আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আল রাজী: মধ্যযুগের এক সুচিকিৎসক

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
আল রাজী (৮৬৫-৯২৫) মধ্যযুগের বিশিষ্ট মুসলিম চিকিৎসাবিদ। শেষ জীবনে চোখে ছানি পড়েছিল, তো ছানি অপসারণের কথা উঠলে আল রাজী বললেন: “না, থাক। জীবনে অনেক দেখেছি।

” এমন মানুষ ছিলেন আল রাজী। গ্যালেনসহ প্রাচীন গ্রিকদের রচিত হাজার পৃষ্ঠার চিকিৎসাশাস্ত্র সংকলন করেছিলেন; শরীর ও মনের সম্বন্ধ তথা সাইকোফিজিক্যাল আসপেক্ট সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন রাজী; শুধু তাই নয়- স্বাস্থের সঙ্গে পুষ্টির সর্ম্পকটিও আঁচ করতে পেরেছিলেন। অনুভূতিনাশক পদার্থ হিসেবে আফিমের ব্যবহার এবং ক্ষতস্থানের সেলাইয়ে পশুর পেটের নাড়িভুঁড়ির ব্যবহার প্রথম তিনিই করেছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, “চিকিৎসাশাস্ত্র সহস্র বর্ষের উপলব্দির ফলশ্রুতি । ক্ষুদ্র এই জীবনে কতিপয় ব্যক্তির নিকট থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান অপেক্ষা সহস্র বর্ষের অভিজ্ঞতার দ্বারা সঞ্চিত জ্ঞানই আমার নিকট অধিক মূল্যবান।

” চিকিৎসাবিদ ছাড়াও দর্শনে রাজীর গভীর আগ্রহ ছিল। ঈশ্বর, আত্মা ও বিশ্বের উপাদান সম্বন্ধে তাঁর ধারণা বেশ কৌতূহল উদ্দীপক। এ বিষয়ে এই নিবন্ধের শেষে সংক্ষেপে আলোচনা করব। সে এক দারুন সময় ছিল। খ্রিষ্টীয় নবম শতক।

সময়টাকে ইসলামী রেনেসাঁর কাল বলা যায় কি? বাগদাদে আব্বাসীয় বংশের শাসন। খলিফা আবু জাফর আবদুল্লাহ আল মামুন ইবনে হারুন (১৩ সেপ্টেম্বর ৭৮৬-অগাস্ট ৮৩৩) তিনি কাকে স্বপ্নে দেখতেন জানেন? আরিষ্টটলকে! কেন? একটু পরে বলছি। ততদিনে বাগদাদে বায়েত আল হাকিম বা প্রজ্ঞার ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এটি আসলে অনুবাদ কেন্দ্র ও গ্রন্থাগার- প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খলিফা আল মামুন-এর বাবা খলিফা হারুনুর রশীদ। পিতার ঐতিহ্য অনুসরণ করে খলিফা আল মামুন গ্রহসমূহের দূরত্ব নিরুপন করার জন্য বাগদাদের উপকন্ঠে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দেন।

যে কারণে পরবর্তীকালে চাঁদের জ্বালামুখের নাম তাঁর নামেই (আলমানন) করা হয়। এ কারণেই প্রশ্ন রেখেছিলাম খ্রিষ্টীয় নবম শতককে ইসলামী রেনেসাঁর কাল বলা যায় কি? যদিও খলিফা আল মামুন-এর শাসনামলেই মিহনা (ইসলামী ইনকুইজিশন) কার্যকর করা হয়েছিল, প্রবল প্রতিবাদের মুখে সেটি অবলুপ্ত করে উলেমরা ইসলামভিত্তিক সমাজচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যান। নবম শতকে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিরোধ ছিল। নবম শতকই ইসলামের অন্যতম মাজহাব এর প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ ইবনে হানবল এর সময়কাল। তিনি ইসলামী ইনকুইজিশন মিহনা-র প্রবল বিরোধীতা করেছিলেন।

ঐশিজ্ঞানের তুলনায় মানবীয় জ্ঞানবুদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা মুতাজিলা সম্প্রদায়ের উত্থান হয়েছিল ঐ নবম শতকেই। মুতাজিলা সম্প্রদায়ের ওপর খলিফা আল মামুনের সহানুভূতি ছিল। এরা ছিল গ্রিক যৌক্তিক তথা অ্যারিষ্টটটলপন্থি; পক্ষান্তরে আহমেদ ইবনে হানবল নির্ভর করতেন কেবলমাত্র কোরাণ এবং হাদিস এর ওপর। মুতাজিলাদের কোরাণকে শাশ্বত ভাবতে পারেনি, তাদের মতে কোরাণ নির্দিষ্ট সময়কালে সৃষ্ট -আল্লাহ্র মত অনন্ত নয়! এই রকম সাহসী ধারণার পিছনে অ্যারিষ্টটটল এর প্রভাব ছিল সক্রিয়। এতসব বলার কারণ? খলিফা আল মামুনের দরবারে জ্ঞানীগুণিরা আরিষ্টটলের দর্শন নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতেন।

খলিফা তো আরিষ্টটল-এর স্বপ্ন দেখবেনই! এমনই এক জ্ঞানদীপ্ত পরিমন্ডলে ৮৬৫ খিষ্টাব্দেরর ২৬ আগষ্ট পারস্যের রে নগরে নবম শতকের বিশিষ্ট চিকিৎসক আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে জাকারিয়া আল রাজীর জন্ম । রে নগরটি ছিল পারস্যের উত্তর পুবে। শৈশব কেমন ছিল এই জ্ঞানী মানুষটির? সংগীতময়। শৈশব থেকে শেষ বয়স অবধি সংগীত চর্চা করেছেন আল রাজী। লুট (এক ধরণের তারযন্ত্র) বাজাতেন আল রাজী, গানও নাকি গাইতেন।

পরিনত বয়েসে রচনা করেছেন সংগীতকোষ। দর্শন চর্চাও করতেন। তবে প্রথম জীবনে অধিবিদ্যা নাকি তেমন টানেনি। (অধিবিদ্যা কে বলা হয় মেটাফিজিক্স। বাস্তবতাকে জানা সম্ভব কি না অধিবিদ্যা সে বিষয়ে আলোচনা করে।

) তরুণ বয়েসে বাগদাদ আসেন রাজী। সেখানকার চিকিৎসালয়, গ্রন্থাগার তাঁকে জ্ঞানচর্চার সুযোগ করে দেয়। কিছুকাল পরে জন্মনগরে ফিরে এলেন। নগরের চিকিৎসালয়ের প্রধান প্রশাসক নিযুক্ত করা হল তাঁকে। তবে বাগদাদ থেকে আবার ডাক আসল।

বাগদাদের চিকিৎসালয়ের প্রধান চিকিৎসক নিযুক্ত হলেন । সে সময়ে খলিফা আল মুকতাফির সময়। এঁর শাসনকাল ৯০২-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ। প্রধান চিকিৎসক হিসেবে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন রাজী। আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের নগরে থেকে নগরে পরিভ্রমন করে অভিজাত শাসকশ্রেণির চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন।

দরিদ্ররাও তাঁর চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হত না । প্রায়শ গরীব রোগীদের কাছ থেকে ফি নিতেন না। উপরোন্ত নিয়মিত দান করতেন রাজী। চিকিৎসাকালীন সময়ে অষুধ ছাড়াও পথ্যের ওপর জোর দিতেন রাজী। সেরে ওঠার সময়ে রোগীর কি কি খেতে ইচ্ছে করত মন দিয়ে শুনতেন।

তবে সবচে বেশি গুরুত্ব দিতেন চিকিৎসক ও রোগীর সর্ম্পকের ওপর। তাঁর বিশ্বাস ছিল চিকিৎসকের হাস্যজ্জ্বল মুখ রোগীর দ্রুত আরগ্যের অন্যতম কারণ। চিকিৎসাশাস্ত্র, শল্যবিদ্যা, গণিত, দাবা ও সংগীত বিষয়ে প্রায় সারা জীবনই লিখেছেন রাজী। রাজীর সর্বমোট গ্রন্থের সংখ্যা ২৩০। তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থগুলি ইউরোপীয় ভাষায় যথাসময়ে অনূদিত হয়েছে।

১৬ শতক অবধি সেসব ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত হত। তাঁর লেখা সবচে গুরুত্বপূর্ন গ্রন্থের নাম “কিতাব আল হাউয়ি” (সিসটেম অভ মেডিসিন) । হাজার পৃষ্ঠার বিশাল গ্রন্থ, চিকিৎসক-জীবনে রাজী কী ভেবেছেন, কী দেখেছেন সেসবের সারৎসারই কিতাব আল হাউয়ি। এটিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশ্বকোষও বলা যায় । “কিতাব আল হাউয়ি” সবচে উল্লেখযোগ্য দিক- গ্রিক ও ভারতীয় চিকিৎসাপদ্ধতির ওপর রাজী বিস্তারিত আলোচনা, যার প্রতিটি ছত্রে গভীর প্রজ্ঞার ছাপ সুস্পস্ট।

ইহুদি পন্ডিতেরা এটি অনুবাদ করে ইউরোপে পরিচিত করে তোলেন। (আমরা আগেও দেখেছি নবম শতক ও তারও পরে জ্ঞানের সূত্র ধরে ইহুদি ও মুসলিম পন্ডিতরা একে অন্যের কাছাকাছি এসেছিলেন। ইবনে রুশদকে পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন স্পেনের ইহুদি দার্শনিক মাইমোনাইদেস বা ইবনে মৈমুন) যা হোক আজ অবধি বিশ্বজুড়ে আল রাজীর গৌরব ও সম্মান এই গ্রন্থটির কারণেই। গুটিবসন্ত (স্মল পক্স) ও হাম এর ওপর লেখা তাঁর একটি গ্রন্থও বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল । গুটিবসন্ত অনেক আগেই চিহ্নিত করা হলেও সে বিষয়ে রাজীর পর্যবেক্ষণ ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর ও প্রায় আধুনিক।

নানা ভাষায় অনুদিত হয়েছিল বইটি। কেবল চিকিৎসাগ্রন্থই নয়-তাঁর লেখা দর্শনগ্রন্থও ইউরোপের বিদগ্ধ মানুষ পাঠ করেছিল আগ্রহভরে। শরীরের চেয়ে আত্মার প্রাধান্যই মেনে নিয়েছিলেন রাজী, সে যুগে এমনটা ভাবাই ছিল স্বাভাবিক, আজও অনেকেই এমনই ভূল করে থাকেন! রাজী মনে করতেন, প্রথমে একটি শুদ্ধ আধ্যাত্মিক জ্যোতি আবিভূত হয়েছিল। এই জ্যোতিই আত্মার (জীবের) উপাদান-কারণ। (এই ভাবনা আসলে কবির ভাবনা।

আমার তেমনই মনে হয়। কেননা, প্রত্যেকেই তো সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ভাবতে উদ্দীপনা বোধ করেন; সৃষ্টিরহস্য নিয়ে কিছু বললে বিজ্ঞান প্রায়শ হয়ে ওঠে কাব্যিক) ... অতএব আত্মা এক প্রকাশ উন্মুখ আধাত্মিক উপাদান। (এও কাব্য) আত্মার ভালোমন্দ শরীরেও প্রভাব বিস্তার করে। (এই কথার মানে কিন্তু বোঝা গেল না!) প্রাণি যেহেতু জড় পদার্থের চেয়ে আলাদা-কাজেই আত্মাও একপ্রকার পদার্থ! (ভাবনাটি আসলে অ্যারিস্টটলের) কোনও কোনও আত্মা বুদ্ধি এবং শিল্পের চর্চা করে। কাজেই বোঝা যায় বুদ্ধির স্রোত কোনও বুদ্ধিমান কর্তা।

(আধুনিক সময়ে অবশ্য এর ব্যাখ্যা অনেক বদলে গেছে। শ্রম এর প্রসঙ্গটি এসেছে। ) যা হোক। ৫টি উপাদানকে রাজী নিত্য ও সদা সহাবস্থিত বলে মেনেছেন। ১ কর্তা (ঈশ্বর) ২ বিশ্বাত্মা (৩) মূল ভৌতিক উপাদান (৪) পরমার্থ দিশা ও ৫ পরমার্থ কাল।

(তখন বললাম না, প্রত্যেকেই তো সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ভাবতে কিংবা ব্যাখ্যা করতে উদ্দীপনা বোধ করেন!) ...এসব অতি প্রয়োজনীয় উপাদান ছাড়া বিশ্ব সৃষ্টি হতে পারত না। বস্তু সদা পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীলতাই কালের (সময়ের) অস্তিত্ব ঘোষনা করে। এই কারণেই রসায়নশাস্ত্রের প্রতি আস্থাবান ছিলেন রাজী। তিনি লক্ষ করেছিলেন, বস্তুজগতের বিভিন্ন মূল উপাদানের মিশ্রণ ধাতুতে পরিবর্তিত হতে পারে।

রসায়নের বিভিন্ন মিশ্রণ থেকে বিচিত্র গুণের উদ্ভাবন হতে পারে। এ থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে- দেহের মধ্যেও স্বতঃস্ফূর্ত গতি সৃষ্টি করার মতো যথেস্ট শক্তি রয়েছে। ...এসব ভাবনাই দ্বাদশ শতক থেকে ইউরোপীয় গীর্জেশাসিত সংকীর্ণ বদ্ধ সমাজে নবজাগরণের সঞ্চার করেছিল। রাজীর সময়কালে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে দুটি চরম পথ বিরাজ করছিল। একদল ছিল সংশয়বাদী অন্যদলটি ছিল ধর্মান্ধ।

মধ্যম পথটিই বেছে নিয়েছিলেন রাজী । ৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখে রে নগরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মধ্যযুগের এই মহান জ্ঞানসাধক। (উৎসর্গ: ডা. শাহাদাত)
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।