বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে পশ্চিম রামপুরার ওয়াপদা রোডে নিজের পাঁচতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
নিহত ফজলুল করিম (৬০) ছয় বছর আগে অবসর নিয়ে নিজের ওই বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন। কর্মজীবনে তিনি এক দক্ষ কর্মকর্তা ছিলেন বলে তার সহকর্মীরা জানিয়েছে।
কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে- তা পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ঘাটন করতে না পারলেও নিহতের মেয়ের সন্দেহ, সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিরোধই এর কারণ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল জোনের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের জানান, কয়েকজন সন্ত্রাসী বাসায় ঢুকে ফজলুল করিমকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
গাড়িচালক ও ভাড়াটিয়ারা ফজলুল করিমকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোজাম্মেল হক জানান।
ফজলুল করিমের মৃত্যুর খবরে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাসপাতালে ছুটে যান।
সিআইডির বিশেষ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঊনিশশ আশির দশকে কয়েকটি আলোচিত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ফজলুল করিম।
ঘটনার বর্ণনা
নিজের পাঁচতলা ওই বাড়ির তৃতীয় তলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন ফজলুল করিম।
নিহতের শ্যালক তৌহিদ কাশেম খান প্রিন্স হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, ফজলুল করিমের স্ত্রী স্বপ্না করিম সকালে গুলশানে মেয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়েই তৃতীয় তলার সিঁড়িতে অস্ত্র হাতে এক যুবককে দেখতে পান।
আতঙ্কিত স্বপ্না ওই যুবকের কাছে জানতে চান, সে কাকে খুঁজছে। তখন সে অস্ত্রের মুখে স্বপ্নাকে আবার বাসায় ঢুকতে বাধ্য করে এবং তার ডাকে নিচ থেকে আরো দুই যুবক তৃতীয় তলায় উঠে আসে।
তারা স্বপ্নাকে একটি ঘরে আটকে রেখে ফজলুল করিমকে গুলি করে পালিয়ে যায় বলে প্রিন্স জানান।
“ওই সময় বাসায় অল্প বয়সী এক কাজের ছেলে ছিল। সে তিনটি গুলির আওয়াজ পাওয়ার কথা বলেছে,” বলেন প্রিন্স।
তবে ফজলুল করিমের মাথায় একটি গুলির চিহ্ন পেয়েছে পুলিশ।
ফজলুল ও স্বপ্না করিম ছাড়া দুই শিশু গৃহকর্মী তখন ওই বাসায় ছিল বলে প্রিন্স জানান।
ফজলুল করিম বাড়ির তিন তলার পুরোটাজুড়ে পরিবার নিয়ে থাকতেন। আর বাকি চারটি তলায় থাকে মোট আটটি পরিবার।
বাড়ির সামনে তিন কাঠার মতো খালি জায়গায় একটি গ্যারেজ ও ড্রাইভারের থাকার ঘর।
ড্রাইভার লিটন ওই ঘরেই থাকেন।
কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি ফজলুল করিমের প্রতিবেশীরা।
১০ বছর ধরে নিচ তলার ভাড়াটিয়া সাইদুর রহমান সন্দেহ করার মতো কারো নাম বলতে পারেননি। এমনকি গুলির শব্দও তিনি শোনেননি বলে দাবি করেছেন।
সাইদুর বলেন, “ড্রাইভার লিটন সকালে এসে দরজা ধাক্কাতে শুরু করে।
সে জানায়, কারা যেন বাড়িওয়ালাকে গুলি করেছে। পরে তার সঙ্গে ওপরে গিয়ে দেখি এই অবস্থা। ”
প্রতিবেশীদের সহযোগিতা নিয়ে লিটনই পরে ফজলুল করিমকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
ওই বাড়ির ঠিক বাইরেই মায়ের দোয়া জেনারেল স্টোরের মালিক মো. শাকিল হোসেন বলেন, যে সময় ঘটনা ঘটেছে বলা হচ্ছে, তখন তিনি দোকানেই ছিলেন। কিন্তু সন্দেহজনক কাউকে ওই বাড়িতে ঢুকতে বা বের হতে দেখেননি।
পারিবারিক বিরোধ?
ফজলুল করিম হত্যার ঘটনায় পুলিশ কাউকে চিহ্নিত করতে না পারলেও তার মেয়ে ফারজানা করিম বাঁধনের সন্দেহ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে নিকট আত্মীয়রাই তার বাবাকে হত্যা করেছে।
ফজলুল করিমের ভাইয়ের ছেলেদের সঙ্গে তার পরিবারের সম্পর্ক যে ভাল ছিল না, আরেক আত্মীয়র কথা থেকেও তা উঠে এসেছে।
ফারজানা ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের রামকৃষ্ণদি গ্রামে তাদের বাড়ি। সেখানে একটি বাড়ি নিয়ে চাচার পরিবারের সঙ্গে তাদের বিরোধ চলছিল।
তার বাবাকে কেন হত্যা করা হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ওদের ধরুন।
তাহলেই কারণ জানা যাবে। ”
সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তার দূর সম্পর্কের ভাতিজা সাজিদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ফজলুল করিমের ভাই বজলুল করিম বেশ কিছুদিন আগে মারা গেছেন। তার দুই ছেলে শান্ত ও রুবেলের সঙ্গে ফারজানাদের পরিবারের সম্পর্ক ভাল ছিল না।
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ছেলেগুলো বখাটে, পড়ালেখা করেনি। এই কারণে চাচাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল না।
”
গ্রামের বাড়িতে ফজলুল করিম রামকৃষ্ণদি কওমি মাদ্রাসা নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালাতেন বলেও সাজিদ জানান।
তিনি বলেন, “কিছুদিন আগে একটি টেলিভিশনে টক শো করেন চাচা। তারপর থেকে তাকে কয়েকবার হুমকি দেয়া হয় বলে শুনেছি। ”
তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি তিনি।
ফজলুল করিমের বাসা ঘুরে দেখে মতিঝিল পুলিশের উপ কমিশনার মো. আশরাফুজ্জআমান সাংবাদিকদের বলেন, “সিআইডি ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কাজ করছেন।
এখনই মোটিভ বলা সম্ভব হচ্ছে না। ”
সহকর্মীদের চোখে ‘দক্ষ’
নিহত ফজলুল করিম কর্মজীবনে চাঞ্চল্যকর অনেক ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে বলে সহকর্মীরা জানান।
১৯৭৫ সালের এক রাতে রাজবাড়ীর পাংশা থানায় সর্বহারা পার্টি অস্ত্রাগার লুটের জন্য আক্রমণ করে, ফজলুল করিম তখন ছিলেন ওই থানার ওসি।
“ভয়ে অন্য অফিসাররা থানা থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু তিনি (ফজলুল) এক কনস্টেবলকে নিয়ে থানায় ছিলেন।
সারারাত থানার ভেতরে থেকে লড়াই চালিয়ে যান। ভোর ৫টার দিকে দলের তিনজনের লাশ রেখে অন্য সর্বহারারা পালিয়ে যায়। ”
কর্মজীবনে ফজলুল করিমের দক্ষতার কথা তুলে ধরে এই স্মৃতিচারণ তার এক সময়ের সহকর্মী সহকারী পুলিশ সুপার খালেকুজ্জামানের।
খালেকুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই ঘটনায় সরকার ফজলুল করিমকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) দিয়েছিল।
সিআইডির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে ছয় বছর আগে অবসর নিয়ে রামপুরায় নিজের বাড়িতে থাকতেন।
ওয়াপদা রোডের ওই বাড়িতে ঢুকেই সকালে একদল দুর্বৃত্ত তাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিম ’৮০ দশকে মগবাজার এলাকার একটি বাড়িতে ডাকাতির তদন্তের কথা তুলে ধরেন ফজলুল করিমের সহকর্মী পুলিশ পরিদর্শক ইন্তেজার রহমান।
সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিম
‘রায়পুর হাউজ’ নামে এক বাড়িতে এক মহিলা ঢুকে গৃহিনীর শিশুসন্তানকে জিম্মি করে সোনা-গহনা ও টাকা পয়সা নিয়ে গিয়েছিল, যার তদন্ত করেন ফজলুল করিম।
“তিনি (ফজলুল করিম) ভিকটিম মহিলাকে মাত্র দুটি প্রশ্ন করেছিলেন, তারপর দু্’দিনের মধ্যে পারভীন ববি নামে অপরাধী মহিলাকে গ্রেপ্তার করেন,” বলেন ইন্তেজার।
নিহতের আরেক সহকর্মী সহকারী পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন ১৯৮৯ সালে মতিঝিলের এএনজেড গ্রীনলেজ ব্যাংকে ৫০ লাখ টাকা ডাকাতির কথা।
“স্যার (ফজলুল করিম) যাত্রাবাড়ী পরিবহন শ্রমিক নেতা হিরুসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন, যা ওই সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ”
ওই বছর রাজধানীতে চালক ও তার দুই সহযোগী হত্যাকাণ্ডের তদন্তের কথাও বলেন সাইফুল।
কেরানীগঞ্জের এক প্রভাবশালীর গুদাম থেকে ওই ট্রাকের লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার করেছিলেনন ফজলুল করিম।
বর্তমান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর কাজ করেছিলেন ফজলুল করিমের সঙ্গে। জুরাইনের ব্যাবসায়ী আলম হত্যাকাণ্ডের রহস্যভেদে ফজলুল করিমের দক্ষতার পরিচয় পেয়েছিলেন তিনি।
“বর্তমানে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ আছে। কিন্তু সে সময়ে অনেক ‘ক্লু লেস’ ঘটনার কারণ তিনি তদন্ত করে বের করে ফেলতেন। ”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।