'... আমাদের আশার কোনো পরকাল নাই'
ড. অনুপম হীরা মণ্ডল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। নিজের ক্যাম্পাসেই নিদারুণ ফর্মে থাকা ছাত্রলীগ নেতার হাতে একদিন আগে মার খেয়েছেন। শিক্ষকরা ধর্মঘটী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে প্রতিবাদের সেই পথ থেকে তারা সরে এসেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যথারীতি ক্লাশ হয়েছে। ছাত্রের মার হজম করে অনুপম ক্লাশ নিয়েছেন কি না আমরা জানি না। হয়তো নেবেন। আজ না নিলেও কাল, পরশু, তরশু- নিতে তো হবে। তাঁর কর্তব্য তিনি পালন করবেন।
আর অপেক্ষা করবেন আবার কোনো একদিন ফর্মে থাকা কোন ছাত্র সংগঠনের নেতা আবার তাকে চপেটাঘাত করেন।
অনুপম হীরা মণ্ডলের জীবনে ক্যাম্পাসে ছাত্রনেতাদের হাতে মার খাওয়ার এটি দ্বিতীয় ঘটনা। প্রথমটি যখন ঘটে, তখন তিনি শিক্ষক ছিলেন না। তিনি তখন ছাত্র। সম্ভবত ২০০২ সালের ঘটনা।
সরকারে আসীন থাকায় সেই সময়ের ইন-ফর্ম সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের ক্যাডারদের হাতে তার মধ্যযুগীর নির্যাতনের শিকার হবার খবরটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়ছিলো। অনুপমকে ঘরে আটকে রেখে পেটানো হয়েছিলো। কী অপরাধ যে ছিলো তার জানা যায় নি।
ব্যক্তিগতভাবে অনুপমকে আমরা ছাত্র অবস্থাতেই চিনতাম। পড়াশোনায় আমার এক বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন।
পরিচয় হয়েছিলো ছাত্র ফেডারেশনের পাঠচক্রে। এরপর ঘনিষ্ঠতা হয় জামিউল আহসান সিপুর মাধ্যমে। সিপু তখন জনকণ্ঠের রাবি প্রতিনিধি ছিলেন। পড়তেন অনুপমের বিভাগেই। নিরীহ-গোবেচারা আচরণ আর কথাবার্তার কারণে আড়ালে তাকে নিয়ে কম হাসাহাসি করেছি, তা নয়।
সেই অনুপমকে একদিন শিবির এমন ঠ্যাঙানি দেবে- ভাবতেও পারি নি। ছাত্র অনুপম ঠ্যাঙানি খাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের 'প্রগতিশীল' মানুষগুলোর বক্র্তৃতার সবচে বড় অস্ত্র! পারলে তারা বিবৃতিতে ভাসিয়ে দেন অনুপমকে। ভেসে তিনি প্রায় চলেই গিয়েছিলেন। না, বিবৃতির ঠেলায় নয়, ঠ্যাঙারেদের হুমকিতে। যদ্দূর মনে পড়ে, অনুপমের জন্য ক্যাম্পাস অনিরাপদ হয়ে উঠেছিলো।
দীর্ঘদিন তাকে ক্যাম্পাস ছাড়া হয়ে থাকতে হয়।
ছাত্র অনুপমের মার খাওয়া চক্রের সেই সূচনা। এরপর জীবনচক্রে মাস্টারি করছেন এবং এখানেও শিক্ষক অনুপম ছাত্রলীগ ক্যাডার এমদাদের হাতে মার খেয়ে তার চক্রের রেখায় আরো একটি বিন্দু যোগ করে নিলেন! অনিরাপদ ছাত্র আর শিক্ষক জীবন চক্রের কী চমৎকার দৃষ্টান্ত আমাদের অনুপম!
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আরো নির্দিষ্ট করে বললে লটবহর সমেত প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা এখন কী করছেন? পান থেকে চুন খসলেই যারা শিক্ষার্থীদের কলার ধরে টানা হেঁচরা করছেন, ছাত্রত্ব বাতিলের হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছেন, তাদের ভূমিকা এখানে কোথায়? না, তারা ভূমিকা পালন করেছেন; অস্বাভাবিক দ্রুততায় একজন সহকারী প্রক্টর ঘটনার দিনই 'শিক্ষকের পাশে দাঁড়ানোর অপরাধে' আন্দোলনকারী এক ছাত্রের কলার ধরে নিজের পৌরুষ জাহির করেছেন। কী চমৎকার নিরাপত্তার নমুনা! সন্ধ্যা না হতেই খাঁচায় ছাত্রীরা আবদ্ধ হচ্ছেন কি না তা নিশ্চিত করতে তাদের যে তোড়জোড় তার কানাকড়িও কি ছাত্রলীগের এই নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা ব্যয় করছেন?
তারা তা করবেন- এমন আশা অনেকেই করেন না। কারণ সরকারি দলের চামুচ হিসেবে পরিচিতি পেতে যাদের চেষ্টার অন্ত নেই, তাদের কাছ থেকে এই আশা বাতুলতা।
গতকালের ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পাসের কিছু পুরনো কলের গান আবার চালু হয়েছে। তারা গাইছেন: ছাত্ররাজনীতিটাই যতো নষ্টের গোড়া। এটাকেই বন্ধ করে দেওয়া উচিত! নানা উসিলায় ছাত্র রাজনীতি বন্ধের নামে যারা রাজনৈতিক চেতনাকেই বিকশিত হবার পথে দেয়াল হয়ে দাঁড়ান তাদের অনেককেই আমরা চিনি ও জানি। ঈদ সামনে রেখে বিশেষ একটি ছাত্র সংগঠনকে ঈদ উপহার হিসেবে নগদ নারায়ণ সমর্পণ করে তারাই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। অথচ তারাই ক্যাম্পাসে ছাত্রদের ন্যায্য দাবি নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে নোংরা ছাত্ররাজনীতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
তাদের কি আমরা চিহ্নিত করছি না কি তাদের পেছনের প্রগতিশীলতার ছাপ্পরটার জোরে তাদের কথাকেই বেদবাক্যসম ধরে মাথায় তুলে নাচছি। এমদাদের মতো কথিত নেতাদের অপকর্মের দায় তো তারা এড়াতে পারেন না। শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের নিরাপত্তাহীন করে ফেলার অভিযোগ তো তারা খণ্ডাতে পারেন না।
ছাত্র রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে বলে যে গোড়া আমরা কাটতে চাইছি, সেই একই অভিযোগে তো প্রশাসনের গোড়াটাও কেটে ফেলার কথা ওঠা উচিত। দলীয় আনুগত্যের যে বিবেচনায় খবরদারি করার শক্তি বন্টন হয়, তার শেকড়েই তো যতো গলদ।
সেটাকে চিহ্নিত করে না উপড়ে ফেললে ড. অনুপমদের জীবনচক্রে এমন কতো বিন্দু যে পূর্ণতা দেবে, তার হিসাব কষেও শেষ করা যাবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।