হাতিয়ায় রাজনীতির শীর্ষ গুরু এখন ফজলুল আজিম ও মোহাম্মদ আলী। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি—এ দুই প্রধান দলেই রয়েছে তাদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব। হাতিয়া বিএনপিতে এখন দুই গ্রুপ মুখোমুখি, আওয়ামী লীগও দ্বিধাবিভক্ত। তবে এ গ্রুপিং এবং দ্বিধাবিভক্তির মূলে রয়েছেন ওই দুই নেতা। হাতিয়া আওয়ামী লীগে অধ্যাপক ওয়ালী উল্যার নেতৃত্বাধীন কমিটির নেতারা প্রতিপক্ষ গ্রুপকে বলেন, মোহাম্মদ আলীর পকেট কমিটি; আর মোহাম্মদ আলী-সমর্থিত কামাল উদ্দিন প্রিন্সের নেতৃত্বাধীন কমিটির নেতারা প্রতিপক্ষকে বলেন, ফজলুল আজিমের পকেট কমিটি।
আবার বিএনপিতে সাখাওয়াত হোসেন শওকতের সমর্থকরা বলেন, আলাউদ্দিন সমর্থকরা ফজলুল আজিমের লোক; আর আলাউদ্দিনের সমর্থকরা বলেন, সাখাওয়াতের রিমোট মোহাম্মদ আলীর হাতে। তবে এখানে সব দলের কর্মীরাই বলেন, হাতিয়ায় রাজনীতি নেই, এখানে নেতার নীতিতেই সবাই বিশ্বাসী; কেউ দাদার সমর্থক,
আর কেউ স্যারের। সাবেক বিএনপি নেতা ও বর্তমান এমপি ফজলুল আজিম সমর্থকদের কাছে স্যার এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সমর্থকদের কাছে প্রিয় দাদা। এ দুজনের নির্দেশ ছাড়া হাতিয়ায় কিছুই হয় না। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হানাহানির প্রসঙ্গ তো আছেই, এমনকি ঘরে স্বামী-স্ত্রী বা ভাই-বোন ঝগড়ায় লিপ্ত হলেও কেউ হয়ে যান মোহাম্মদ আলীর আর কেউ আজিমের সমর্থক।
সরেজমিন ঘুরে হাতিয়ার সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
জানা যায়, স্বাধীনতার আগে থেকে দেলোয়ার হোসেন উকিল ছিলেন হাতিয়া আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা। আর মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন আমিরুল ইসলাম কালাম। এরা মূলত যখন যে দল করতেন জনগণও সেভাবেই বিভক্ত হতো। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ’৭৩-এ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এমপি হন এবং দলের নেতৃত্বে আসেন ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী মুসলিম লীগ নেতা আমিরুল ইসলাম কালাম।
আবার ’৭৯-এর জাতীয় নির্বাচনে তিনি বিএনপি থেকে বিজয়ী হয়ে মন্ত্রীও হন। তখন থেকে মূলত হাতিয়ার বিএনপি মানেই আমিরুল ইসলাম কালাম আর দেলোয়ার উকিলের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব আসে অধ্যাপক ওয়ালী উল্যা ও তার বড় ভাই জিয়াউল হক তালুক মিয়ার হাতে। ’৮৬-তে যুবদল ছেড়ে জাতীয় পার্টির এমপি হয়ে নেতৃত্বে আসেন মোহাম্মদ আলী। তিনিও গড়ে তোলেন নিজের বলয়। ’৯১-তে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হন অধ্যাপক ওয়ালী উল্যাহ আর ’৯৬-তে বিএনপি থেকে এমপি হন প্রকৌশলী ফজলুল আজিম।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন মোহাম্মদ আলী। এসময় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অবস্থান ছিল মোহাম্মদ আলীর পক্ষে। আর বিগত ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন ফজলুল আজিম। এসময় বিএনপির সমর্থকদের অবস্থান ছিল তার পক্ষে। আর জামানত হারাতে হয় বিএনপির মনোনীত প্রার্থীকে।
মূলত এ দুটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হাতিয়ার রাজনীতির শীর্ষ গুরু বনে যান মোহাম্মদ আলী ও ফজলুল আজিম। হাতিয়া আওয়ামী লীগে মোহাম্মদ আলীর অবস্থান এমনই যে আওয়ামী লীগ কেন্দ্র অনুমোদিত অধ্যাপক ওয়ালী উল্যার নেতৃত্বাধীন কমিটির পাশাপাশি কাজ করছে মোহাম্মদ আলীর গঠিত কামাল উদ্দিন প্রিন্সের নেতৃত্বাধীন কমিটি। আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক ওয়ালী উল্যাহ এখন হাতিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়া সত্ত্বেও এখানে সবকিছুই চলে মোহাম্মদ আলীর নির্দেশে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাস—সবকিছুই চলছে মোহাম্মদ আলীর নামে। তার সমর্থকরা দলের অপর গ্রুপকে আওয়ামী লীগ বলেই স্বীকার করে না।
বলে ওরা আজিমের গ্রুপ।
এদিকে বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় হাতিয়া উপজেলা কমিটি গঠন নিয়েও দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি। ফজলুল আজিম বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর ওই কমিটির নেতারা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে সভাপতি করার পক্ষে। আর বিগত নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন শওকতকে সভাপতি করার পক্ষে উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক লিসানুল আলম লেনিনসহ পৌর বিএনপির নেতারা। এ দু’জনের পক্ষে জেলা এবং কেন্দ্রে লবিং চলছে সমানতালে।
জেলা বিএনপি গত ১৪ নভেম্বর সাখাওয়াত হোসেনের কমিটিকে অনুমোদন দিলেও তারা সম্মেলন প্রস্তুতির কাজ করতে পারছে না এলাকায়। কেন্দ্রেও এ কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা। তারা বলছেন, সাখাওয়াত অতীত থেকেই আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলীর হয়ে কাজ করছেন। তাই বিগত জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ নিয়েও মাত্র ৬৮০ ভোট পেয়েছেন। উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার আবুল কালাম আমার দেশকে বলেন, সাখাওয়াত হোসেন বিএনপির নেতা কর্মীদের বাদ দিয়ে মোহাম্মদ আলীর আত্মীয়স্বজন ও আওয়ামী লীগের এজেন্ট নিয়ে বিএনপির কমিটি করতে চায়।
কিন্তু হাতিয়া বিএনপির নেতাকর্মীরা দলের বিরুদ্ধে এসব চক্রান্ত প্রতিরোধ করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যারা বিগত নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে কাজ করেনি তারা তো বিএনপি সমর্থক নন। তারা আজিমের পেইড এজেন্ট। আমি ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে দলকে বের করে আনতে চাই।
অপরদিকে সাখাওয়াত গ্রুপ কর্তৃক আজিম সমর্থক হিসেবে অভিযুক্ত জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন আমার দেশকে বলেন, আজিম সাহেব বিএনপিতে না থাকলেও নেতাকর্মীরা দলের প্রশ্নে আপসহীন।
উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গেই আমি কাজ করছি। বিএনপিতে আজিম গ্রুপ বলে কিছু নেই। এখানে সবাই শহীদ জিয়ার আদর্শে এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিশ্বাসী। যারা গডফাদার ও চাঁদাবাজদের পক্ষে অবস্থান নেন তারা বিএনপি হতে পারেন না।
এদিকে হাতিয়া আওয়ামী লীগের দ্বিধাবিভক্তি প্রসঙ্গে উপজেলা আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন প্রিন্স বলেন, অধ্যাপক ওয়ালী সাহেব বিগত নির্বাচনে আজিম সাহেবের পক্ষে কাজ করেছেন।
তারা কীভাবে আওয়ামী লীগ হন। তাদের চাচা-ভাতিজার কমিটি কখনও অনুমোদিত হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ওয়ালী উল্যাহ বলেন, হাতিয়ার সম্প্রতি সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বেড়েছে। ঘনঘন দল পরিবর্তনকারী নেতারাই সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। এরা আওয়ামী লীগ নন।
তিনিই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এটা প্রধানমন্ত্রীও অবগত আছেন বলে তিনি জানান। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের এসব পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মূলত হাতিয়ার রাজনীতিতে মোহাম্মদ আলী এবং ফজলুল আজিম এমপির নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। হাতিয়াবাসীও কোনো নেতার লোক হিসেবে পরিচিত হতে পছন্দ করেন। কে স্যারের আর কে দাদার লোক বলে পরিচিত হবেন, এ প্রতিযোগিতা এখন হাতিয়ায়।
থানা পুলিশও স্বীকার করেছে, কোনো ঝগড়া-বিবাদ শেষে উভয় পক্ষ থানায় গিয়ে বলে, ‘আমি ওমুকের লোক। ’
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।