত হয়ে থাকি, অদৃশ্য অপরাধে আততায়ীর মতো বিচরণ করি। কেউ না জানুক আমি তো জানি, কতশত সুখের মুহূর্ত্যের হন্তারক আমি! কত আশার ভ্রুণ পায়ে মাড়িয়ে, কত স্বপ্নের টুটি চেপে এগিয়ে চলেছি এক আততায়ীর মতো করে।

এ যেনো নিজের ছায়ার তাড়া খেয়ে পালিয়ে বাঁচা! এসব ভাবতে ভাবতে আমি আইফেল টাওয়ার পিছনে রেখে এগিয়ে যাই। স্যইন নদীর তীর ধরে মেইন রাস্তার ফুটপাতে যে ভ্রাম্যমান স্ট্রীট আর্টিস্টরা পর্যটকদের তাৎক্ষণিক ছবি একেঁ দেয়, তা দেখি। আমার কেনো জানি ঐ আর্টিস্টদের ছবির বিষয় হতে ইচ্ছে হয় না। নিজেকে একটা ফ্রেমে আটকানোর ইচ্ছে মনে হয় আমার কোনো কালেই ছিলো না! তাই তো এতো যাযাবর জীবন, এতো ছুটে চলা। আমি রাস্তায় নেমে পড়ি।

বিশাল রাস্তা। এপাড় আর ওপাড়ের মাঝে বিরাট ব্যবধান। এই বিশাল রাস্তাটা দেখলে আমার কেবল প্রিন্সেস ডায়নার কথা মনে পড়ে। আমার কেবল মনে হয়, কোনো এক দূর্ঘটনা কবলিত গাড়ির ভেতর থেকে ডায়নার চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকে না কিভাবে এমন একটা রাস্তায় দূর্ঘটনাটা ঘটলো? কতশত প্রশ্ন জাগে! এর আগে বা পরে কি এমন আর কোনো ঘটনা ঘটেছে? রাজনীতি আমি বুঝি না বলেই হয়তো এসব চিন্তা বেশী সময় মাথায় থাকে না।

আর এ তো বিশ্ব রাজনীতি! এভাবেই হেঁটে হেঁটে একটা পার্কে চলে আসি। হয়তো নামফলক দেখলে পার্কের নামটা জানা যাবে, কিন্তু আমার আগ্রহ জাগে না। আমি বরং আরেকটু সামনে এগিয়ে যাই। বিশাল একটা মূর্তির পাদদেশে দাঁড়াই। আমার চোখ বরাবর সেই মূর্তির নামফলক, তা থেকে স্পষ্ট দেখা যায় লেখা আছে; নেপোলিওন বেনাপোর্ট।

এই সেই নাম যা শিশুকালেই আমাদের মস্তিস্কে বাসা বেঁধেছিলো, এখনো আছে। তাঁর অপার মহিমা, সাম্রাজ্য জয়ের গল্প আর কতশত বিরত্বগাঁথা। আমি সেই মূর্তিটাকে ভালো করে দেখি। নেপোলিওনের দৃষ্টি এখোনো সেই সুদূরের পানে। এখনো দেখলে মনে হয়, এই বুঝি তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ করবে দূরের সেই সাম্রাজ্যে নিজেদের পতাকা স্থাপনের জন্য।

আমি নেপোলিওনের মূর্তিটার গায়ে হাত রাখি। তারপর চেষ্টা করি তার চেহারার দিকে তাকানোর। আমি তাকে বলি, হে বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারী, আমাদের আশৈশবের নায়ক, তুমি কি একটু নিচের দিকে তাকাবে? তুমি কি একবার দেখবে, কত কত সাম্রাজ্য জয় করা তোমার সাম্রাজে একজন এসে, সে তার নিজের সাম্রাজ্য হারিয়ে ফেলেছে? বিশ্ব জয় করা হে মহানায়ক, তুমি কি একবার চেয়ে দেখবে? তোমার নিজের সাম্রাজ্যে কেউ একজন নিঃস্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর আসে না, কেবল প্রতিধ্বণি হয়। সেই প্রতিধ্বণিগুলোও নাগরিক সন্ধ্যার আকাশে ক্রমাগত মিশে যায়, ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। প্রকাশিত।

লেখাটি এই ফেসবুক পেজেও প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।