আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধের অমলিন স্মৃতি < ১৭ > যুদ্ধ বিভীষিকার বাইরের সেই মানুষগুলি

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
কিছু কিছু বিষয় আমি মেনে নিতে পারতাম না। আজো পারিনা। চট করে কোন কিছু ভুলে যাওয়া কিংবা ভুলে থাকতেই হবে এমন নিয়তি মেনে নেওয়া! আমার প্রিয়জনরা মারা গেলেও এমনটি হয়েছে। তাকে কবর দিয়ে এসেই দেখেছি ফুলের টবে গাছটার পাতা আরো একটু বড় হয়েছে, এ্যালুমিনিয়ামের হাড়িগুলো চুলোয় চড়েছে। রাতে বিছনা ঝাড়া হয়েছে, মশারি টাঙ্গানো হয়েছে, ভেতরে দু’একটা মশা ভুলক্রমে থেকে গেলে সেগুলো মারাও হয়েছে।

এবং যথারীতি খাবার টেবিলে একটু অযত্নে হলেও ঠিকই খাবার দেওয়া হয়েছে! অর্থাৎ বিশ্ব চরাচরের কোথাও বড় ধরণের কোন পরিবর্তনই ঘটেনি, শুধু একটা আস্ত মানুষ নেই হয়ে গেছে! তার সমগ্র জীবনের স্মৃতি ফেলে রেখেই নেই হয়ে গেছে! আজো মেনে নিতে পানিনা। সেদিনও পারিনি। ক্যাম্পে ফেরার পর যথাসময়ে বড় বড় আটার রুটি আর ছোলার ডাল দিয়ে নাস্তার আয়োজন হয়েছিল। যার যার হাতিয়ার কোত-এ জমা হয়েছিল। সবাই হাতমুখ ধুয়েছিল।

রোজকার মত চিটাগাংয়ের সেকেন্দার সেই অদ্ভুত ভাষায় হাকডাক করে যাচ্ছিলেন। বেড়ালটা ঠিকই আমাদের আশেপাশে ঘুর ঘুর করছিল। কমান্ডার লোকটা একটা তাবুর ভেতর ঢুগে গিয়ে সম্ভবত রিপোর্টটিপোর্ট করে একটু পরেই বের হয়ে এসেছিল। শুধু আমার মুখ দিয়ে রুটি সরছিল না। তখনো নাম না জানা সেই দুজন মুক্তিযোদ্ধার কথা মনে হচ্ছিল! আরো একটু বেলা হলে বাবাও ফিরে এসছিলেন।

বাবাও নিয়ম মেনে খেতে বসেছিলেন। একবার আমার দিকে চেয়ে একটু যেন আনমনা হয়ে আবার খাবারে মন দিয়েছিলেন। আমি নিজেকে একজন যোদ্ধার মত শক্ত করতে পারছিলাম না। ক্ষণে ক্ষণে কান্না পাচ্ছিল। হিসাব করতে পারতাম না।

ঠিকঠাক মনে রাখাতে পারতাম না, কিন্তু প্রায় রোজই যে কেউ কেউ ‘ক্যাজ্যুয়ালিটি’ হয়ে যাচ্ছে এটা বুঝতে পারছিলাম। আমার বা বাবার অবস্থাও এমন হতে পারে সেই চিন্তা কিছুতেই মাথায় আসত না। কোনমতে খেয়ে আর ক্যাম্পে থাকতে ইচ্ছে করেনি। সোজা বাড়ি ফিরে গেছি। মনে হয়েছে এরা কেউ আপন জন নয়! এরা কেন কাঁদে না! আমি যেমন বাবাকে জড়িয়ে ধরে বহুবার কেঁদেছি, কেন এরা সেভাবে কাঁদেনা! বাড়ি ফিরে মা’কে বলার পর মা অদ্ভুত ভাবে আমাকে দেখেছেন।

কাঁদতে গিয়েও কাঁদেননি। সারাদিন মন খারাপ হয়ে থাকল। আগে মন খারাপ হলে জগন্নাথের বাড়ি যেতাম। তার সাথে কথা বললে অনেক ভাল লাগত। তাকে আমার হিরো মনে হতো, অথচ কেন সে হিরো তা জানতাম না।

এদিন কোথাও গেলাম না। সন্ধ্যার দিকে বাবা ফিরলেন। সাথে আর একজন। তাকে উঠোনের মধ্যে দাঁড়ানো দেখেই মা চিৎকার করে ছুঁটে গেলেন। বোনরা কিছু না বুঝে অবাক তাকিয়ে থাকল।

আমি চিনলাম, কিন্তু মা’র মত দৌড়ে গেলাম না। তার আর মায়ের কাঁন্নাকাটি শেষ হওয়ার পর তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে গেলাম। আমার মাথায় একটা চাটি দিয়ে বললেন-‘চিনতে পারিস নাই’? আমি বললাম-‘হ্যাঁ পারছি, রাবু ভাইজান’। তার পর একে একে তিনি বোনদের কোলে নিয়ে আদর করলেন।

আমাদের বাড়িতে আবার আত্মিয় আসতে পারে এটা পাড়ার লোকদের জন্য অবাক হওয়ার মত ব্যাপার! তারাও ভিড় করে দেখতে লাগল। দেশ থেকে আমার আপন খালাতো ভাই রাবু (উনি তার ভাল নাম বলার সময় বলতেন ঠিকই-এস এম জহির, কিন্তু লিখতে গেলে নামের শেষে লিখতেন ‘বি.এ’) এসেছে। রাতে ভাত খাওয়ার সময় দেখলাম বাবা-মা দুজনই খুব খুশি, খুব নিশ্চিন্ত। বাবা-মা দুজনেই বার বার বলতে লাগলেন- ‘এই ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে কি যে চিন্তায় ছিলাম, কি যে কষ্টে ছিলাম, তুই আইছিস, এখন আর কোন চিন্তা নাই’। বাবা-মা’র মত আমারও নিঃশ্চিন্ত হওয়ার কথা।

আমারও খুশি হওয়ার কথা। আমারও বলা উচিৎ-‘এখন আর আমাদের কোন ভয় নেই, এখন আর আমাদের কোন চিন্তা নেই’! কিন্তু আমি তা বলতে পারলাম না। কেমন যেন অভিমান হলো! তাহলে কি আমি এতদিন কিছু করিনি! তাহলে কি আমি মা-বোনদের দেখে রাখিনি! আমি কি বাবা-মা’কে কষ্ট দিয়েছি! আমাকে নিয়েই বাবা-মা চিন্তায় ছিলেন! কষ্টে ছিলেন? যতই এই সব ভাবছি ততই অভিমান হচ্ছে। কারো উপরই রাগ হচ্ছেনা। শুধুই অভিমান হচ্ছে।

মনে হচ্ছে কোথাও চলে যাই! এতদিন নিজেকে যেমন শক্তসমর্থ ‘অনেক কিছু পারা মানুষ’ ভাবতাম, এতদিন নিজেকে যেমন খেলতে থাকা ছেলেদের চেয়ে আলাদা ভাবতাম, সেটা কি তাহলে কিছুই না? গত রাতের সেই দুই মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পরে যেমন কষ্ট হচ্ছিল সেই রকমই আর এক নতুন কষ্ট হচ্ছিল। মাত্র দুই দিনের মধ্যেই ওই লোকটি পাড়ার বয়ষ্ক মহিলাদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলেন। তিনি পান খেতেন। শুধু পান নয়। নিজে কি কি দিয়ে যেন পানের মশলা বানাতেন।

পাড়ার মেয়েদের সেই মশলাদেওয়া পান খাইয়ে সবার আপন হয়ে উঠলেন। আমি আমার মত সকালেই ক্যাম্পে চলে যাই। তিনি সারাদিন বাড়িতে বসে পাড়ার বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের সাথে গালগপ্প করেন। মা’র সাথে গ্রামের কথাবার্তা বলেন। রাতে তার কাছেই আমাকে শুতে হয়।

তিনি ঘুমিয়ে পড়লেও আমার ঘুম আসেনা। আমি কি কারণে যেন লোকটাকে পছন্দ করতে পারছিলাম না। আপন খালাতো ভাই। আমার চেয়ে পনের বছরের বড়, মুরুব্বি। তাও তাকে আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।

বিকেলে তিনি উঠোনে বসে রাজেশ খান্না-মুমতাজের সিনেমার গল্প বলতেন। পাড়ার মহিলারা অনেকেই সিনেমা দেখার সুযোগ পায়না। বেতাইয়ে সিনেমা হল ছিল না। সিনেমা দেখতে যাওয়া লাগত সেই তেহট্ট থানা শহরে। আমাদের কারো মাথায়ই কখনো সিনেমার মত ব্যাপার আসেনি।

আমি অনেক কিছু চিনি, কিন্তু তেহট্ট’র কোথায় সিনেমা হল তাও জানতাম না। তার কাছেই শুনতে পেলাম, রাজেশ খান্না, মুমতাজ, প্রাণ, প্রাণ চোপড়া, ববি, ঋষি কাপুর, ডিম্পল এইসব। এর কয়েকদিন পরেই একদিন তিনি বেশ গম্ভীর ভাবে বললেন-‘খালাআম্মা ও তো পুরো বখে গেছে’! ওর তো আর পড়াশুনা হবে না!, কি আশ্চর্য! আপনি ওকে পড়তে বলেন না কেন’? মা যুদ্ধের কথা বলতে চাইলেই তিনি বলে উঠলেন-‘উঁহু, এটা কেমন কথা? আমি কালই ওকে বই-টই কিনে দেব, এই পিচ্চিগুলোকেও পড়তে বসানো দরকার’। আমার নতুন মাষ্টার সাহেবের(দেশে উনি স্কুলে মাষ্টারি করতেন) উপর রাগ আরো বেড়ে গেল। মনে মনে ঠিক করলাম- একবার আস না পড়াতে, তোমার পড়ার নিকুচি করি আমি! যথারীতি তিনি পাড়ায় তার নতুন বান্ধবীদের কার বাড়ি থেকে ক্লাস সিক্স না সেভেনের বই নিয়ে সন্ধ্যা আমাকে পড়তে বসালেন।

বাবার ভয়ে আমি বসলাম ঠিকই, কিন্তু কি পড়ব? কি একটা প্রশ্ন করায় আমি উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকায় তিনি বার বার ধমক দিচ্ছিলেন। আমি তবুও চুপ। এইবার ঠাস করে মেরে বসলেন। আমারও মনে হয় ধর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিল, আমি উঠে দাঁড়িয়েই বলে বসলাম-‘আমার সাথে মাতব্বরি করতে আসবেন না, কোথায় ছিলেন যখন আমরা.........আর বলতে পারলাম না, রাগে অপমানে, কষ্টে কাঁদতে থাকলাম। এই লোকটি আমাদের নিজেদের মত করে সাজানো সব কিছু ওলট-পালট করে দিল।

মা একদিন আমার এই ভাইয়ের ভারতে আসার এবং আমাদের খুঁজে পাওয়ার ঘটনা বললেন......রাবু ভাইদের বাড়ি নড়াইল। তিনি যুদ্ধ শুরুর আগে খুলনার টুটপাড়ায় মামাবাড়ি ছিলেন। অধিকাংশ সময়ে খুলনাতেই থাকতেন। খান জাহান আলী রোড থেকে একটু ভেতরে ঢুকলেই টুটপাড়া শুরু। আর একটু এগুলেই কর’দের বাড়ি।

এই কর বাড়ি টুটপাড়া তো বটেই, খুলনায় প্রায় সবাই চেনে। বিখ্যাত এক পরিবার এই ‘কর’ রা। এই হিন্দু পরিবারটির এত জায়গা ছিল যা প্রায় টুটপাড়ার অর্ধেক। একটা পুলিশ ফাঁড়ি(আজো আছে) ছিল করদের জায়গার উপর। একটা বাজার ছিল ওদের জায়গায়।

সে কারণে সেই বাজারের নাম ‘করের বাজার’। ফাঁড়ির নাম-‘করের বাজার পুলিশ ফাঁড়ি’। করদের বিশাল চৌচালা টিনের ঘর, কাঠের বেড়া সে সময় খুবই বিখ্যাত বাড়ি। আর সব বাড়িগুলো ছিল গোলপাতার। সেই বাড়ির পাশের গলির নাম ছিল ‘করপাড়া লেন’ (এখন দানসূত্রে পাওয়া মুসলমানরা সেই সব নাম পরিবর্তন করে রেখেছে.....‘হাজীবাগ লেন’, ‘হাজীর বাজার’, ‘হাজীর বাজার পুলিশ ফাঁড়ি’! করদের সেই সব কোন কিছুরই আর চিহ্ন নেই!) করদের বড় ভাইয়েরা আগেই কোলকাতা চলে গেছে, কিন্তু তাদের ছোট ছেলে বিমল কর আর তাদের মা ‘সিঁন্দুরে বুড়ি’ (আসল নাম আমরা জানতাম না) কিছুতেই কোলকাতা গেল না।

ওই বুড়ির নিয়মিত কাজ ছিল খুব সকালে উঠে যে ফুলের মৌসুম সেই ফুল বড় কাসার থালায় নিয়ে আশপাশের বাড়ি বাড়ি একটা-দুটো ফুল ছুঁড়ে দিয়ে মঙ্গল কামনা করা। এই কাজ না করে তিনি জল স্পর্শ করতেন না। আমি মামা বাড়ি গেলে আমাকে সাথে নিয়ে বেরুতেন সিন্দুরে বুড়ি। তার কাছেই আমি চিনেছিলাম হরেক রকম ফুলের নাম। আমার ছোট মামা তখন বিএল কলেজের ছাত্র।

বিমল কর পড়াশুনা শেষ করেছেন। মামার চেয়ে একটু বেশী বয়স। যুদ্ধ শুরু হলে আশপাশের যারা শুভাকাঙ্খী ছিল তারা বিমর কর কে কোলকাতা চলে যেতে বললেন। বিমর কর রাজিও ছিলেন, কিন্তু সিন্দুরে বুড়ি কিছতেই যাবেন না। তার বিশ্বাস ছিল তিনি চলে গেলে এই পাড়ার সবার মঙ্গল কামনা করার কেউ থাকবে না! কিন্তু যুদ্ধ জোরোসোরে শুরু হতেই বানিয়া খামার, দোলখোলা বাজার, ভৈরব স্ট্যান্ড রোড অঞ্চলের হিন্দুদের মেরে ফেলার খবর পেয়ে তারা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় কোলকাতায় চলে যাবেন।

আমার এই খালাতো ভাইটি তাদের কোলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পেলেন। বিমল কর দেশ ছাড়ার আগে আশপাশের পরিচিত প্রায় সবাইকে তাদের জমিজমা ভাগ করে দিলেন। আমার মামারাও দশ-পনের কাঠা পেলেন। আমার আরো খালাতো ভাই, মামার চাচাতো ভাইরাও দুই কাঠা-পাঁচকাঠা পেলেন। যে লোকটি আইডিএল করতেন পরে রাজাকার হয়েছিলেন তিনিও দশ কাঠা জমি পেলেন।

বিমল কর সব কিছু দান করে প্রায় নিঃস্ব হাতে পাড়ি দিলেন কোলকাতা। আমার ভাই বিমলদের কোলকাতায় নিয়ে তাদের বাড়িতেই এই কয় মাস বসে বসে সিনেমা দেখে আর কোলকাতা-বোম্বে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে কিছুদিন আগে অন্য এক জায়গায় উঠে শেষে দেশে ফেরার জন্য কি ভাবে যেন কৃষ্ণ নগর এসে আমাদের খবর পেয়ে আমাদের এখানে হাজির হয়েছেন। বিমল কর’কে দেখে সবাই বলত উত্তম কুমার। খুবই সুন্দর ছিলেন দেখতে। আমি সর্বশেষ সিন্দুরে বুড়িকে দেখেছি আমার পাঁ/ছয় বছর বয়সে।

মনে পড়ে বুড়ি কপালে অনেক বড় করে সিঁদুরের টিপ পরত বলে পাড়ায় তার নাম ‘সিন্দুরে বুড়ি’। মা ভাইয়ের কাছে আরো যে সব গল্প শুনেছিলেন তার সবই আমাকে বলতেন। সেই সব গল্পে কোথাও কেউ মুক্তিদ্ধুদ্ধে যায়নি। কোলকাতায় ভাই যত যত জায়গায় ঘোরার বর্ণনা দিয়েছিল তাদের কেউ ফ্রন্ট তো দূরের কথা, যুদ্ধ কেমন তাও জানত না। ভাই নিজেও না।

আমি ফ্রন্টে কি কি করেছি, কিভাবে মরার হাত থেকে বেঁচে এসছি এ সব শুনেও তার কোন প্রতিক্রিয়া হতো না। তিনি এ নিয়ে বিন্দু পরিমানে ভাবতেন না। তার উপর সব চেয়ে বেশি ঘেন্না হতো একারণেই। তার পানের মশলার পয়সা দিতে দিতে আমি একদিন বিদ্রোহ করে বসলাম। সোজা বলে বসলাম-‘আপনাকে আর পয়সা দিতে পারব না’।

এটা শুনেই তিনি আমাকে থাপ্পড় লাগালেন। আর এই থাপ্পড় দেওয়া দেখে বড় বোনটি বলে বসল-‘তুই আমার ভাইকে মারছিস আইজ তোর ভাত নেই’! যদিও যথা সময়েই তিনি খেয়েছিলেন। আমি দিন দিন অতিষ্ট হয়ে উঠছিলাম। একদিন মা’কে বলে দিলাম-‘উনি যদি এখানে থাকেন তাহলে আমি বর্ডারে গিয়ে আর আসব না, সেখানেই থাকব’। এই লোকটি আসার পর থেকে আমি আর ফ্রন্টে যাইনি।

ক্যাম্পে যেয়ে সারা দিন পর রাতে বাড়ি ফিরতাম। একদিন দেখলাম তিনি আবার কোলকাতা ফেরার জন্য রেডি হচ্ছেন, কিন্তু তিনি কোথায় থাকেন তা দেখে আসার জন্য (এবং আমার একটু পরিবর্তন দরকার মনে করে) বাবা-মা তার সাথে আমাকেও কোলকাতা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আমি এক বাক্যে না করে দিলাম। সেদিন আর তিনি গেলেন না। সেই রাতে আমারও মনে হলো কোলকাতা তো দেখিনি, কোলকাতা কেমন? কত বড়? আমি তো ঢাকাও দেখিনি! কোলকাতা কি ঢাকার চেয়েও বড়? খুব ভোরে চলে গেলাম জগন্নাথের বাড়ি।

সেও বলল-‘যাও না দেখে এসো, আমি মোটে দুই তিন বার গেছি’। ঠিক করে ফেললাম যাব। বাসে সারাটা রাস্তা ভাইয়ের পাশে বসে আছি, কিন্তু একটা কথাও বলিনি। তিনি যথারীতি বাস কোথাও থামলে আমাকে এটা ওটা কিনে দিচ্ছেন। আমি ভাবলাম টাকা পেল কোথায়? মনে মনে ভাবলাম ঠিক মা’র কাছ থেকে এনেছেন! কোলকাতায় নেমে কখনো টানা রিকসায় কখনো হেঁটে একটা বিশাল কাঠের দরোজাঅলা বাড়ির ভেতর গিয়ে আরো অনেক ছোট ছোট খোপের মত ঘর, তারই একটা ঘরে আমাকে নিয়ে উঠলেন।

ঘরটার মেঝেতে সাত-আটটা বিছানা পাতা। দুই তিন জন বিছানায় শুয়ে-বসে আছে। তারা সবাই বাংলাদেশের লোক। প্রায় সবারই বয়স ভাইয়ের কাছাকাছি। রাতটা কাটিয়ে সকালে উঠেই আমি ভাইকে না বলে পাড়া ঘুরতে বেরিয়ে গেলাম।

কোলকাতায় কোন যুদ্ধ নেই। কোলকাতায় কেউ ফ্রন্টে যায়না। কোলকাতায় থেকে থেকে কটকট করে গুলির আওয়াজ নেই। কোলকাতার সুখি মানুষদের দেখে আমার কষ্ট হলো, না হিংসে হলো বুঝলাম না, কিন্তু কোলকাতা টানল না। যুদ্ধের ময়দান থেকে অনেক দূরে এই মানুষগুলো।

কোনও মতে দুই দিন থেকে বড় বাজার, বউ বাজার দেখে ফিরে এলাম বেতাই। আমার বাড়ি। আমার যুদ্ধ,ভয়,ত্রাস, আতংক নিয়ে আমার যে সংসার , সেখানে। কি যে আনন্দ হলো বলে বোঝানো যাবে না। আমার ক্যাম্প, ফ্রন্ট, এসএলআর, সেই জিপ, মাটির ধুলোওড়া পথ সব আমার নিজের যেন।

আবার আমি আমার মত করে থাকতে পারব সেই আনন্দ। বাবা-মা, বোন আর যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার স্বপ্ন............. চলবে.............
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।