আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ড. ইউনুসের সামাজিক ব্যাবসার ব্যাবসা



ড. ইউনুসকে সেদিন দেখলাম বাচ্চাদের সাথে একটা দইয়ের বিজ্ঞাপনে। এর নাম শক্তি দই যা নাকি শিশুদের দৈনন্দিন পুষ্টির শতকরা ৩০ ভাগ পূরণ করে। গ্রামীন-ডানোন যৌথ উদ্দ্যোগের মাধ্যমে গ্রামীন ও ফরাসী বহুজাতিক ডানোনের ৫০-৫০ মালিকানায় স্থাপিত একটি কারখানায় তৈরী হয় এই দই। ২০০৬ সালের অক্টোবরে যখন ড.ইউনুস নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন, তখন চলছে সেই কারখানা স্থাপনের কাজ। নোবেল পাওয়ার একমাস পর নভেম্বর মাসে বগুরায় এই কারখানাটির উদ্বোধন হয়।

ইউনুস সাহেব এই ধরনের যৌথ উদ্যোগকে বলছেন সামাজিক ব্যবসা যার মাধ্যমে একই সাথে দারিদ্রও দূর হবে এবং পুজিবাদের ভবিষ্যত ও রক্ষা হবে- পরবর্তীতে ২০০৭ সালে প্রকাশিত ক্রিয়েটিং এ ওয়ার্ল্ড উইদাউট পোভার্টি: স্যোসাল বিজনেস এন্ড দ্যা ফিউচার অব ক্যাপিটালিজম নামক বইটিতে এমনটিই তিনি দাবী করেছেন। আমরা এখানে ড. ইউনুস কথিত এই সামাজিক ব্যাবসা ও দারিদ্র দূরীকরণে সামাজিক ব্যাবসার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবো। সামাজিক ব্যাবসা কি: সামাজিক ব্যাবসাকে সম্পর্কে ড. মুহাম্মদ ইউনুস তার ব্যাক্তিগত ওয়েব সাইটে বলেছেন: Social business is a cause-driven business.In a social business, the investors/owners can gradually recoup the money invested, but cannot take any dividend beyond that point. Purpose of the investment is purely to achieve one or more social objectives through the operation of the company, no personal gain is desired by the investors. The company must cover all costs and make profit, at the same time achieve the social objective, such as, healthcare for the poor, housing for the poor, financial services for the poor, nutrition for malnourished children, providing safe drinking water, introducing renewable energy, etc. in a business way. (http://www.muhammadyunus.org/Social-Business) অর্থাত সামাজিক ব্যাবসা একটি উদ্দেশ্য-চালিত ব্যাবসা। বিনিয়োগকারী ক্রমান্বয়ে তার বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে নিতে পারবেন কিন্তু তার বাইরের কোন অর্থ ডিভিডেন্ট হিসেবে নিতে পারবেনা। এই বিনিয়োগের উদ্দেশ্য পুরোপুরিভাবেই কোম্পানির কার্যক্রমের মাধ্যমে কেবল এক বা একাধিক সামাজিক উদ্দেশ্য পূর্ণ করা, বিনিয়োগকারীর কোন ব্যাক্তিগত লাভের আকাংখা থাকলে চলবে না।

কম্পানিকে অবশ্যই তার খরচ তুলে নিতে হবে এবং মুনাফা করতে হবে,সেই সাথে সামাজিক উদ্দেশ্যগুলোকেও পূর্ণ করতে হবে যেমন: গরীবের জন্য স্বাস্থ্য সেবা, আবাসন, অর্থ-ঋণ সেবাদান, অপুষ্ট শিশুদের পুষ্টির যোগান, নিরাপদ পানি সর্বরাহ, নবায়ন যোগ্য শক্তির সূচনা ঘটানো ইত্যাদি কাজগুলো করতে হবে ব্যাবসায়িক উপায়ে। ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব-অর্থনৈতিক ফোরামের সন্মেলনে তিনি সামাজিক ব্যাবসার ৭টি নীতিমালা ঘোষণা করেছেন। এগুলো হলো: ১) ব্যাবসার উদ্দ্যেশ্য হবে দারিদ্র দূরীকরণ কিংবা এক বা একাধিক সামাজিক সমস্যা দূর করা যেগুলো জনগণ এবং সমাজকে হুমকীর মুখে ফেলে দেয়, এর উদ্দ্যেশ্য কখনই প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশান বা মুনাফা সর্বোচ্চ করণ নয়। ২) এ ব্যাবসা অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হবে। ৩) বিনিয়োগকারীগণ তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফিরে পেলেও এর বাইরে কোন ডিভিডেন্ট পাবেন না।

৪) বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত দিয়ে দেয়ার পর লাভের টাকার পুরোটাই কোম্পানির বিকাশ এবং উন্নয়নের কাজ ব্যায় করা হবে। ৫) এ ব্যাবসা পরিবেশ সচেতন হবে। ৬) শ্রমিকদের ভালো কাজের পরিবেশ ও মার্কেট ওয়েজ বা বাজারে প্রচলিত মজুরী প্রদান করা হবে। ৭) এ ব্যাবসা আনন্দের সাথে করতে হবে। এখন এই যে সামাজিক ব্যাবসায় বিনিয়োগকারী মুনাফা তুলে নিতে পারবে না, সেটা কোম্পানিতেই থেকে যাবে ভবিষ্যত উন্নয়ণ ও বিকাশের জন্য, সেক্ষেত্রে ব্যাক্তি পুজিমালিক কেন এ ব্যাসায় বিনিয়োগ করতে আসবেন, এ প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক।

ড. ইউনুস এর উত্তরে বলেছেন: Capitalism is a half-developed structure. Capitalism takes a narrow view of human nature, assuming that people are one-dimensional beings concerned only with the pursuit of maximum profit. (p.18) অর্থাত “পুজিবাদ একটি অর্ধ-বিকশিত কাঠামো। মানুষ সম্পর্কে পুজিবাদের ধারণা সংকীর্ণ, পুজিবাদ মনে করে মানুষ স্রেফ একমাত্রিক একটা অস্তিত্ব যার সমস্ত ভাবনা কেবল মুনাফা সর্বোচ্চ করণের দিকে। “ তারপর তিনি বলছেন: To make the structure of capitalism complete, we need to introduce another kind of business – one that recognises the multi-dimensional nature of human beings. If we describe our existing companies as profit-maximizing businesses (PMBs), the new kind of business might be called social business. Entrepreneurs will set up social businesses not to achieve limited personal gain, but to pursue specific social goals. (p.21) অর্থাত “পুজিবাদের কাঠামোকে সর্ম্পূর্ণতা দেয়ার জন্য আমাদেরকে আরেক ধরণের ব্যাবসা চালু করতে হবে- যা মানুষের বহুমাত্রিকতাকে স্বীকৃতি দেবে। আমাদের প্রচলিত ব্যাবসাগুলোকে যদি মুনাফা সর্বোচ্চ করণের ব্যাবসা বলি তাহলে নতুন ধরণের ব্যাবসাটিকে বলতে পারি সামাজিক ব্যাবসা। উদ্যোক্তারা সংকীর্ণ ব্যাক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে নয়, সুনির্দিষ্ট সামাজিক লক্ষ পূরণের জন্য সামাজিক ব্যাবসা স্থাপন করবেন।

“ আবার, ড. ইউনুসের মতে সামাজিক ব্যাবসা দু’ধরণের হতে পারে- টাইপ ১: এ ধরণের ব্যাবসা কেবল সামাজিক উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ব্যাবসা করবে। যেমন: এমন পণ্য উতপাদন করবে যা দরিদ্রের উপকারে লাগবে। টাইপ ২: এ ধরণের ব্যাবসা যে কোন ধরণের পণ্য উতপাদন করবে কিন্তু এর মালিকানা থাকবে দরিদ্রের হাতে যারা প্রত্যক্ষ ডিভিডেন্ট থেকে কিংবা পরোক্ষ সুবিধা নিয়ে উপকৃত হতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি তার বহুল আকাংখিত বাংলাদেশের জন্য একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কথা বলেছেন যার মালিকানা থাকতে পারে দেশের দরিদ্র নারীদের। সামাজিক ব্যাবসার দারিদ্র দূরীকরণ প্রপঞ্চ: আমাদের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে প্রচলিত ব্যাবসার সাথে সামাজিক ব্যাবসার পার্থক্য হলো সামাজিক ব্যাবসাও প্রচলিত ব্যাবসার মত মুনাফা করার কাজটি করবে কিন্তু এটি তার মুখ্য উদ্দ্যেশ্য হবে না কারণ এ ব্যাবসার উদ্যোক্তার ডিভিডেন্ট আকারে মুনাফা তুলে নেয়ার কোন সুযোগ নেই, কাজেই মুনাফা সর্বোচ্চ করণের কোন বাড়তি চাপ কোম্পানির উপর থাকবে না।

এখন কোন কোম্পানির মুনাফা সর্বোচ্চ করণের ব্যাপারটি কি মালিক পক্ষের চাওয়া না চাওয়ার উপর নির্ভর করে নাকি পুজিবাদী অর্থনীতিতে প্রতিযোগীতামূলক ভাগে টিকে থাকতে গেলে কোম্পানিকে মুনাফা সর্বোচ্চ করণের ধান্দা করতেই হয় এ বিষয়টি আমরা একটু খতিয়ে দেখতে চাই। একই সাথে যাচাই করতে চাই মুনাফা কামানো ও দারিদ্র দূরীকরণের সম্ভাব্যতাটিকেও। দারিদ্রের কারণ যে বিদ্যমান বৈষম্য মূলক সমাজ ব্যাবস্থায় শ্রমিকের শ্রমের ফসল শ্রমিককে না দিয়ে তার বেশির ভাগ মুনাফা হিসেবে মালিক-শ্রেণির আত্মসাত সে কথা তো ড. ইউনুস ভালই জানেন, তিনি তার বইয়ের ১১৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন: "But if you spend enough time living among the poor, you discover that their poverty arises from the fact that they cannot retain the genuine results of their labor. And the reason for this is clear: They have no control over capital. The poor work for the benefit of someone else who controls the capital." অর্থাত “আপনি যদি দরিদ্রদের সাথে যথেষ্ট সময় পার করেন, আপনি বুঝতে পারবেন তাদের দারিদ্রের কারণ হলো তাদের শ্রমের আসল মূল্য তারা পায়না। আর এর কারণও তো পরিস্কার। পুজির উপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

পুজির মালিকানা যাদের হাতে, গরীবেরা কাজ করে তাদের সুবিধার জন্য। “ শ্রমিক যা পায়না তাই মালিকের মুনাফা- মালিকের মুনাফার এটাই একমাত্র উতস। পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যাবস্থায় গুটিকয়েক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বেশির ভাগ সম্পদের মালিক- কলকারখানার মালিক তারা, জমি-বাড়ির মালিকও তারা। কলকারখানা কিংবা কৃষিজমিতে কাজ করে যে শ্রমিক বিভিন্ন পণ্য উতপাদন করে কিংবা ফসল ফলায়,মজুরীর বিনিময়ে তার প্রায় পুরোটাই সেই মালিক গোষ্ঠী আত্মসাত করে। আত্মসাত কেননা,কোন কাচামাল পণ্যে রুপান্তরিত করতে বাকি সব কিছু থাকলেও শ্রম না দিলে সেটা থেকে কোন নতুন মূল্য তৈরী হবে না, ফলে সেটা বাজারে লাভে বিক্রি করা যাবে না।

কাজেই বিক্রয় মূল্য থেকে কাচামাল ও অন্যান্য খরচ বাদ দিলে যে মূল্যটুকু থাকে তার পুরোটার মালিকানাই হওয়া উচিত শ্রমিকের কিন্তু পুজি মালিক তার সামান্য একটা অংশ শ্রমিককে দিয়ে বাকিটাকে মুনাফা হিসেবে আত্মসাত করে। কিন্তু উতপাদনের উপকরণের মালিকানা যদি শ্রমিকের হাতে থাকতো তাহলে কিন্তু তার শ্রম থেকে যে নতুন মূল্য তৈরী হয় সেটা কেউ আত্মসাত করতে পারতো না। কিন্তু পুজিবাদি সমাজে তা হবার নয়। কাজেই আমরা দেখছি মুনাফা = পণ্যের বিক্রয় মূল্য- (বিভিন্ন স্থির খরচ+শ্রমিকের মজুরী)। এ সমীকরণের বিক্রয় মূল্য কিংবা বিভ্নি স্থির খরচ যেমন কাচামাল বা যন্ত্রপাতির খরচ ইত্যাদ বাজার মূল্যেই তাকে কেনা-বেচা করতে হয় কিন্তু শ্রম একটা পণ্য হলেও বাজারের আর দশটা পণ্যের সাথে এর একটা মৌলিক পার্থক্য আছে- এ পণ্যটি নতুন মূল্য তৈরী করতে পারে।

বাজারের নিয়মে যে দাম দিয়ে মালিক শ্রম কেনে, প্রকৃত পক্ষে সেটা তার আসল মূল্য নয়- কেননা প্রকৃত মূল্য দিলে তো মালিকের মুনাফা থাকে না। কাজেই মালিকের মুনাফার উৎস হলো শ্রমিকের শ্রম এবং এই শ্রমের দাম হিসেবে তার প্রকৃত মূল্যের চেয়ে যত কম দিতে পারবে ততই তার মুনাফা। কাজেই শ্রেণী হিসেবে মালিক শ্রেণীর সমস্ত আগ্রহ থাকে বাজারে শ্রমের মজুরী যত কম রাখা যায় তার দিকে। এখন মালিক এই মজুরী কত কম দিতে পারে? মালিক মজুরী কমাতে কমাতে কখনই সাবসিস্টেন্স লেভেল বা একেবারে নূন্যতম খেয়ে পড়ে টিকে থাকা এবং পরদিন আবার কারখানা বা ক্ষেতে খামারে এসে শ্রম বিক্রিকরার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী কেনার জন্য যত টাকা প্রয়োজন হয় তার চেয়ে বেশি কমাতে পারে না কারণ তাহলে তার মুনাফা তৈরীর মেশিন তো নষ্ট হয়ে যাবে! ফলে মালিক শ্রেণী সবসময়ই মজুরী সাবসিস্টেম লেভেলের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করে যাতে করে তার মুনাফা সর্বোচ্চ হয়। এই যে শ্রমিকের শ্রমের ফসল থেকে শ্রমিককে বঞ্চিত করা এটাই হলো শোষণ বা এক্সপ্লয়টেশান আর সমাজের বেশির ভাগ মানুষ এই শোষণের শিকার বলেই তারা সাবসিস্টেম লেভেলের কাছাকাছি বসবাস করা দরিদ্র মানুষ ।

কাজেই দারিদ্রের মূল কারণ হলো এই শোষণ বা এক্সপ্লয়টেশান এবং এটি যতদিন জারি থাকবে অর্থাত শ্রমিকের শ্রমের একটা অংশ মালিকেরা আত্মসাত করতে থাকবে ততদিনই দারিদ্র থাকবে। তাহলে ইউনুস সাহেব দারিদ্রের কারণ হিসেবে শোষণ ও মুনাফার এই ভূমিকার কথা জেনেও কি ভাবে বলছেন যে দারিদ্র দূরীকরণ ও মুনাফা শোষণ একই সাথে চালাবেন? মুনাফা যদি হয়, তাহলে দারিদ্র দূরীকরণ কেমনে হবে? ব্যাক্তি ডিভিডেন্ট নেবে না ভালো কথা, কিন্তু কোম্পানি তো মুনাফা করবে, সেই মুনাফা আবারও বিনিয়োগকৃত হবে, আবারও মুনাফা হবে- ব্যাক্তি মুনাফা নিলেও এই কাজই হতো। তাহলে তো শ্রমিক তার উতপাদিত পণ্যের মূল্যটুকু থেকে আগের মতোই বঞ্চিত হচ্ছে! শোষিত শ্রমিকের কাছে শোষণ কোন ব্যাক্তি করছে নাকি কোন কোম্পানি করছে তার কোন ভেদ-বিভেদ আছে কি? ব্যাক্তি তার শ্রমের ফসলে ভাগ বসালে শ্রমিক তার শ্রমের ফল থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করে আর ব্যাক্তি শোষণ না করে যদি কোম্পানি ( বা কোন রোবট বা কোন ভীনগ্রহবাসী যেই হোক না কেন) সেই কাজটিই করে তাহলে কি সে আহলাদে আটখানা হবে নাকি! হতো,যদি তার শ্রমের ফসল তার কাছেই ফিরে আসতো- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিতসা ইত্যাদি সহ তার যাবতীয় প্রয়োজন যদি কোম্পানি তার মুনাফার টাকায় মেটাতো। কিন্তু হায়! কোম্পানি তো সেসব নিয়েও (নিয়েই) ব্যবসা করবে(এবং করছেও, নিচের আলোচনা দ্রষ্ট্রব্য), কারণ ইউনুস সাহেবের ঘোষণাই হলো ঐসব সামাজিক উদ্দেশ্যগুলোকেও পূর্ণ করতে হবে ব্যবাসায়িক উপায়ে!(সামাজিক ব্যাবসার সংজ্ঞার শেষ দুটি বাক্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ) অনেকে বলতে পারেন কেন, সমাজিক ব্যাবসার টাইপ ২ তো ঠিক এই ধরণেরই একটা কথা বলা আছে বলে মনে হলো যে মালিক হবে দরিদ্ররা এবং তারা সরাসরি ডিভিডেন্ট আকারে মুনাফার ভাগও পাবে।

হ্যা কাগজে কলমে এরকম একটা অপসনের কথা বলছেন ঠিকই কিন্তু বাস্তবে ইউনুস সাহেব যতগুলো সামাজিক ব্যাবসার উদ্যোগ নিয়েছেন তার একটিও এধরণের মালিকানার ধারা কাছেও নেই, উল্টো গ্রামীন এক্ষেত্রে কখনও মালিকানার অংশীদারিত্বে মেতেছে ফরসী বহুজাতিকের সাথে, কখনও বা জার্মান বহুজাতিকের সাথে। তিনি তো অনেকদিন ধরেই বলছেন যে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকৃত মালিক নাকি তার ঋণ গ্রহীতারাই। এটা অনেক পুরাতন একটা কৌশল- কাগজে কলমে এসব লেখা থাকলেও বাস্তবে এর পুজি ও মুনাফার সমস্ত নিয়ন্ত্রনই থাকে পরিচালনা বোর্ড বিশেষ করে বোর্ড অব ডিরেক্টরের কাছে আর তাই তো দেখি গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টর হিসেবে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বেআইনি ভাবে ইউনুস সাহেব তার চেয়ার ধরে রাখেন। যাই হোক, বাস্তবে কখনও যদি সত্যি সত্যি তিনি এমন একটি কোম্পানি খুলে ফেলেন যার মালিক এমনকি তার বোর্ড অব ডিরেক্টর পর্যন্ত দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ এমনকি সেক্ষেত্রেও দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব নয়। কারণ গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যাবস্থা ও তার সমস্ত উতপাদন ও মালিকানা সম্পর্কের পরিবর্তন না ঘটিয়ে স্রেফ একটি দুটি কোম্পানির মালিকানা কিছু দরিদ্র মানুষের হাতে তুলে দিলে হয়তো নতুন কিছু ক্ষুদ্র পুজিপতি সৃষ্টিই করা যাবে যারা আবার সেই কোম্পানির মুনাফা ও পুজির বিকাশের জন্য সমাজের অন্যান্যদের শোষণ করে নতুন সর্বহারা শ্রমজীবীর সৃষ্টি করবে এবং এর মাধ্যমে দারিদ্রকে জারি রাখবে! মুনাফা সর্বোচ্চ-করা না করা প্রসংগে: সামাজিক ব্যাবসা যেহেতু মুনাফা করেই টিকে থাকবে কাজেই এর মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব নয়- আমাদের একথাটি মেনে নিয়েও অনেকে তর্ক তুলতে পারেন সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র দূর না করা গেলেও সামাজিক ব্যাবসার মাধ্যমে এর প্রকোপ তো কিছুটা কমানো তো সম্ভব হতে পারে- কেননা সামাজিক ব্যাবসা তো মুনাফা সর্বোচ্চ করণের বিরুদ্ধে-মুনাফা কম করলে শোষণ কম হবে আর শোষণ কম হলো তো দারিদ্রের মাত্রাও কম হবে- আর এটা বাস্তবায়নের জন্য তো তার এরকম একটা মেকানিজমও আছে যে-সামাজিক ব্যবাসায় বিনিয়োগকারী ব্যাক্তি মুনাফা তুলে নিতে পারবে না ফলে কোম্পানিকে সে মুনাফা সর্বোচ্চ করণের জন্য চাপও প্রয়োগ করবে না।

এ প্রসংগে আমরা একটা প্রশ্ন তুলতে চাই, মুনাফা সর্বোচ্চ করা না করার ব্যাপারটি কি ব্যাক্তির চারিত্রের উপরে নির্ভর করে- অর্থাত মালিক ভালো হলে মুনাফা কম করবে আর খারাপ হলে মুনাফা বেশি করবে কিংবা বিষয়টি কি এরকম যে কোম্পানি মুনাফা সর্বো্চ্চ করণ করতে চায় স্রেফ মুনাফালোভী মালিকের চাপের কারণে- নাকি বিষয়টি কারো ব্যাক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন ব্যাপার নয়, কোম্পানিকে বাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগীতা মূলক ভাবে টিকে থাকতে গেলে এবং বিকাশ লাভ করতে গেলে তাকে মুনাফা সর্বোচ্চ করণের চেষ্টা করতেই হবে? বিষয়টি বোঝার জন্য প্রথমে দেখা দরকার মালিকশ্রেণী কোন কোন খাতে মুনাফাটুকু ব্যায় করে। ব্যায় অনুসারে মুনাফাকে দু-ভাগে ভাগ করা যেতে পারে- এক ভাগ যায় মালিকের ব্যাক্তিগত ভোগ-বিলাসের কাজে আর আরেকভাগ যায় নতুন নতুন যন্ত্রপাতি, বাড়তি কাচামাল কিংবা বাড়তি শ্রমিক নিয়োগের কাজে(এটাই বৃহত্তর অংশ)। মুনাফার এই দ্বিতীয় ব্যবহারটুকু খুব গুরুত্বপূর্ণ। মালিক যদি মুনাফা কম করে তাহলে হয় তাকে ব্যাক্তিগত ভোগ-বিলাস কমিয়ে ফেলতে হবে (যা সে একান্ত বাধ্য না হলে করতে চাইবে না) অথবা নতুন নতুন বিনিয়োগ বা বিনিয়োগের সম্প্রসারণের কাজে অর্থ ব্যায় কমিয়ে ফেলতে হবে। দ্বিতীয় কাজটি হবে তার জন্য মারাত্মক কেননা সেক্ষেত্রে বাজারের প্রতিযোগীতায় সে সহজেই তার সেই প্রতিযোগীর কাছে হেরে যাবে যে ক্রমাগত মুনাফার একটা বর্ধিত অংশ খরচ করে ক্রয় করা আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে এবং পণ্য উতপাদনের সময় কমিয়ে অর্থাত প্রডাক্টিভিটি বা উতপাদনশীলতা বাড়িয়ে তার চেয়ে সস্তায় তার চেয়ে ভালো মানের পণ্য বাজারে বিক্রি করতে পারবে।

কাজেই দেখা যাচ্ছে কোন একজন মালিক ব্যাক্তিগতভাবে চাইলেই( পুজিপতি হিসেবে এরকমটা তার চাওয়ার কথাও না, আমাদের আলোচ্য ইউনুস সাহেবও তা চাচ্ছেন না- এ বিষয়ে আমারা একটু পরেই আলোচনা করবো) মুনাফা কম করে শ্রমিকের দারিদ্র দূর করে ফেলতে পারে না। কিন্তু যখন কোন একটি সেক্টরের সার্বিকভাবে শ্রমিক আন্দোলনের কারণে কিংবা রাষ্ট্রের ন্যূনতম মজুরী নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে সকল মালিকেরা বাধ্য হয় মজুরী বাড়াতে তখন কিন্তু সে আর দশজন মালিকের মতই বাধ্য হয় মুনাফার পরিমাণ কমাতে কারণ সে তুলনামুলক কম মজুরী দিলে সহজেই শ্রমিক অসন্তোষ হবে কিংবা শ্রমিকেরা তার কারখানায় থাকবে না। অবশ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিজার্ভ আর্মি বড় থাকলে অর্থাত বেকার শ্রমিক বেশি থাকলে কিংবা রাষ্ট্রীয় নজরদারির অনুপস্থিত থাকলে বা শ্রমিক শ্রেনী অসংগঠিত থাকলে তখন সামাজের সার্বিক বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে মালিক ব্যাক্তিটি মজুরী কমিয়ে একেবারে সাবসিস্টেম লেভেলের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা এবং তার মাধ্যমে তুলনামূলক ভাবে বেশি মুনাফা করার মাধ্যমে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌছার চেষ্টা করে- এরকম একটা পরিস্থিতিতেই কিন্তু আমাদের দেশের শ্রমিকদের সস্তা শ্রম শোষণ করছে দেশীয় ও বিদেশী পুজিপতি শ্রেণী। ড. ইউনুস কি এর ব্যাতিক্রম? তিনি মুনাফা সর্বোচ্চ না করার চেষ্টার কথা বলছেন ঠিকই কিন্তু শ্রমিকদের মজুরী কিন্তু তিনি দেবেন বাজারের আর দশটি মুনাফা সর্বোচ্চ কারী বা প্রফিট ম্যাক্সিমাইজিং কোম্পানি যে হারে দেয় তার সমান হারেই, সামাজিক ব্যাবসার ৭ নীতিমালার ৬ নং নীতিমালায় বলেই দিয়েছেন শ্রমিকদের ভালো কাজের পরিবেশ প্রদান করা হলেও তাদের মজুরী হবে মার্কেট ওয়েজ বা বাজারে প্রচলিত মজুরী। এ অর্থেও তার সামাজিক ব্যাবসা আর দশটা প্রফিট ম্যাক্সিমাইজিং কোম্পানি থেকে আলাদা কিছু নয়।

সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বের (অ)সামাজিক প্রয়োগ: ড. ইউনুস তার সামাজিক ব্যাবসা সম্পর্কিত বইটির এক জায়গায় সামাজিক ব্যাবসার ধরন-ধারণ কেমন হবে সে সম্পর্কে লিখেছেন- "I strongly feel that we need a parallel voice in the marketplace, offering consumers a different set of messages--messages like: **Think about whether you really need it! **The more you buy, the more likely it is that you are exhausting earth's nonrenewable resources. (পৃষ্ঠা-২১৪) পাঠক কল্পনা করুন তো গ্রামীণ ফোনের মোবাইলের বিজ্ঞাপনের পাশে এরকম একটি মেসেজ: “চিন্তা করুন আসলেই এটা আপনার প্রয়োজন কি-না!” অবাস্তব অসম্ভব মনে হচ্ছে, তাই না? চিন্তার কিছু নাই, ইউনুস সাহেব এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাচ্ছে না, তার সামাজিক ব্যাবসার প্রজেক্টগুলোর কোনটাই তার বর্তমান লাভজনক ব্যাবসাগুলোকে নিয়ে নয়, তিনি প্রচার চালাচ্ছেন সামাজিক ব্যাবসার কিন্তু নিজের লাভজনক ব্যাবসাগুলোকে সামাজিক ব্যবসায় রুপান্তর করছেন না। তিনি বরং বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চরের মাধ্যমে নতুন নতুন খাতে নতুন নতুন প্রজেক্ট খুলছেন। নিচে কয়েকটি প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করা হলো: ১) গ্রামীন-ডানোন প্রজেক্ট: এটি ফরাসী ফুড মাল্টিন্যাশনাল গ্রুপ ডানোনের সাথে অংশীদারীর ভিত্তিতে স্বল্পমূল্যে দই খাওয়ানোর মাধ্যমে শিশুদের অপুষ্টি দূর করার প্রজেক্ট। সর্বপ্রথম বগুড়ায় শক্তি দই তৈরীর কারখানা চালু করার পর এর লক্ষ হলো বিভিন্ন স্থানে আরও ৫০ টিরও বেশি কারখানা স্থাপন করা। গ্রামীন-ডানোনের সিংহ মার্কা শক্তি দইয়ের বৈশিষ্ট হলো এতে বাড়তি ভিটামিন, খনিজ লবণ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান মেশানো হয় যা নাকি একটি শিশুর দৈনিক পুষ্টি চাহিদার ৩০% মেটাবে।

৮০ গ্রাম শক্তি দইয়ের একটি কাপের দাম রাখা হয় ৬ ইউরোসেন্ট বা ৬ টাকা। সরকারী হিসেবেই বাংলাদেশের ৪০ ভাগের বেশি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে অর্থাত তাদের দৈনিক আয় ১ ডলার বা ৭০ টাকার নীচে। একজন মাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যের একটি পরিবারে যদি অন্তত ২ টি শিশুও থাকে তাহলে শক্তি দইয়ের মাধ্যমে তাদের দৈনিক পুষ্টি চাহিদার কেবল ৩০% ভাগ মেটাতে হলেই পরিবারটিকে ১২ টাকা খরচ করতে হবে দইয়ের পেছনে। পরিবারটি তার আয়ের ৬ ভাগের এক ভাগই যদি দুটি শিশুর ৩০% পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পেছনে খরচ করে তাহলে বাকি ৫০/৬০ টাকায় কি সবার ক্ষুধা নিবারণ সম্ভব? শক্তি দই দিয়ে বাস্তবে কতটুকু পুষ্টির অভাব পূরণ হয় সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ হলেও দই দিয়ে যে ক্ষুধা নিবারণ হয় না সেটা তো আমরা সবাই জানি। আমাদের দেশের সামর্থবান মানুষেরা তো দই খান বিয়ে সহ বিভিন্ন উতসবে ভারী খাবারের পর ডেসার্ট বা হজমে সহায়ক খাদ্য হিসেবে।

তাহলে ড.ইউনুস কোন বিবেচনা থেকে দরিদ্র পিতামাতার সন্তানদের দই খাওয়ানোর উপদেশ খয়রাত করছেন? ইউনুস সাহেব কি ক্ষুধা লাগলে তার সন্তানদের ক্ষুধা না মিটিয়ে, তাদের জন্য ডাল-ভাতের ব্যাবস্থা না করে দই দিয়ে পুষ্টি নিবারণ করতে রাজী হবেন? ২) গ্রামীন-ভিয়োলিয়া ওয়াটার লিমিটেড: এটি বহুজাতিক ভিয়োলা ওয়াটার এএমআই এর সাথে পানি- ব্যাবসার একটি প্রজেক্ট যার মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে প্রতি ১০ লিটার পানি ১ টাকা মূল্যে বিক্রয় করা হবে। তারা হিসেব করেছেন ৬ সদস্যের প্রতিটি পরিবারের দৈনিক ৩০ লিটার করে পানি লাগে। অর্থাত প্রতিটি পরিবারকে পানির জন্য মাসে ৯০ টাকা ব্যায় করতে হবে। রাষ্ট্রের দ্বায়িত্বহীনতায় ওয়াসার কল্যাণে আমরা শহরের মানুষরা বোতলজাত মিনারেল ওয়াটার খেতে ইতিমধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও গ্রামের মানুষদের কাছে এখনও ব্যাপারটি অভাবনীয়। যে মানুষেরা পুকুর-নদীর পানি বিনামূল্যেই পান করতো পরিবেশ দূষণ ও নদ-নদীর বেহাল অবস্থার কারণে তাদেরকে একসময় বাধ্য করা হলো টিউবয়েল স্থাপন করে পানি খেতে।

টিউবয়েল বাণিজ্যের পর এখন দেখা যাচ্ছে বিশাল সংখ্যক মানুষ ভূ-গর্ভস্থ আর্সেনিক বিষক্রিয়ার শিকার, কাজেই এবার তার জন্য নতুন প্যাকেজ- মাসে ৯০ টাকার পানি কিনে খাও। আমরা যারা এক লিটার পানি ২০ টাকা দিয়ে খাই তাদের কাছে ১০ লিটার পানির দাম ১ টাকা বেশ কম মনে হলেও গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় টাকা দিয়ে পানি কিনে খাওয়াটাই একটা সুররিয়ালিস্টিক বা পরাবাস্তব ব্যাপার। নদী-খাল-বিল-পুকুর ভর্তি গ্রাম বাংলার মানুষকে কেন পানি কিনে খেতে হবে? কিনে খেতে হবে কেননা রাষ্ট্র তার দায়-দ্বায়িত্ব এনজিও আর ব্যাবসায়ীদের কাছে সাবকন্ট্রাক্ট দিয়েছে- তার সুযোগই নিচ্ছে ইউনুসের মতো জাত ব্যাবসায়ীরা। ৩) গ্রামীন-বিএএসএফ প্রজেক্ট: এটি মশারি তৈরী এবং বিক্রি করে গ্রামের মানুষকে ম্যালেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা করা এবং গরীবের অপুষ্টিকর খাদ্যের উপর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এর গুড়ো ছিটিয়ে তাদেরকে পুষ্টি দান করার প্রজেক্ট। যে মানুষগুলোর দুবেলা ভাত খাওয়ার পয়সা জোটে না, তাদের জন্য স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করার পরিবর্তে উল্টো তাদের কাছে আবার কৃত্রিম পুষ্টি বিক্রির ব্যাবস্থা – সামাজিক ব্যাবসাই বটে! ৪) গ্রামীণ-ইন্টেল প্রজেক্ট: এটি হলো ইন্টেল কর্পোরেশনের সাথে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ব্যাবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত তথ্য বিক্রি করার প্রজেক্ট।

এছাড়াও আরও আছে গ্রামীন জিসি আই কেয়ার প্রজেক্ট যা স্বল্প মূল্যে দরিদ্রদের এবং অধিক মূ্ল্যে ধনীদের চক্ষু চিকিতসা প্রদান করবে। এই প্রজেক্টগুলো ছাড়াও ড. ইউনুস আরো কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার করার আলোচনা করছে। এগুলো হলো- জাপানের ফেলিসিমো, আমেরিকার শ্যাকলি, ইসলামি উন্নয়ন ফান্ড, মোনাকো ফান্ড, ক্রেডিট এগ্রিকোল ফান্ড ইত্যাদি। উপরোক্ত প্রজেক্টগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এগুলো মূলত খাদ্য,বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিতসা ইত্যাদি বিভিন্ন সেবা খাত যেগুলো প্রকৃত পক্ষে রাষ্ট্রীয় খাত হিসেবে এখনও পর্যন্ত বিবেচিত, যেগুলোর ব্যাবস্থা করা রাষ্ট্রেরই দ্বায়িত্ব, সেগুলো নিয়ে ব্যাবসা করছে আর এ ব্যাবসার টার্গেট কনসিউমার বা ভোক্তা হলো মূলত গ্রামের দরিদ্র জনগণ, সীমিত ক্রয়ক্ষমতার কারণে যারা এখনও কসমোপলিটান বাজার অর্থনীতির সাবান-স্যাম্পুর ভোক্তা হয়ে উঠেনি। প্রশ্ন হলো, তাহলে এই দরিদ্র মানুষগুলোর তাহলে এসব “সামাজিক পণ্য” কেনার টাকা পাবে কোথা থেকে? কেন মাইক্রো ক্রেডিট আছে না? ক্ষুদ্র ঋণ যদি হয় বিনা জামানতে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষকে ঋণ বাণিজ্যের আওতায় নিয়ে আসার প্রকল্প, তাহলে সামাজিক ব্যাবসা হলো সেই ক্ষ্রদ্র ঋণগ্রহীতার ঋণের টাকায় যে সাময়িক ক্রয়ক্ষমতা তৈরী হয় সেটাকে ব্যাবহার করে আরেক দফা মুনাফা করার প্রকল্প।

উপরে উদ্ধৃত ইউনুস সাহেবের It widens the market by giving a new option to consumers কিংবা .It adds to the competition. বা It brings new dimension to the business world কথাগুলোর মাজেজা এখানেই। বহুজাতিকের সামাজিক ব্যাবসা: এতো গেল ইউনুস সাহেবের ব্যাবসায়িক প্রণোদনার কথা। কিন্তু মুনাফা তুলে নিতে পারবে না জেনেও ডানোন বা ভিয়োলার মত বহুজাতিকেরা কেন এই তথাকথিত সামাজিক ব্যাবসায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে? বিবিসির জেমস মিলিক লিখেছেন: Danone made a profit of more than $1bn in 2008 and expects that to rise by 10% this year, despite a downturn in sales in Europe. The company has set its sights on South Asia. But to succeed there, it has to learn how to sell to low-income customers, many of whom live in the countryside. In Bangladesh, Danone has teamed up with local experts to build a yogurt factory with a difference - what Professor Yunus calls a social business. তাছাড়া করপোরেট স্যোসাল রেসপন্সেবিলিটির একটা ব্যাপার আছেনা! কাজেই একদিকে ব্রান্ডিং অন্যাদিকে মূল্যবান মার্কেটিং কৌশলের অভিজ্ঞতা লাভ এই দুই মিলিয়েই তাদের এই সামাজিক বিনিয়োগ। তাছাড়া এই বিনিয়োগের জন্য তো আর তাদের খুব বেশি খরচ বা ঝুকি নিতে হচেছ্ না- ডানোনের মুখপাত্র ইমানুয়েল মারচেন্ট জানাচ্ছেন- "Building a plant which is 100 times smaller than our others is a less risky way of entering a new territory and shareholders understand our vision." যদিও ইউনুস সাহেব বেশ ঘটা করে তার ওয়েব সাইটে বিনিয়োগকারীকে সামান্য পরিমাণ মুনাফাও ডিভিডেন্ট আকারে তুলে নেয়ার সুযোগ দানের বিরোধিতা করে বলেছেন: Another way to put the same question is : Why can't you allow thee investors in social business to get a small fixed profit — say, 1% dividend. My answer is the same. I may describe by saying something like this : you are in a "no smoking" building, you are arguing "Why can't I be allowed to take just one small puff ?" Answer is simple — it destroys the attitude. In Ramadan, Muslims are not allowed to eat or drink until the after the sunset. Why not take a sip of water during the day ? It destroys the strength of the mental commitment. You lose a lot for a small favour. বাস্তবে তিনি গ্রামীন-ডানোন প্রজেক্ট থেকে ডানোন কে তার বিনিয়োগ উঠে আসার পর বছর বছর ১% হারে টোকেন বা নামমাত্র ডিভিডেন্ট দেয়ার প্রণোদনার কথা স্বীকার করে তার বইয়ের ১৩৮ পৃষ্ঠায় বলছেন, তার উদ্দেশ্য হলো: “run the business in such a way as to incur no losses and to generate a small surplus. Out of this surplus, the initial investments of the two parties would be repaid as early as possible. After that, the joint venture would pay the investors a 1 percent annual dividend on their original investment.” এই যখন অবস্থা তখন, প্রকৃতপক্ষে কত পার্সেন্ট ডিভিডেন্ট কোথায় কার কাছে যাবে তার হিসেব কে কাকে দেখাচ্ছে? সামাজিক ব্যাবসা- পুজির ব্রান্ডিং: গ্লোবাল এলায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশান এর এক অনুষ্ঠানে গ্রামীন-ডানোনের কারখানা সম্পর্কে ড. ইউনুস বলেছিলেন: “এটা ছোট্ট একটা প্ল্যান্ট হলেও এর ম্যাসেজ বা বার্তা টি কিন্তু ছোট নয়। “ ডানোনের সিইও রিবোড তার সাথে যোগ করেছিলেন: “আমরা পয়সা বানানোর সময় একই সাথে ভালো কাজও করতে পারি।

.... আমি গভীর ভাবে বিশ্বাস করি যে ভবিষ্যত নির্ভর করছে নতুন নতুন ব্যাবসার মডেল এবং নতুন ধরনের কর্পোরেশন গঠন করার সামর্থ্যের উপর। “ বর্তমান বিশ্বব্যাবস্থার সংকটের সময় যখন সারা দুনিয়া জুড়েই কর্পোরেট পুজির আগ্রাসনের চেহারা উন্মোচিত হচ্ছে, যখন জীবন ও পরিবেশের উপর এই ব্যাবস্থার হুমকির বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধ তীব্র হয়ে উঠছে তখন কেবল ড. ইউনুস কিংবা রিবোড-ই নয়, এই ব্যাবস্থার সুবিধাভোগী শ্রেণী, যারা এই ব্যাবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চায় তাদের প্রায় সবার মধ্যেই এই ব্যাবস্থার নতুন ব্র্যান্ডিং এর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে। যে কারণে ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সভায় বিল গেটসকে বলতে শোনা যায় “সৃষ্টিশীল পুজিবাদের” প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে, সে একই কারণে বিশ্ব জুড়েই নতুন নতুন ব্যাবস্থার কথা শোনা যেতে থাকে- বিভিন্ন ধরণের ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা, উদীয়মান হাইব্রিড ধরনের মুনাফাবিহীন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম, গুগলের মত “ফর প্রফিট ফিলানথ্রপি” বা “মুনাফার জন্য দান” জাতীয় কর্পোরেশন, কর্মচারী-মালিকানা নির্ভর কোম্পানি, ইউরোপীয় ধরনের ফাউন্ডেশান-মালিকানা নির্ভর কোম্পানি কিংবা বিভিন্ন ধরনের সমবায়ের কথা। আপাত দৃষ্টিতে এগুলোর আকার আকৃতি ও ঘোষিত লক্ষের মধ্যে কম-বেশি ভিন্নতা দেখা গেলেও মূল উদ্দেশ্যের জায়গাটি কিন্তু এক- মুনাফার গায়ে সামাজিক উদ্দেশ্যের তকমা এটে বর্তমান অর্থব্যাবস্থার ভাবমুর্তির সংকটটিকে সামাল দেয়া এবং সেই সাথে বিনিয়োগের নতুন নতুন চ্যানেল উন্মুক্ত করা। ড. ইউনুসের সফলতা হলো তাদের সেই আকুতির একটা গ্লোবাল ভাষা দেয়া এবং সেই সাথে হাতে-কলমেও কাজ করে দেখানো- ফলে গ্রামীন-ডানোন কেবল গ্রামীন কিংবা ডানোনের ব্র্যান্ডিং নয়, সেই সাথে গোটা পুজিবাদী ব্যাবস্থারই এক নয়া ব্র্যান্ডিং ।

যাই হোক, তাদের কাজ তারা করেছে, এখন আমাদের কাজ আমাদেরকে করতে হবে। আমরা যারা মনে করি এই শোষণমূলক অর্থব্যাবস্থার গোড়া উপরে ফেলা দরকার তাদের কর্তব্য হলো এই সব নিত্য-নতুন মুখোশ উন্মোচন করে পুজিবাদের ভিত্তি নরম করে ফেলা যেন শিকড় শুদ্ধ উপড়ে ফেলার কাজটি সহজ হয়।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।