যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
বড় পুজোর আয়োজন চলছিল। আমাদের গ্রাম থেকে বেতাই যেতে বড় রাস্তার ধারে বিশাল পুজা মন্ডপ হলো। প্রতিমা গড়া আরম্ভ হতেই মন্ডপে সারাদিন মাইকে গান বাজত-‘ঝুম বারাবার ঝুম শারাবী’, আমরা এই সময় খবর পেতাম বাংলাদেশের শিল্পিরা একটা দল করে ঘুরে ঘুরে সীমান্ত অঞ্চলে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের এখানে যদি তারা কখনোই আসেনি। একবার খবর পেলাম কৃষ্ণনগরে আসবে।
অনেক চেষ্টা করেও অনুমতি মিলল না। বাড়িতে একমাত্র বিনোদন রেডিওতে মুক্তির গান শোনা আর নাটক শোনা। সন্ধ্যে বেলা সবাই গোল হয়ে বসে চরম পত্র শোনা। সে সময় ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল’ বা ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি ’ আমাদের মুখে মুখে ফিরত। শত ব্যস্ততা আর ভয়-শংকার ভেতরেও বোনদের নিয়ে পুজো দেখতে যেতাম।
আমাদের গ্রামের পুজোর চেয়েও অনেক বড় করে বেতাইয়ে অনেকগুলো মন্ডপ উঠেছিল। সেই কালী মন্দিরের পাশে উঠেছিল সব চেয়ে বড় মন্ডপ। এরই একটু আগে-পরে আমাদের ঈদও এসে গেল। ঈদে তেমন কিছুই হলো না। সকালে ক্যাম্পে সবাই নামাজ পড়ার পর আর্মি-বিএসএফদের সাথে কথা বলে(সম্ভবত) ক্যাম্পে গরু জবাই হলো।
আমরা বাসায়ও মাংস নিতে পারলাম। মা খুব ভয়ে ভয়ে সেই মাংস রান্না করলেন! যদিও তার দরকার ছিল না, কারণ এতমাসে একবারও গুরু জবাই হয়নি। এই একটি দিন ওখানকার বাসিন্দারা কিছুই মনে করল না, বরং কেউ যেন কোন সমস্যা না করে সেজন্য গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা নিজেরাই আমাদের উৎসাহ দিল। মার্চের পর মুর্শীদাবাদে একদিন, তারপর আর এই ঈদে আমাদের বাড়িতে, ক্যাম্পে গরুর মাংস রান্না-খাওয়ার ব্যবস্থা হলো।
দুর্গা পুজার শেষে বিসর্জনের পরদিন অর্থাৎ বিজয়ার দিন বেতাই মাঠে ফুটবল ম্যাচের আয়োজন হলো।
জয়বাংলা দল আর ভারতীয় দল। গ্রাম থেকে আমরা দলধরে খেলা দেখতে গেলাম। সেদিন বেতাই যেন উৎসবে মেতে উঠল। সম্ভবত খেলাটি এক এক গোলে শেষ হয়েছিল। শরতের এই সময়টাতে চারিদিকে যেন অকারণেই একটা খুশি খুশি ভাব।
আমাদের কোন আনন্দ নেই! তারপরও আমরা ওদের সাথে আনন্দ করে চলেছি.....রাস্তা থেকে নামলেই ফসলে ক্ষেত। যার যত খুশি ধনে পাতা তুলে আনো, মুলা তুলে আনো, কেউ কিছু বলে না। আমাদের গ্রাম থেকে আরো একটু বর্ডারের দিকে শরণার্থীদের একটা গুচ্ছগ্রাম হয়েছিল। পাটকাঠি দিয়ে বানানো বেড়া আর নতুন টিনের চাল দেওয়া এক লাইনে অনেক ঘর। দূর থেকে দেখলেই চেনা যেত।
সেই শরণার্থী শিবিরের আশেপাশের সব ক্ষেত থেকে মুলো, গাজর, টোম্যাটো, ধনে পাতা তুলে খাওয়া তাদের কোন বাধা ছিল না। সেই যে খালের ধারে বসে ছেলেরা মাছ ধরত তার দুপাড় দিয়ে সাদা সাদা কাশ ফুল ফুটে থাকত। গ্রাম, শরণার্থী শিবির, গ্রামের মানুষ, ক্যাম্প, সব মিলিয়ে কোথাও যেন কোন অভাব-কষ্ট নেই! সবই যেন ঠিকঠাক মত চলছে.......কিন্তু মৃত লাশ আর রক্তাক্ত মানুষ আসা কে বন্ধ করবে?
অক্টোবরের শুরুতেই মেহেরপুরে যেন গজব নেমে এলো! এদিকে একের পর এক গেরিলা টিম অপারেশন চালাচ্ছে, তাতে কখনো কখনো দু-চার জন পাক সেনা মারা যাচ্ছে, আর তার পর দিনই পাঁচ-দশজন সাধারণ মানুষ গুলি খেয়ে হয় মারা যাচ্ছে না হয় আহত হয়ে এপারে চলে আসছে। আমাদের ক্যাম্পে ডাক্তার কাকার তাবুতে মাত্র দুটি বেড ছিল। এই সময়ে আরো চারটি বেড পাতা হলো আর একটা নতুন তাবুতে।
তাও সব সময় ভরে থাকত। প্রায় রোজই এক-দুজন করে আহত মানুষ আসতে লাগল। তারা আহত হয়ে ওখানকার হাসপাতালে যেতে ভয় পেত। অনেক কষ্ট করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বর্ডার পার হয়ে এখানে চলে আসত। কিছুদিনের মধ্যে সেই ছয়টা বেডেও কুলোচ্ছিল না।
বিএসএফ এর ক্যাম্পে আর বেতাই থেকে আরো ভেতরে তেহট্ট হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হতো তাদের। হাসপাতাল তাবুতে আমার প্রায় নিয়মিত ডিউটি পড়ে গেল। গুলি খাওয়া, পেটের নাড়িভুড়ি বের হয়ে যাওয়া মানুষদের ছানাছানি করতে করতে আমি হাঁপিয়ে উঠছিলাম। ইয়াসিন কাকাকে সাহায্য করার জন্য অনেক লোকই ছিল, কিন্তু তারা এখানে বসে থাকার বদলে যুদ্ধে যাওয়াই উচিৎ হবে ঠিক করায় আমাকে বাধ্য হয়েই ওই তাবুতে থাকতে হতো। আমার এই সময়কার অনুভূতি আমি যথার্থ ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতাম না।
কাউকে বোঝাতেও পারতাম না। সেই সব ভাঙ্গাচোরা হাত-পা কাটা-ছড়া শরীর, রক্তাক্ত মুখ দেখে দেখে চোখ ফেটে কান্না আসত। আবার সেই সব ছানাছানি করে পরে ভাত খেতে পারতাম না। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে চমকে উঠতাম। বাবা তাতেও রাজি, কারণ তখন যুদ্ধের ভয়াবহতা অনেক বেড়ে গেছে! বাবা জানতেন এখন আর আমাকে ফ্রন্টে পাঠানো যায় না।
গ্রামের ছেলেদের সাথে মার্বেল খেলার চেয়ে ক্যাম্পে থেকে এই হাসপাতালের কাজ করা অনেক ভাল।
অক্টোবরের মাঝামাঝির দিকে গেরিলা টিমগুলো মেহেরপুরে যেখানে যেখানে পাক বাহিনীর ক্যাম্প, ফাঁড়ি, পোস্ট বা অস্থায়ী ঘাঁটি ছিল সেই সব এলাকার লোকদের অন্য যায়গায় সরে যাওয়ার কথা বলে আসতে লাগল। তখন আমরা খবর পেতাম আমাদের আশেপাশে অর্থাৎ একদিকে কৃষ্ণনগর অন্যদিকে শিকারপুরে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমন জোরদার করেছে। আমাদের মত সেই সব ক্যাম্পেও ভারী গোলাবারুদ দেওয়া হয়েছে। তাদের দেখাদেখি হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক আমাদের ক্যাম্প থেকেও আক্রমন জোরদার করা হলো।
এই সময়ে ক্যাম্পে জনা কয়েক লোক রেখে প্রায় পুরো ক্যাম্প খালি করে যোদ্ধারা ফ্রন্টে চলে যেত। এক দিন একটা রেগুলার টিমের সাথে আট-দশ জন নতুন লোক আসল। অমন তো আমরা মাঝে মাঝেই দেখি, তাই ভাবলাম, ওরাও নতুন মুক্তিযোদ্ধা! কিন্তু পরে জানা গেল ওরা রাজাকার! ওই রাজাকাররা নাকি শুধু মাত্র নিয়মিত খাবারের জন্য রাজাকার দলে নাম লিখিয়েছিল। যুদ্ধ যখন অনেকটা জোরোশোরে শুরু হলো, তখন তারা দল ত্যাগ করে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখানোর জন্য টিমের সাথে এপারে চলে এসেছে। টিমের লোকরাই তাদের কথা দিয়ে এনেছিল যে তাদের কেউ মার ধর করবে না।
তাই আগের বারের মত এদের কেউ গালাগালি করল না। কেউ খারাপ ব্যবহার করল না। তাদেরকে মামুলি কিছু ট্রেনিং দেওয়া হলো, কিন্তু রাইফেল বন্দুক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ফ্রন্টে পাঠানো হলো না। তারা ক্যাম্পেই ডিউটি করত। এখানে তিনবেলা খেতে পেয়েই তারা খুশি! গাছের গুড়ি কেটে জ্বালানী খড়ি বানানো, মাটি কাটা, লঙ্গরখানায় বড় বড় চাউল-আটার বস্তা নামানো, ক্যাম্প ঝাড়– দেওয়া, বিভিন্ন পয়েন্টে সেন্ট্রি দেওয়ার কাজগুলোই তাদের দেওয়া হলো।
এই কাজগুলো আগে আমরাই করতাম। তাদের একজনকে কাকা হাসপাতাল টেন্টেও নিয়ে এলেন। তাতে করে আমার একটু কাজ কমল।
আরো কিছুদিন পর আমরা দু’টি গাড়ি পেলাম। দু’টিই জিপ।
আগে ফ্রন্টে যেতে হতো হেঁটেই। এখন সেই দু’টি জিপের একটিতে করে বেশ কিছুদূরে যাওয়ার পর বাকি পথ হেঁটে যেতে হতো। আমাদের পাশে যে ভারতীয় আর্মি ক্যাম্প ছিল তাদেরও একটা টিম আরো সামনে এগিয়ে প্রায় বর্ডারের কাছাকাছি কয়েকটা বাঙ্কার খুঁড়ল। সেখানে তাদের নিয়মিত পেট্রল চালু হলো। ওরা যখন ওখানে পজিশন নিল সেই সময় আমাদের টিমগুলো তাদের বাঙ্কারে না থেকে আরো ভেতরে ঢুকে পজিশন নিয়ে বসে থাকত।
আর গেরিলা টিম আগের মতই ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতে থাকল। আমার কাছে এই দিনগুলি অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে ভাল মনে হতো। আগে যেমন ভাল ভাবে বুঝিনা এমনই কোন কারণে মনটা ছোট হয়ে থাকত, নিজেকে অসহায় লাগত, সব সময় নিজেদের রিফিউজি মনে হতো। এখন আর তেমনটি মনে হতো না। আগে কোথাও বড় ধরণের গোলাগুলি শুরু না হলে ক্যাপ্টেন সাহেব যেমন ফ্রন্টে যেতেন না, এখন তিনি প্রতিদিনই সন্ধ্যে বেলা যে টিম যেত তার সঙ্গে চলে যেতেন।
আর্মার তাবুতে আরো ভারী ভারী গোলাবারুদ আসার পর আমার আর ওখানে ডিউটি দেওয়া হতো না। রাতে নিয়মিত বাড়িতেই থাকার সুযোগ পেলাম। এরই মধ্যে একদিন আমার ডিউটি পড়ল ক্যাপ্টেন সাহেবের তাবুর পাহারা দেওয়া। আমার রাজি হওয়া-না হওয়ার কোন ব্যাপার ছিল না। যেদিন সারারাত ক্যাপ্টেনের তাবু পাহারা দিলাম, সেদিন বার বারই মনে হচ্ছিল- "কে দেখবে? কিছু ব্যাটারি নিয়ে নিলে কে দেখবে"? ক্যাপ্টেন জানলে কি হবে তার চেয়ে বেশি ভয় ছিল বাবা জানলে কি হবে! অনেক কষ্টে ব্যাটারি চুরির ইচ্ছা দমন করলাম।
রাইফেল বন্দুক যেন ডাল ভাত! ওতো এমনিতেই পাওয়া যায়! আমার প্রধান আগ্রহ ছিল ব্যাটারি। মনে হতো অনেক ব্যাটারি পেলে কিছু না কিছু বানিয়েই ফেলব! যদিও কি বানাবো সে সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই!
অক্টোবরের শেষ দিকে একটু একটু শীত পড়া শুরু হলো শেষ রাতের দিকে। সন্ধ্যা রাত থেকেই একটু একটু কুয়াশা পড়ছিল। সন্ধ্যা হলেই সেই কুয়াশা দেখে চুয়াডাঙ্গায় ফেলে আসা ভোরের কুয়াশার কথা মনে পড়ে! খুব ভোরে উঠে আমরা বাড়ির বাইরে কানটুপি পরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। অনেক দূর থেকে কুয়াশার মধ্যে হেঁটে আসত রসওয়ালা।
ঘাড়ের বাঁখে দুই পাশে দুইটি মাটির ঠিলায় রস নিয়ে তারা হেঁটে আসত। তারা হাঁটত গরুর গাড়ি যাওয়া-আসা করে দুই পাশে খালের মত হয়ে মাঝখানে উঁচু হওয়া রাস্তায়। কুয়াশার কারণে অনেক দূর থেকে তাদের দেখা যেত না, কিন্তু আমরা জানতাম-আসছে, কারণ তারা কথা বলতে বলতে আসত। কথা শুনতাম, কিন্তু দেখতে পেতাম না। একেবারে কাছে এলেই তাদের দেখা যেত।
একটা অদ্ভুত ছন্দ ছিল তাদের হাঁটায়। বাঁখ দুলত আর সেই সাথে তাল রেখে তারাও দুলে দুলে হাঁটত। তাদের সবারই মাথায় কাপড়ের পাগড়ি মত বাঁধা থাকত। আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা ডেকে বসাতাম। তার পর কেউ টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি, কেউ টিনের জগ, কেউ পিতলের কলসিতে রস রাখতাম।
পয়সা নিয়ে আবার তারা সেই অদ্ভুত ভাবে হেঁটে চলে যেত.... অনেক দূর থেকেও তাদের সেই হাক-ডাক শোনা যেত- ‘রস গো খেইজরে রস.....রস গো খেইজরে রস.......একসময় ডাকটা মিলিয়ে যেত.....
এমনই এক ঘন কুয়াশার সন্ধ্যায় আবার আমার ডাক পড়ল ফ্রন্টের টিমে। আমাদের একেবারে সোজা বর্ডারে যে বাঙ্কার ছিল তার থেকে মাইল খানেক দূরে আরো নতুন বাঙ্কার করা হয়েছে। সেই বাঙ্কারে আর আগের বাঙ্কারে, এবং বাংলাদেশ সীমানার আরো ভেতরে যে পয়েন্টগুলোতে যাওয়া শুরু হয়েছে সেখানে যাবার ডাক। এখন বাঙ্কার থেকে রাত গভীর হলেই টিম বেরিয়ে যায়। বাঙ্কারে থেকে যায় অল্প কয়েকজন।
তাদের সেই টিমে রাতে থাকার জন্য অনেক দিন পর আবার তৈরি হয়ে নিলাম। অন্যবারের চেয়ে এবারকার ব্যাপারটা একটু আলাদা ঠেকল। আগের মত ভয় কিংবা উত্তেজনা নেই। মনে হলো যেন এতো রোজকার ডিউটি! সন্ধ্যের বেশ পরে যখন কুয়াশায় প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে তখন জিপে চেপে রওনা হয়ে গেলাম। এই টিমে আমার আগের টিমের কেউ নেই।
একেবারে অপরিচিত না হলেও আগের মত একান্ত আপন সেই যশোরের লিডার নেই। লাইট জ্বালানো ছাড়াই ছুটে চলল জিপটা.....সামনে-পেছনে দশ হাত দূরেও কিছু দেখা যায় না........কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে জিপটা........
চলবে...........
প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব। তৃতীয় পর্ব। চতুর্থ পর্ব।
পঞ্চম পর্ব। ষষ্ঠ পর্ব। সপ্তম পর্ব। অষ্টম পর্ব। নবম পর্ব।
দশম পর্ব। একাদশ পর্ব। দ্বাদশ পর্ব। ত্রয়োদশ পর্ব। চতুর্দশ পর্ব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।