আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২১ দিনের ছুটি-২

এডিট করুন

২১ দিনের ছুটি-১ পরদিন ভোরে বাসটা বেনাপোল গিয়ে থামে। যশোর বেনাপোল। ভোর চারটা বাজে। রাতে বাস কয়েকবার পথে থেমেছে। পুলিশ উঠেছে বাসে চেকিং করার জন্য।

ভারতগামী কোন যাত্রী থাকলে তার ব্যাগ খোলা হয়েছে অথবা চেকিং এর নামে বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছে। পুলিশ যখন বাসে উঠে জিজ্ঞাসা করছিল, "কারা কারা ভারত যাচ্ছেন?" তখন মা দেখলাম কিছু বলছেন না। চুপচাপ বসে আছেন। পরে বুঝেছিলাম এর মাজেজা কি। অযথাই হয়রানী এবং কিছু ঘুষ খাওয়া।

যেই বাস সরাসরি ভারতে ঢুকে সেই বাসে কেবলমাত্র যশোরগামী যাত্রী আর ভারতগামী যাত্রীর মধ্যে আবার পার্থক্য কি?? যাই হোক এভাবেই সারারাত নির্ঘুম বাসে বসে থেকেছি। ভ্রমণকালে আমার না ঘুমানোর সেই ছোটবেলার বদভ্যাস এখনো আছে। কেন যেন ঘুমাতে ইচ্ছা করে না ভ্রমণের সময়। প্রতিটা মূহুর্তের অভিজ্ঞতা চুষে চুষে খেতে ইচ্ছে করে। ভ্রমণ মানেই অভিজ্ঞতা।

আমি এই অভিজ্ঞতার এক কণাও যেন বাদ না যায় সে ব্যাপারে সদা সতর্ক। জীবনটা তো খুবই ছোট। কতটুকুই বা আমরা দেখতে পারি এই এক জীবনে। মহাবিশ্বের কথা বাদই দিলাম এই পৃথিবী নামক গ্রহটারই কতটুকু দেখেছি। নিজের দেশকেই বা কতটুকু দেখেছি।

মাঝে মাঝে মন হাহাকার করে ওঠে। আমি এই মহাবিশ্বের প্রতিটি ধুলিকণার সাথে পরিচিত হতে চাই। কিন্তু এই জীবনে তা সম্ভব না। তাই যতটুকু পাই ততটুকুই চেটেপুটে খাই। প্রতিটি মুহুর্ত চেষ্টা করি উপভোগ করতে।

সারারাত বাস চলেছে। আমি জানালার পাশে বসেছি। হালকা শীত পড়েছে। একটা সোয়েটার গায়ে। জানালা খোলা রেখেছি।

অন্ধকারে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাই দেখছি। বাসের হেডলাইটের আলো গিয়ে পড়ছে রাস্তার পাশের গাছগুলোর উপর। আমি সেই আলোতেই গাছগুলো দেখছি। আবদুল কালাম আজাদের মত করে বলতে ইচ্ছে করছে, "মাতৃভুমির বিশালতার সাথে সেই আমার প্রথম পরিচয়। " মাঝে মাঝে মাটির ঘর দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু সব অন্ধকার। এত রাতে কেই বা জেগে থাকবে! তবুও মাঝে মাঝে কিছু সজাগ মানুষ দেখতে পাচ্ছি রাস্তার পাশে। হঠাৎ করে একজন বৃদ্ধ মহিলাকে দেখলাম পাতা ঝাড়ু দিচ্ছেন। ক্ষণিকের জন্য দেখা সেই বৃদ্ধ মহিলাও আজও আমার মস্তিষ্কে স্থায়ীরুপে রয়ে গেছেন। মানুষ আসলে কিছুই ভোলে না।

খুচিয়ে তুললেই সব মনে পড়ে। বাসের সবাই ঘুমাচ্ছেন। আমি একা জেগে রয়েছি। এরপরের ফেরীঘাটের কথা বিশেষ কিছু মনে নেই। তবে যখন বেনাপোল গিয়ে নামলাম আর আমাদের গাট্টি বোচকা যখন জড়ো করে এক জায়গায় রাখা হয়েছে আর আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছি সকালের সাদা আলোতে তা ষ্পষ্ট মনে পড়ছে।

আমার আশেপাশে আরো অনেক মানুষ। সবাই ভারতগামী। প্রায় সকলেই পরিবার পরিজন নিয়ে এসেছেন। বিশাল সরগরম অবস্থা। মা পাউরুটি আর কলা কিনে আনলেন।

আমার খেতে ইচ্ছে করল না। মা জোর করলেন কিন্তু কোন লাভ হল না। আমরা সবাই অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন অফিস খুলবে। কারণ ভ্রমণ ট্যাক্সের কাগজ আর কাষ্টমস থেকে সিল নিতে হবে। আমি একটি ঘোরাফেরা করে চারপাশ দেখার জন্য যেই পা বাড়িয়েছি, মা দিলেন এক ধমক।

এইখানে নাকি ছেলেধরা অনেক বেশী। আমার ধমকটা মোটেই ভাল না লাগল না। ছেলেধরার ভয় আমার কোনকালেই ছিল না। তারপরেও এই অপরিচিত জায়গায় এত লোকের সামনে ত্যাদড়ামী করাটা ভাল হবে না ভেবে চুপ করে থাকলাম। একসময় সব ঝামেলা শেষ হল।

আমরা ভারতের প্রবেশদ্বারের কাছে গিয়ে পৌছলাম। একের পর এক ট্রাক ঢুকছে আর আসছে। ট্রাক ড্রাইভাররা ভ্রমণ ট্যাক্সের কাগজটার মতই একটা কাগজ বি ডি আর দের দেখাচ্ছেন। বি ডি আররা ট্রাক ছেড়ে দিচ্ছে। সীমান্তের সাথে সেই আমার প্রথম পরিচয়।

সেই প্রথম বুঝতে পারলাম দুনিয়াটা অনেক বড় আবার অনেক ছোট। সেখানে সীমান্ত আছে। চাইলেই আমি সারা দুনিয়া চষে বেড়াতে পারব না। আমার বয়েসী অনেক ছোট ছোট ছেলেদেরদেকখলাম ট্রাকের পেছনে লাফ দিয়ে ট্রাকের মাল বাধার রশি ধরে ঝুলে ট্রাকে উঠে সীমান্ত পার হয়ে চলে যাচ্ছে। বি ডি আররা কিছুই বলছে না।

ওরা হরদম ভারতে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। বাহন হিসেবে ব্যাবহার করছে মালবাহী ট্রাক। আমার ইচ্ছে হল মাকে বলি,"মা আমি আপাতত ট্রাকে ঝুলে ভারতে ঢুকে তোমার জন্য অপেক্ষা করি। তুমি আসতে থাক। " কিন্তু বুঝলাম এইটাও বলাটা ঠিক হবে না।

একসময় একটা রিক্সা নিলাম আমরা। মালপত্র রিকশায় করে প্রবেশদ্বারে ঢোকার পথে আমাদের ভ্রমণ রশিদ চেক করল। চেক করার পর আমাদের ছেড়ে দিলে আমরা ঢুকে গেলাম ভিতরে। জীবনে প্রথম সীমানা অতিক্রম করলাম। একটা মহাজাগতিক অনুভূতির মত হচ্ছিল।

আরেক দেশে যাচ্ছি। আরেকটা দেশ। শীতের সকাল। সূর্য প্রায় উঠি উঠি। সীমানা অতিক্রম করে ঢোকার কতক্ষণ পরেই সূর্য পুরোদমে উঠে গেল।

ব্যাপারটা ছিল পুরো জটিল একটা কাকতাল। শুভ সকাল ভারত। গুড মর্ণিং ইন্ডিয়া।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।