আমি নির্বাক হয়ে গেলে তোমার পতন অনিবার্য !
এমনিতেই আমি মানুষ হিসাবে কিছুটা অসামাজিক। তথাকথিত সামাজিকতার ধারে কাছে আমার জায়গা নেই। ফলে ঢাকায় যতদিন থেকে বসবাস করে আসছি তারপর খুব কম ঈদ-ই বাড়িতে করা হয়েছে। এত ভীড় কাটিয়ে, ঝামেলা করে বাড়িতে যেতে আমার ভালো লাগে না। যাই শুধু মা’র জন্য।
মা কে যেবার বোঝাতে পারি আমার কাজ আছে সেবার ঢাকাতেই থাকি, মটকা মেরে পড়ে থাকি ঘরের মধ্যে। যেবার মা বুঝতে চান না সেবার যেতেই হয়। এবার কোরবাণীর ঈদে বাড়ি যাব এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। মা বলেছেন, যেতেই হবে। ঈদে বাড়ি যাওয়া মানে নিজেকেও কোরবাণী করা, আমার কাছে তাই মনে হয়।
আমি যেন কোরবাণী হয়েই ফিরে এলাম।
আগেই বলেছি আমি একটু অসামাজিক। একই সঙ্গে কিছুটা অলস প্রকৃতিরও বটে। আগে থেকে লাইন ধরে বাসে টিকিট কাটা আমার হয়ে ওঠেনি। যদিও আমি বাসের চাইতে ট্রেনে যাতায়াত করতে বেশি পছন্দ করি।
ট্রেনের অগ্রীম টিকিট কাটা তো আরও জটিল বিষয়। স্বাভাবিক সময়ে ট্রেনের টিকিট কাটতে খুব কম সময়েই শুনেছি যে ‘সিট খালি আছে’। অধিকাংশ সময় ‘আসন খালি নাই’ শোনা যায়। কিন্তু ট্রেনে উঠে দেখা যায় সব সিট ফাঁকা। এই হলো আমাদের রেলওয়ে।
টিকিট কাটা হয়নি ঠিকই কিন্তু বাড়িতে তো যেতেই হবে। ট্রেনে যাব। ভাবলাম যেদিন যাব সেদিন কমলাপুর গিয়ে একটা স্ট্যান্ডিং টিকিট যদি পাই তবে তাই হবে। কিন্তু বিধি বাম ট্রেনটা মিস করলাম। সময়মতো কাজ গুছিয়ে উঠতে পারলাম না।
বাসে টিকিট পাওয়া যাবে না এটা তো জানা কথা। আমার এক বন্ধু আছে তাকে ফোন করলাম। সে প্রায়ই পত্রিকার গাড়িতে বাড়ি যায়। অফিস শেষ করে রাত বারোটায় (সে সাংবাদিক, আমিও) তারপর পত্রিকার মাইক্রোতে উঠে চলে যায়। আমি তাকে ধরলাম আমাকে একটা পত্রিকার মাইক্রোতে উঠিয়ে দিতে।
দশ মিনিট পরে জানাল, চিন্তা নেই দিনাজপুরের গাড়িটা ছাড়বে রাত বারোটায়। আমি একটু নিশ্চিন্ত হলাম। আড্ডা দিয়ে রাত এগারটায় বাসায় ঢুকে ব্যাগ গুছালাম। বাসা থেকে বের হলাম রাত বারটায়। আমার বাসা ইস্কাটন।
গাড়িও ছাড়বে ইস্কাটন থেকে। অতএব নো চিন্তা।
নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে জানা গেল গাড়ি ছাড়বে একটায়। আর মাইক্রো না, পত্রিকা নিয়ে যাবে একটি পিকআাপ। যাক পিকআপ হলেও সমস্যা নেই।
তবুও যেতে হবে। রাতে সেই বন্ধু (সাখাওয়াত), জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা মারছি। কাঙ্খিত সেই পিকআপ আসছে না। দেড়টার দিকে ওরা আমাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। আমি বসে আছি।
গাড়ি আসল রাত তিনটায়। পিকাপ না, আসল আস্ত একটা ট্রাক। পেছনের অংশটা লোহার রড দিয়ে কভার করা, উপরে ত্রিপল।
ট্রাকে পত্রিকা উঠানো হলো। সঙ্গে মানুষ আমরা প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন।
সবাই পরিমরি করে উঠলাম। একজনের সহায়তায় পত্রিকার উপরে বসলাম এক সাইডে। পা সোজা করার উপায় নেই। বাকা করে বসে আছি। কারওয়ান বাজারে গিয়ে সেই ত্রিপলের উপর আরও লোক উঠানো হলো।
আমাদের মাথার ওপরেও ত্রিশ-চল্লিশ জন। ট্রাক চলা শুরু করল। ঝিম মেরে পরে আছি আমি।
কখনও চলছে কখনও বা থেমে আছে এভাবেই যাচ্ছে আমাদের ট্রাকটি। নবীনগর পার হতে হতে আমাদের সকাল হয়ে গেল।
রাস্তায় প্রচ- জ্যাম। সব গাড়ি স্থির হয়ে আছে । আমরাও স্থির। আমাদের ড্রাইভার মহোদয় বুদ্ধি করে একটি লোকাল রাস্তায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন এবং যেতে থাকলেন। এভাবে আকাঁ বাকা লোকাল রাস্তা দিয়ে আমরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর আবার যমুনা সেতুর আগে এলেঙ্গা নামে একটা জায়গায় হাইওয়েতে উঠলাম।
তারপর এক টানে বগুড়া। তখন দুপুর দুইটা। মাঝে দুই মিনিটের একটা জল বিয়োগের বিরতি ছিল। আর কিছু না।
বগুড়া থেকে দিনাজপুরে পত্রিকা নিয়ে যাবে যেই মাইক্রোটি সেটিতে আমার যাওয়ার কথা।
কিন্তু শুনলাম দিনাজপুরে যাবে না, যাবে সৈয়দপুর পর্যন্ত। মাইক্রোর ড্রাইভারকে বিনয়ের সঙ্গে বললাম আমি সৈয়দপুর যাবো, আমাকে একটু নিয়ে যাইয়েন। সে আমার বিনয়ের মর্যাদা রাখল। আমাকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসালো। মাইক্রোতে যেতে পারবো কি না সে বিষয়ে একটু শংকা ছিল।
কারণ পত্রিকা ওঠানোর পর পাঁচ-ছয় জনের জায়গা খালি। মানুষ আমরা ১২/১৩ জন।
আগের তুলনায় এবার একটু আরামের জার্নি। ড্রাইভার মহাশয় সকালের পত্রিকা নিয়ে যাচ্ছেন দুপুরে। তাঁর মোবাইলে প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর কল আসছে।
তাদের প্রশ্ন ‘এখন কোথায়?’ ড্রাইভার উত্তর দিচ্ছে, ‘এখন এই জায়গা পার হচ্ছি। এখন এই জায়গা। ’ স্বভাবতই দেরি হওয়ার কারণে ড্রাইভারও খুব স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। রাস্তায় আগের তুলনায় বড় গাড়ির সংখ্যাও বেশি। ড্রাইভিং সিটের পাশে বসার কারণে বার বার মনে হচ্ছে এবার বুঝি বাড়ি যাওয়া হবে না।
যেতে হবে হাসপাতালে আর তা না হলে ‘না ফেরার দেশে’। কিন্তু নাহ, শেষ পর্যন্ত সৈয়দপুর পার হয়ে নীলফামারি গিয়ে নামলাম। তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। এখানে বলে নিই আমার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর জেলার একেবারের উত্তর সীমান্তে। আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার পরই পঞ্চগড় জেলা শুরু।
অতএব নীলফামারী থেকে সোজা পশ্চিমে ২০ কিলোমিটার গেলেই বাড়ি। যদিও যোগযোগ ব্যবস্থা খুবই কাহিল। এইটা হলো শর্টকাট রাস্তা।
নীলফামারিতে নেমে একটা প্রাণ ম্যাংগো জুস খেলাম। এর আগে রংপুরে একটা জুস খেয়েছিলাম।
এই আমার সারাদিনের খাবার। একটা রিকশা ভ্যান ঠিক করলাম চল্লিশ টাকা দিয়ে। বাজারের পাশে নদীর ঘাটের এপার পর্যন্ত নিয়ে যাবে। ঈদের আগের রাত, আর এই দিকের রাস্তাঘাট একটু ফাঁকা। আমার তত যাতায়াতও নেই।
ফলে কিছুটা ভয়ও ছিল। ডাকাতের কবলে পড়ি কি না সেই ভয়। টাকা-পয়সা তো তেমন নাই মাইরটা ফ্রি খাইতে হবে। না, কোনও ঝামেলা ছাড়াই বাজারে গিয়ে পৌছলাম। রাত তখন সাড়ে আটটা।
আগে ঢুকলাম আমার বড় বোনের বাসায়। ঢুকেই বললাম, ভাত দাও। আমি সারাদিন কিছু খাই নাই। সেখানে ভাত-টাত খেয়ে বাজারের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করে বাসায় গেলাম। আহ শান্তি... ঈদটা তবু বাড়িতে করতে পারছি।
ঈদের তিন দিন ভালোই কাটল। আনন্দ ফুর্তিতে। খাওয়া দাওয়ার উপর। বাড়িতে গেলে মা খালি খাইতে বলে। জোর করে খাওয়াইতে চায়।
মাঝে মাঝে বিরক্তও হই।
এবার ফেরার পালা। ৩০ নভেম্বর। বাসা থেকে দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশনে আসলাম। দিনাজপুর স্টেশনের টিকেট মাস্টারের সঙ্গে একটু পরিচয় আছে, মোবাইল নাম্বারটাও আছে।
আসার আগে তাকে একটা ফোন দিলাম, ‘আঙ্কেল টিকেট লাগবে একটা। ’ সে জানাল ছুটিতে আছে। সমস্যা নেই কাউন্টারে গিয়ে যে আছে তাকে আঙ্কেলের নাম বলে ফোনটা ধরিয়ে দিতে। গেলাম দিনাজপুর। এর মধ্যে বাসা থেকে বের হতে একটু দেরি হওয়াতে সাড়ে ছয়টার বাসটা চলে গেল।
ট্রেন রাত আটটা পঞ্চাশে। সাড়ে ছয়টার বাসে উঠলে টাইমমতো স্টেশনে আসা যাবে। কিন্তু কপাল খারাপ অথবা আমার আলসেমি।
একটা মাইক্রো পেলাম সেটাতে উঠে আসলাম থানা শহর পর্যন্ত, সেখান থেকে গেটলক(আসলে লোকাল) বাসে দিনাজপুর। স্টেশনে ট্রেনের সাপ্তাহিক বন্ধ সোমবার, সেদিন সোমবার ছিল।
হায়রে কপাল আমার। কি আর করা। স্টেশন মাস্টারের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, একটা লোকাল ট্রেনে উঠে পার্বতীপুর যান সেখান থেকে নীলসাগর ছাড়বে রাত বারোটায় সেটায় যেতে পারবেন। আমারও এমন পরিকল্পনা ছিল।
লোকাল ট্রেন আসল রাত সাড়ে নয়টায়। ছয় টাকা দিয়ে একটা টিকিট কেটে উঠলাম ট্রেনে। দিনাজপুর থেকে পার্বতীপুর দুরুত্ব ৩১ কিলোমিটার। লোকাল ট্রেনে যেতে সময় লাগলো দেড় ঘণ্টা।
পার্বতীপুর স্টেশনে গিয়ে একটা টিকিট ম্যানেজ করলাম ৪০ টাকা বেশি দিয়ে।
আসনওয়ালা টিকিট। ট্রেন ছাড়ার কথা রাত বারো টায়। স্টেশন মাস্টার বললেন, ট্রেন এক ঘণ্টা লেট। অর্থাৎ রাত এক টার পর ট্রেন ছাড়বে। সেই ট্রেন আসল দেড়টায়।
উঠলাম। সিটে একজন বসে ছিলেন, নির্দয় হয়ে তাকে তুলে দিলাম। বসলাম। এবার ঘুমানোর পালা। কারণ সকালে ঘুমানোর সময় পাওয়া যাবে না।
অফিস করতে হবে। ঘুমায়ে ঘুমায়ে আসছি, সকালের দিকে আমার পাশের সিটের ভদ্রলোক হেসে হেসে বললেন, আপনিতো পুরো সময় ঘুমালেন। আমি হাসলাম। ঢাকার বিমান বন্দর স্টেশনে নামলাম সকলার দশটায়। ইস্কাটনের বাসয় আসলাম সাড়ে দশটায়।
এগারটায় অফিসে ঢুকলাম। আবার যান্ত্রিক জীবনে প্রবেশ।
এবারের বাড়ি যাওয়ার মতো কষ্ট আর কখনও করেছি বলে মনে পড়ে না। তাই এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঈদে বাড়ি যাওয়ার কষ্টকর অভিজ্ঞতা থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ‘আমি আর কোনও ঈদে বাড়ি যেতে চাই না’।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।