আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নীল কুকুরের চোখ -গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

স্বপ্ন দেখে যাই আর আশায় বুক বাঁধি

ছোট্ট ঘরটায় আমরা বসে আছি বেশ কিছুক্ষণ ধরে। ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে। আলো বলতে আগুনের ওই আলোই। আলো আঁধারিতে ছেয়ে আছে ঘরটা । তারপর হঠাৎ করেই মেয়েটা আমার দিকে তাকাল।

আমার মনে হল যেন এই প্রথমবার সে আমার দিকে তাকাল। কিন্তু যখন সে আমার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে ফায়ার প্লেসের ওপর হাত দুটো মেলে ধরল তখনও আমি তার মসৃণ আর তেলতেলে দৃষ্টি অনুভব করছিলাম। ভালো করেই বুঝলাম, সে নয় আমিই প্রথম বারের মত তার দিকে তাকিয়েছি। কিন্তু এটাই বা কি করে সম্ভব! এই শীতের রাতে এতটুকু ঘরে আমি আর একটা মেয়ে, অথচ আমি তার দিকে এই প্রথমবার তাকালাম! রিভলবিং চেয়ারটাতে আরেকটু আয়েশ করে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে কষে টান দিলাম। মেয়েটার দিকে আবার তাকালাম।

খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফায়ার প্লেসের পাশে দাঁড়িয়ে হাত সেঁকছে আর তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এমন স্বাভাবিক ভাবে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন এখানে দাঁড়িয়ে প্রতি রাতেই সে আমাকে দেখে। ছোট্ট কয়েকটা মুহূর্ত আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি যেন মনে পড়তে চাইছে কিন্তু ঠিক মনে আসছেনা। মেয়েটার চোখ জোড়া হঠাৎ ঝিক্ করে জ্বলে উঠল।

হঁ্যা, প্রতি রাতের মতই। আর এটা তখনই ঘটে যখন আমি তাকে বলি "নীল কুকুরের চোখ"। এখন আমার মনে পড়েছে তাকে। আগুনের ওপর থেকে হাত নামিয়ে সে আমাকে বলল,"আমরা এটা কখনই ভুলবনা। " একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ দু'টো বড় বড় করে ফেলল সে।

বলল, "নীল কুকুরের চোখ। এই কথাটা আমি সবখানে লিখেছি। " ফায়ার প্লেসের কাছ থেকে সে ড্রেসিং টেবিলের দিকে উঠে গেল। গোল আয়নায় আলো আঁধারীতে তার প্রতিবিম্ব কাঁপা কাঁপা হয়ে আমার চোখে ধরা পড়ল। আমি লক্ষ্য করলাম সবটুকু সময় সে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

অবশ্য আমিও তাই করেছি। পুরোটা সময় আমিও তার দিকে তাকিয়েছিলাম। কিন্তু যখন সে ছোট ছোট মুক্তো বসানো পাউডারের বাক্সটি খুলে নাকে পাউডার বুলাচ্ছিল তখনও তার দৃষ্টি ছিল আমার দিকে। তার হয়ে গেলে সে আবার উঠে গিয়ে ফায়ার প্লেসের ওপর হাত দু'টো মেলে ধরল। "তোমার ঠান্ডা লাগছে না?",মৃদু স্বরে সে জানতে চাইল ।

"কখনও কখনও। " "তোমার অনুভব করা উচিৎ। " সে আমাকে কথাটা বলার সাথে সাথেই-কি আশ্চর্য-আমার শীত লাগতে শুরু করল। "এখন অনুভব করছি", বললাম আমি। "কি অদ্ভূদ রকমের নিঃস্তদ্ধ রাত।

মনে হয় বাইরে কুয়াশা পড়েছে। " সে কোন উত্তর করল না। সে আবার আয়নার দিকে এগুলো। এবার আমি আমার চেয়ার ঘুরিয়ে নিলাম। এখন আমার পিঠ তার দিকে।

কিন্তু তার দিকে না তাকিয়েও আমি ঠিক বুঝতে পারলাম যে সে কি করছে। আমি জানি, সে আবার আয়নার সামনে বসেছে, আমায় দেখছে, আয়নার গভীর থেকে সে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার চোখের সামনে একটা দেয়াল। ছোট্ট চৌকোণা ঘরের একটি দেয়াল। সামনের দেয়ালের দিকে তাকালাম আমি।

মসৃণ আয়নার মত দেয়াল। ঠিক যেন একটা আয়না। কিন্তু এই আয়নায় কোন প্রতিবিম্ব পড়েনা, যদিও মেয়েটি আমার পেছনেই বসে আছে। তারপরও আমি তাকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি-আমার মনের চোখে। "আমি তোমাকে দেখছি",তাকে বললাম আমি।

এবং সেই মসৃণ দেয়ালের ভেতর আমি দেখলাম, সে আয়নার ভেতর দিয়ে আমার দিকে তাকাল। তারপর আবার সে তার চোখ নামিয়ে নিল। এখন সে চেয়ে আছে তার ব্লাউজের দিকে। কিছু বলল না। "আমি তোমাকে দেখছি",আবার বললাম আমি।

এবার সে তার ব্লাউজের ওপর থেকে চোখ সরাল। "অসম্ভব",বলে উঠল সে। "কেন?" সে তার চোখ আবার বুকের দিকে নামিয়ে বলল,"কারন তোমার চোখ দেয়ালের দিকে ফেরানো। " এবার আমি রিভলবিং চেয়ার আয়নার দিকে ঘোরালাম। যতক্ষণে আমি আয়নার দিকে ফিরলাম ততক্ষণে সে আবার ফায়ার প্লেসের কাছে ফিরে গেছে।

আগুনের তাপে উষ্ণ হতে হতে সে বলল,"আমার মনে হয় ঠান্ডা লাগবে। " কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে সে জানতে চাইল," তোমার শহরটা কি বরফে মোড়ানো?" তার মুখটা হালকা ভাবে আমার দিকে ফেরানো। আগুনের লালচে আভায় না আগুনের তাপে তার তামাটে মুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে ঠিক বুঝতে পারলাম না। "কিছু একটা কর, প্লীজ",বলে ইঠল সে। তারপর একে একে সে তার পোষাক খুলতে শুরু করল।

"দাঁড়াও, আমি দেয়ালের দিকে মুখ ফেরাচ্ছি। " "তার আর দরকার নেই। তুমি ত পেছনে ফিরেও আমাকে দেখতে পাও। "বলতে বলতেই সে সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে গেল। আগুনের লালচে আভায় তার নগ্ন শরীরটা অসম্ভব সুন্দর হয়ে আমার চোখে ধরা দিল।

"আমি সবসময় তোমাকে এভাবেই দেখতে চেয়েছি। তোমার পেটের ওই খাঁজগুলো........", আমার কথাগুলো শ্লীলতার সীমা ছাড়াচ্ছে এটা বুঝতে পেরেই সে আবার আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি চুপ করে গেলাম। "কখনও কখনও আমার মনে হয়, আমি যেন ধাতব পদার্থের তৈরি। ", বলল সে।

"তাহলে নিশ্চই কোন স্বপ্নে আমি তোমাকে জাদুঘরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রোঞ্জের মূর্তি মনে করেছি। আর এজন্যই হয়ত তোমার কোন অনুভূতি নেই। "ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করলাম আমি। এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা। আগুনের ওপর তার হাত জোড়া একটু নড়ে উঠল।

আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে সে বলল,"যখন আমি গভীর ঘুমে থাকি তখন আমার মনে হয়, আমার শরীরটা যেন ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে আর চামড়াটা যেন ধাতব পাত। বুকের মাঝে হৃৎপিন্ডের ধুকধুকানি শুনে মনে হয় কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে লোহা পেটাচ্ছে। " কথাগুলো বলে সে ফায়ার প্লেসের আরেকটু কাছ ঘেঁসে বসল। " "তোমার কথা বল। ", বললাম তাকে।

"আমরা যদি কখনও একে অপরকে খুঁজে পাই তখন আমার বুকে কান পেতে শুনো, সব জানতে পারবে। আমার সবসময় ইচ্ছে করে তুমি এমনটা কর। " শেষের কথাগুলো বলে সে গভীর করে একটা শ্বাস ফেলল। তারপর বলল তার কথা। সে গত কয়েক বছরে ব্যাতিক্রম কিছুই করেনি।

আমাকে খুঁজে পাবার জন্য সে তার জীবনকে উৎসর্গ করেছে। "নীল কুকুরের চোখ"-এই কথাটি দিয়ে সে আমাকে খুঁজে বেড়ায়। সে যেখানেই যায়, এই বাক্যটি জোরে জোরে উচ্চারন করে। কারন আমিই নাকি একমাত্র ব্যাক্তি যে কিনা এর অর্থ বুঝতে পারবে। সে যখনই কোন রেস্তোঁরায় যেত, খাবারের অর্ডার করার আগে ওয়েটারকে বলত,"নীল কুকুরের চোখ"।

কিন্তু ওয়েটার এমন ভাবে বিনয়ী হয়ে মাথা ঝোঁকাত যেন কখনই স্বপ্নে তাদের এমন কিছু কেউ বলেনি। "অথচ আমি প্রতি রাতেই তোমার স্বপ্নে এই কথাটা বলেছি", বলে চলল সে। রেস্তোঁরায় খাওয়া শেষ হলে সে ন্যাপকিন আর টেবিলের গায়ে ছুরির মাথা দিয়ে লিখত, "নীল কুকুরের চোখ"। ধূলিধূসরিত বিল্ডিং, হোটেল, স্টেশনের জানালায় সে তার তর্জনী দিয়ে কথাটা লিখেছে আর আশায় থেকেছে যদি কখনও আমার চোখে পড়ে লেখাটা। "একবার আমি এক ওষুধের দোকানে গেলাম।

অদ্ভুদ ব্যাপার, একরাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখার পর আমার ঘরে যে রকম ঘ্রাণ পেয়েছিলাম, ওই দোকানে ঠিক একই রকম ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। ভাবলাম, তুমি নিশ্চই খুব কাছেই আছ। আমি সোজা সেলসম্যানের দিকে এগিয়ে গেলাম। তাকে বললাম, ""আমি সবসময় একটা লোককে স্বপ্নে দেখি যে আমাকে একবার বলেছিল নীল কুকুরের চোখ। "" লোকটি আমার চোখের দিকে তাকাল।

বলল,""ব্যাপারটা কি জানেন ম্যাম, আপনার চোখ দু'টি সত্যিই ওরকম। "" আমি তাকে বললাম,""আমার ঐ লোকটিকে খুঁজে বের করতেই হবে। "" আমার কথা শুনে লোকটা হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতেই সে কাউন্টারের অন্যপাশে সরে গেল। আমি দোকানটা ভাল করে দেখলাম।

মেঝেতে নতুন লাগানো টাইলস গুলো ঝক ঝক করছে। নাক উঁচু করে আবার ঘ্রাণ নিলাম। তারপর আমার পার্স খুলে লিপস্টিক বের করে চকচকে টাইলসের ওপর লাল অক্ষরে লিখলাম "নীল কুকুরের চোখ"। সেলসম্যান ছুটে এল। ""ম্যাম, এ কী করছেন।

আপনি ত মেঝে নোংরা করে ফেললেন। "" একটা ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে সে আমাকে বলল,""পরিস্কার করুন। "" আমি আমার পুরো বিকেলটা সেই মেঝে পরিস্কার করেছি আর জোরে জোরে বলেছি, ""নীল কুকুরের চোখ"" যতক্ষণ না মানুষের ভীড় জমে গিয়েছিল। " এই বলে সে থামল। আমি আগের মতই ঘরের এক কোনায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা।

তাকে বললাম, "আমি প্রতিদিনই মনে করার চেষ্টা করি তুমি কোন কথাটি ব্যবহার করে আমাকে খুঁজতে চেষ্টা করছ। এখন আমার মনে হচ্ছে আগামীকাল আমি ঠিকই এটা মনে করতে পারব। " কথাটা বলেই আমার মনে পড়ল প্রতিবারই আমি একই কথা বলি আর সকালে ঘুম থেকে উঠে ভুলে যাই। সে বলল, "এই কথা গুলো তুমি আমাকে বলছ একেবারে প্রথমদিন থেকে। " একটা গভীর শ্বাস ফেলে আমি বললাম, "তুমি যদি একটিবারের মত সেই শহরের নামও মনে করতে পারতে, যেখানে তুমি কথাগুলো লিখেছিলে।

" আমার কথা শুনে সে মৃদু হেসে উঠল। আগুনের মৃদু আলোয় তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে উজ্জল দাঁতগুলো ঝিক্ করে উঠল। "তোমাকে আমার ছুঁতে ইচ্ছে করছে",বললাম তাকে। এতক্ষণ আগুনের দিকে তার মুখ ফেরানো ছিল। কথাটা শুনে সে আমার দিকে ফিরল।

তার নীল চোখ জোড়া ধিকি ধিকি জ্বলছে। "তুমি কখনই আর আমাকে এ ধরনের কথা বলবে না। " "আমি সত্যি বলছি। " "তোমার কাছে সিগারেট আছে?" আমার আঙ্গুলের ফাঁক গলে কখন যে সিগারেটের গোড়াটা পড়ে গেছে লক্ষ্যই করিনি। ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি সিগারেট খাচ্ছিলাম।

সে আবার বলে উঠল,"বুঝতে পারছিনা কেন আমি সেই শহরটার নাম মনে করতে পারছিনা। " "ঠিক একই কারনে আমি কালকে এই কথাটা মনে করতে পারবনা। " যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করলাম আমি । সে ক্লান্ত স্বরে বলল, "না, কখনও কখনও মনে হয় আমার লেখার ব্যাপারটিও স্বপ্নে ঘটছে। " তার কথা শুনে বুঝলাম আমার খোঁড়া যুক্তিটাকে সে পাত্তাই দেয়নি।

আমি সিগারেট আর ম্যাচ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। সে সিগারেট নিল আর আমি সেটা ধরিয়ে দিলাম। "পৃথিবীর কোন একটা শহরের প্রতিটি জানালায় লেখা নীল কুকুরের চোখ", বললাম আমি। "যদি কাল মনে করতে পারি, তবে আমি অবশ্যই তোমাকে খুঁজে বের করব। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে মাথা নীচু করল।

ফিসফিস করে বলে উঠল, "নীল কুকুরের চোখ। " চোখ আধবোঁজা করে সে সিগারেটে টান দিয়ে অবাক কন্ঠে বলে উঠল, "আশ্চর্য ! আমার এখন গরম লাগছে। " আমরা কয়েক বছর ধরে ঘুমের মধ্যে একে অপরকে দেখছি। প্রতিবারই খুব সামান্য ব্যাপারে আমার ঘুম ভেঙে যায়। সামান্য ব্যাপার মানে হয়ত কারো হাত থেকে একটা চামচ পড়ল আর সেই শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল।

আস্তে আস্তে আমরা বুঝতে পারি, আমাদের এই দেখা হওয়াটা কিছুর ওপর নির্ভরশীল- তুচ্ছ ঘটনার ওপর নির্ভরশীল। আর প্রতিবারই আমাদের এই সাক্ষাৎ পর্বটা একই ভাবে শেষ হত-একটা চামচ পড়ার শব্দে। এখন, আগুনের পাশে বসে সে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমার মনে পড়ল, আগেও সে আমার দিকে এভাবে তাকিয়েছে। আমার মনে পড়ল অনেক আগের একটা স্বপ্নে আমি তাকে দেখেছিলাম।

জিজ্ঞেস করেছিলাম, "কে তুমি?" সে আমাকে বলেছিল, "আমি মনে করতে পারছিনা। " "কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের আগে দেখা হয়েছিল। " সে একই ভাবে বলেছিল, "তাইত, আমার এখন মনে পড়ছে। কি অদ্ভূদ ব্যাপার, আমরা স্বপ্নের মধ্যে দেখা করি। " ফায়ার প্লেসের কাছে দাঁড়িয়ে আমি এগুলো ভাবছিলাম।

তার দিকে ফিরে আমি ভালো করে তাকালাম। তার গায়ের তামাটে বর্ণ আবার ফিরে এসেছে। দেখে মনে হয় শক্ত নয়, নরম, গলে যাওয়া একটু হলুদাভ তামা। "তোমাকে ছুঁতে ইচ্ছে করছে", আবার বললাম আমি। "তুমি সব কিছু পন্ড করে ফেলবে।

" আমি আগুনের দিকে হাত বাড়ালাম। সে নড়ল না একচুলও। "তুমি সব কিছু পন্ড করে ফেলবে। " তাকে ছোঁবার আগ মুহূর্তে সে আবার বলে উঠল। আমি তাকে না ছুঁয়ে হাত সরিয়ে নিলাম।

ঘুরে ঘরের কোণে চেয়ারটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। সে আমার পেছনে ফায়ার প্লেসের কাছে দাঁড়িয়ে আগের মতই হাত সেঁকছে। চেয়ারে বসবার আগেই তার গলা শুনলাম, "মাঝরাতে যখন আমার ঘুম ভেঙে যায়, তখন থেকে ভোর পর্যন্ত আমি একটা কথাই বলি-নীল কুকুরের চোখ। " বুঝলাম, কেন সে বারবার কথাটি বলছে। আমি আবার দেয়ালের দিকে মুখ করে বসলাম।

"ভোর হচ্ছে", তার দিকে না তাকিয়েই বললাম। বসে থাকতে ইচ্ছে করলনা। উঠে দরজার দিকে এগুলাম। একটি মাত্র দরজা এই ঘরে। হাতে দরজার নব ঠেকতেই তার গলা শুনতে পেলাম, একই রকম কন্ঠ, কোন ওঠানামা নেই, নির্লিপ্ত।

"দরজাটা খুলোনা। হলরূমটা কঠিন কঠিন স্বপ্নে বোঝাই। " "তুমি কিভাবে জানলে?" "কিছুক্ষণ আগে আমি ওখানে ছিলাম। যখনই আমার মনে পড়েছে যে আমি স্বপ্ন দেখছি তখনই আবার ফিরে এসেছি। কথার ফাঁকে আমি দরজাটা অর্ধেকের মত খুলে ফেলেছিলাম।

দরজার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগল আমার মুখে। বাতাসের মধ্যে ফসলের ভেজা মাঠের গন্ধ পেলাম। দরজা ওভাবে রেখেই তার দিকে ফিরে বললাম, "আমার মনে হয়না ওপাশে কোন হলরূম আছে। আমি ত গ্রামের গন্ধ পাচ্ছি। সে ফায়ার প্লেসের পাশ থেকেই বলল, "এই ব্যাপারটা আমি তোমার চাইতে ভালো জানি।

ওখানে একজন মহিলা আছেন যিনি সবসময় স্বপ্নে দেখেন যে তিনি গ্রামে গিয়ে থাকবেন। তার চারিদিকে থাকবে গ্রাম্য পরিবেশ। কিন্তু তিনি কখনই শহর ছেড়ে বাইরে যেতে পারেননি। " আমার মনে পড়ল আগের কয়েকটা স্বপ্নে আমি ওই মহিলাকে দেখেছিলাম। আহা বেচারী! তার স্বপ্ন কি কখনই পূরণ হবে না।

এই পৃথিবীতে অপূর্ণ স্বপ্নের সংখ্যাই বেশী। দরজাটার দিকে তাকালাম আমি। আমি জানি, যে দরজাটা আমি ভেজিয়ে রেখেছি আর আধ ঘন্টা পর এই দরজা দিয়েই আমি নিচে নামব সকালের নাস্তা করতে। বাইরে মুহূর্তের জন্য বাতাসের শব্দ পাওয়া গেল। তারপর আবার সব চুপচাপ।

ক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে চলা বাতাস থেমে গেছে। আর কোন গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। কে জানে, মহিলার ঘুম হয়ত ভেঙে গেছে। "কালকে আমি তোমাকে ঠিক চিনে নেব", বললাম আমি। "যখনই কোন মেয়েকে দেখব, যে লিখছে নীল কুকুরের চোখ তখনই আমি তোমায় চিনতে পারব।

" আমার কথা শুনে সে ম্লান হাসি হাসল। ইতিমধ্যে আমি বুঝে গেছি তার এই হাসির অর্থ। এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে অসম্ভবের কাছে আত্মসমর্পনের বেদনা। আগুনের উপর থেকে সে তার হাত সরিয়ে নিয়ে আমাকে বলল, "আগামীকাল সারাদিন তুমি কিছুই মনে করতে পারবেনা। কারন পৃথিবীতে তুমিই বোধ হয় একমাত্র মানুষ, যে কোন স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার পর কিছুই মনে করতে পারে না।

"

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।