আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিছু মুখ ও একটি স্বপ্ন



মিয়া মুস্তাফিজ *বেরতা কেঁদে উঠলেন। কথা বলতে পারলেন না কিছুক্ষণ। তাঁর কান্না স্পর্শ করল ক্লাসের সবাইকে। যারা অতি আগ্রহের সাথে তাঁর উপস্থাপনা শুনছিল। কেউ কোনো কথা বলল না।

এ নীরবতা যেন সবুজ ছায়া নিবিড় কালমার বিশ্বাবদ্যালয়ের মিডিয়া স্কুলের ক্যাম্পাসকে ছাড়িয়ে গেল। আবার শুরু করলেন তিনি। নিউজরুমে সহকর্মীদের অবহেলা, বসদের বৈষম্যমূলক আচরণ দারুণভাবে আহত করেছে বেরতাকে। জিম্বাবুয়ের প্রতিনিধিত্বশীল পত্রিকা দ্য স্ট্যানডার্ড-এর একমাত্র নারী সাংবাদিক বেরতা শুকু। সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন তিনি।

বেরতার হিসেব মতে, এটা সে দেশের চিত্র। সাংবাদিকতায় নারীদের অবস্থান খুবই দুর্বল। দু-একজন নারী সাংবাদিকতা করলেও পুরুষ সহকর্মীদের অবহেলায় অতিষ্ঠ হয়ে পেশাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। * দুদিন ধরে কাবুলের অদূরে একটি তালেবান অধ্যুষিত গ্রামে আটকা পড়ে আছেন রহিমি। ঐ গ্রামে আসার পর পরই গোলাগুলি শুরু ।

কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে গেছেন তিনি। আশ্রয় নিয়েছেন একটি বাড়িতে। আফগান সৈন্য এবং বিচ্ছিন্ন কিছু তালেবান জঙ্গির সাথেই চলছে যুদ্ধ। ডা. সংগর রহিমি কাজ করেন নিউ ইর্য়কস টাইমস-এর কাবুল অফিসে রিপোর্টার হিসেবে। রহিমির বাবা পেশায় ডাক্তার।

পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতেই ডাক্তারি পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু মনের তীব্র তাড়না থেকে সাংবাদিক হয়ে যাওয়া। এখন প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি বিশ্বাস করেন সাংবাদিকতাই উত্তম পথ যার মাধ্যমে মানুষের জন্য কিছু করা যায়। আর আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে তো এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। * ছয় বছর বয়সে মাকে ছেড়ে দেয় জরের বাবা।

কিছুদিনের মধ্যে মা আরেকজনকে বিয়ে করেন। পথই হয় জরের ঠিকানা। পথে পথে চলত চলতে শেষ হয়ে গেছে জরের ২৪ বছর। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন জর। কাজ করছেন নরওয়ে ভিত্তিক একটি সংবাদ সংস্থার বার্মা শাখায়।

বহতা নদীর ভেসে যাওয়া শেওলার মতো জরের জীবনকে সাংবাদিকতা এখন আরও বেশি হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে যেন। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে সংগ্রাম করতে করতে এখন জর সংগ্রাম করছেন বার্মাজান্তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তাঁর সংগ্রাম একেবারেই একা। সঙ্গী কেউ নেই। জর কাউকে পরিচয় দিতে পারে না তিনি একজন সাংবাদিক।

কারণ সরকার জানতে পারলে তাঁকে জেলে পুরবে। তাঁর জীবন বিপন্ন হয়ে যাবে। নিজেকে বিষাক্ত গোখরা ভাবে জর; যে কিনা একদিন ছোবল মেরে কুপোকাত করবে বার্মিজ স্বৈরাচারী জান্তাকে। * তানজানিয়ার স্যানিটেসন সমস্যা, পানিসংকট, এইচআইভি এইডস্ ভয়াবহতা দারুণ নাড়া দিয়েছে সালুমেকে। পানির জন্য হাহাকার, পানিবাহিত রোগে বিপন্ন মানুষের জীবন এবং এইডসের ছোবলে মৃত্যুপথগামী নারী-শিশুদের জন্য সালুমের মন প্রতিনিয়ত কাঁদে।

তিনি লিখতে চান তাদের জন্য। কিন্ত ওই ধরনের সংবাদ গুরুত্ব দেয় না তাঁর রাজধানী দারুস সালামের প্রভাবশালী পত্রিকা দি সিটিজেন কর্তৃপক্ষ। তারা রাজনৈতিক সংবাদ বড় করে ছাপায়। তাই অসহনীয় মনোকষ্ট নিয়ে কাজ করেন তিনি। কিন্তু তার চেয়েও কোন দুঃখটি তাঁর হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে তা কারও জানা হলো না।

কারণ তাঁর ব্যক্তিজীবনের কোনো কিছুই বলেন নি তিনি। এমনকি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উপস্থাপন পর্বে তাঁর জীবন সম্পর্কে বলতে বলা হলে দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন তাঁর ব্যক্তিজীবন একান্তই নিজের। একেকজন মানুষের জীবন একেক রকম। সবার জীবনে অপূর্ণতা, দুঃখ, না পাওয়ার কষ্ট আছেই।

কিন্তু একটা জায়গায় সবাই এক। তাঁরা সবাই সাংবাদিক। তাঁরা মানুষের জন্য কাজ করে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের কিছু আলোকিত মুখকে একজায়গায় করেছে সুইডিস ডেভেলপম্যান্ট কর্পোরেশন এজেন্সি (সিডা) । সেই সব আলোর ফেরিওয়ালাদের কিছু কষ্টের কথা বলছিলাম লেখার শুরুতে।

সুইডেন সরকারের রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমূলক এই সংস্থার আর্থিক অনুদানে সাংবাদিকতা এবং গণতন্ত্র বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোমা কোর্সের আয়োজন করে কালমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া স্কুল 'ফুজু'। মে-জুন ২০০৯ পিরিয়ডে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সেই কোর্সে অংশ নেওয়ার জন্য নির্বাচিত হই আমি । এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার ২০ জন সাংবাদিক এতে অংশ নেন। সাংবাদিকতা,তথ্যচিত্র বা টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণের ওপর বিদেশে পড়ালেখা করার ইচ্ছা থেকেই ইংরেজি ভাষার কোর্সে ভর্তি হলাম ২০০৮ সালে। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকায় এসব বিষয়ে পড়ালেখার অর্থ জোগাড় করা বিশাল একটা বাধা আমার জন্য।

তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমার আগ্রহের কথা লিখে বায়োডাটা পাঠালাম । অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তর পাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু টিউশন ফি' আমার পক্ষে যোগাড় করা একেবারেই অসম্ভব। ২০০৯ এর জানুয়ারির শেষের দিকে একটা মেইল আসে আমার কাছে। যাতে বলা হয় ফুজু হচ্ছে সুইডেনের কালমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ইনস্টিটিউশন যেখানে কর্মরত সাংবাদিকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য মিডক্যারিয়ার ট্রেনিং দেয়া হয়। সামনের সাংবাদিকতা এবং গণতন্ত্র কোর্সটি সিডার আর্থিক অনুদানে এবং এটা সম্পূর্ণ ফ্রি।

থাকা খাওয়া বিমানভাড়া তারা বহন করবে এবং আরও কিছু অর্থ দেবে হাত খরচের জন্য । মেইলটি পাটিয়েছেন কো-অর্ডিনেটর ক্যাটারিনা। প্রোগ্রাম ব্রুসিউর কয়েকবার পড়লাম । আবেদন করতে হলে যা যা লাগবে তা ভালো করে দেখলাম। দু-এক দিনের মধ্যে আবেদন করার জন্য নিজেকে তৈরি করলাম।

হাতে সময় আছে এক মাসের বেশি। চার পাতার ফরম পূরণ করতে হবে। এ ছাড়া চার পাতার একটা ব্যক্তিগত প্রতিবেদন লিখতে হবে। যাতে থাকবে আমার বেড়ে ওঠা, পড়ালেখা, সাংবাদিকতায় আগমন, সাংবাদিকতা নিয়ে আমার স্বপ্ন আগামী দিনের পরিকল্পনা, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা, পেশাগতভাবে বাধা, আমার সাংবাদিক বন্ধুরা কী কী বাধার শিকার, বাংলাদেশের আগামী দিনের সাংবাদিকতায় কী পরিবর্তন আসছে ইত্যাদি বিষয়ে। খুবই ব্যক্তিগত এবং ঠাস বুননে লিখতে হবে যাতে থাকবে কিছু উদাহরণও।

রিপোর্ট লিখতে দুসপ্তাহ লেগে গেছে। অনেকের সাথে কথা বলেছি। চ্যানেল আইয়ের চট্টগ্রামের ইনচার্জ চৌধুরী ফরিদ, এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার কামাল পারভেজ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তবে কাউকে বলিনি কেন আমি এসব বিষয়ে জানতে চাই। তাঁরা জানেন আমি সব সময় প্রশ্ন করি সে জন্য আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেও কোনো ভণিতা করেন না।

শুধু বন্ধু সাংবাদিক রশিদ মামুন ও আল রাহমানকে বললাম, আমি একটা রচনা লিখতে যাচ্ছি যেটা হয়তো আমার জন্য অনেক বড় সুযোগ এনে দিতে পারে। তাঁরা আমাকে অনুপ্রেরণা দিলেন। যখন খসড়া তৈরি করলাম। দেখলাম অনেক বড় হয়ে গেছে। এবার ছোট করে চার পাতায় নিয়ে আসা, গ্রামার এবং শব্দগত ভুল সংশোধন করা।

এতে আমাকে খুব সহযোগিতা করে আমার এক আমেরিকান নেট বন্ধু আলভিন। দু-তিন দিন সময় নিল সে। অত্যন্ত আগ্রহ এবং আনন্দের সাথে কাজটা করল। এভাবে সব কিছু রেডি হলে পাঠিয়ে দিলাম মেইলের মাধ্যমে। এরপর শুধুই অপেক্ষা।

আমার বন্ধু আলভিন মন্তব্য করলে, ‘তোমার ফেলোশিপ জেতা ৫০-৫০। তোমার ব্যাক্তিগত রচনাটি বিশাল একটা কাজ হয়েছে। ওটা তোমার জন্য সুফল বয়ে আনবে আশা করি। ’ আমি প্রতিদিন ভাবতাম যদি সুইডেন সরকারের এই বৃত্তি পেয়ে যাই! আবার ভাবতাম বাংলাদেশ থেকে একজন সাংবাদিক নেবে তাতে অনেকে আবেদন করতে পারে। আমি কীভাবে তাতে আশা করতে পারি ! ৩০ মার্চ রাত এগারটায় একটা মেইল আসল ক্যাটরিনার কাছ থেকে।

তাতে লেখা ছিল তুমি যে কোর্সের জন্য আবেদন করেছিলে তার ফলাফল এসেছে। আমরা খুবই আনন্দের সাখে জানাচ্ছি যে তুমি সে কোর্সের জন্য নির্বাচিত হয়েছো। বিশ্বের নির্দিষ্ট কিছু দেশ থেকে ২১০ জন প্রতিযোগী এতে আবেদন করে। এর মধ্য থেকে ২০ জন নির্বাচিত হয়েছে। আমার যেন আকাশছোঁয়ার আনন্দ।

এ যেন এক বিশাল স্বপ্নপূরণ ...! অভিজ্ঞতা বর্ণণা করছেন তানজানিয়ার সাংবাদিক সালুমে...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।