একটি আত্মিক বিশ্লেষণ:
প্রেম, ঈশ্বর এবং জীব
-এম জসীম
সাধু বিবেকানন্দ বললেন, ‘ জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’। এই কথার মর্ম কীভাবে অনুধাবন করি আমরা ( মানুষ)। কারণ তা অনুধাবনের শক্তি, সাহস, সংকল্প , শিক্ষা আমাদের ক’জনের আছে। নেই বলেই যুগে যুগে মানুষের জন্য এত বাক্য ব্যয় করতে উপনীত হয়েছেন সাধুজনেরা। আর তাঁরা সাধুতা অর্জন করেছিলেন মাটি ও সোনাকে সমমূল্যের চিন্তার প্রয়োগ করে।
বিবেকানন্দের বিবেক প্রসূত চিন্তার প্রতিফলন এই পরম দর্শনে জীব বলতে কেবল মানুষকে ইঙ্গিত করেছেন তা নয়। জীব বলতে তাবৎ জগতের ক্রিয়শাীল প্রণীকূলের সমষ্টিকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু আমরা মানুষের প্রতি যেখানে সদাচার করতে পারিনা , সেখানে সকল জীবের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য দেখাবার মত মানসিক, আত্মিক এবং চেতনাগত প্রস্তুতি আমাদের থাকবেনা এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ আমরা জাগতিক সুখ ভোগের জন্য যাচ্ছে তাই করতে পারি, আবার অপার্থিব সুখ-শান্তি লাভের জন্যেও যত নিচে হোক নামতে পারি। কোনটাই আমরা ছাড়তে চাইনা, এমনকি পারিওনা।
মানুষের এই দ্বৈত স্বার্থপরতার পেছনে মানুষই যুক্তি দাঁড় করেছে। কিন্তু এর কারণ অনুসন্ধান হয়নি তেমন।
একটা গল্প বলি। ধরুন কেউ রাতের বেলা এক বস্তা চাল রাস্তার ওপর ফেলে রেখেছেন। সকালে উঠে দেখবেন একঝাঁক পাখি এসে যার যতটুক লাগে ততটুকু খেয়ে চলে যাচ্ছে।
আবার গরু, ছাগল , ভেড়ার পাল এসেও যার যতটুকু লাগে খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একজন মানুষ যদি বস্তাটি দেখতে পায় তাহলে পুরো বস্তাটি নিয়েই চলে যাবে। কারণ মানুষ বুদ্ধিতে, চিন্তায়, গুনে সেরা জীব, তাই তাঁর কর্মও নিশ্চয়ই সেরা!
গল্পটি এজন্য বলা যে, মানুষের এই প্রবৃত্তির কারণ হিসেবে সাধারণত তাঁর লোভকে দায়ী করা হয়। কিন্তু এর পেছনে আরেকটি কারণ রয়েছে সেটি হচ্ছে , মানুষের অনিশ্চয়তাবোধ। কেবল মাত্র মানুষই তাঁর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করার শক্তি রাখে, অন্য কোন প্রানী তা রাখেনা।
এই অনিশ্চয়তাবোধ থেকে মানুষের মনে এক ধরণের ভয়ের উদয় হয়। তাই সে আজ , কাল, পরশু এমনকি সারা জীবনের আহার সঞ্চয় রাখতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সারা জীবনের আহার সঞ্চয় করেও মানুষ কেন তৃপ্ত হতে পারেনা। প্রকৃত অর্থে মানুষ নিজেই জানেনা আসলে সে কি চায় এবং তার উত্তম পথ কী।
সাধূ বিবেকানন্দ তাঁর আত্মদর্শনে তিনটি বিষয়ের মধ্যে প্রথমেই বলেছেন প্রেমের কথা।
আমরা দেখবো প্রেমতত্ত্ব মূলত তাঁর দর্শনেই কেবল প্রাধান্য পায়নি। সুফি দর্শন, পাশ্চাত্য ভাববাদী দর্শন এবং ভারতীয় দর্শনের এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে প্রেমতত্ত্বের কথা। মুলত, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের মাঝে বিভিন্ন ধরনের যে প্রকাশ পরিলতি হয় তা পরম সত্ত্বারই প্রেম-প্রকাশের প্রতীক।
সুফি সাধক নসুর হাল্লাজ বলেছেন, ‘ আল্লাহ হলো পরম প্রেম এবং বিশ্ব হলো প্রেমনীতির বহি:প্রকাশ’। তিনি বলেন, ‘প্রেমই পরম বস্তু , পরম ধন ও সাধকের পরম কাম্য’।
হাল্লাজ প্রেমের তিনটি স্তর নির্দিষ্ট করেছেন, যেমন মানবীয় প্রেম, আধ্যাত্মিক ও র্ঐশী প্রেম। তাঁর মতে, ‘ ঐশী প্রেমই পরম সত্ত্বার প্রেম। এই প্রেমই সব কিছুর উৎস- সৃষ্টির মূল। পরম সত্ত্বা নি:সঙ্গ অবস্থায় নিজেকে নিজে ভালবাসেন। ফলে নিজেকে প্রকাশ করার বাসনা থেকেই সৃষ্টির মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করেছেন ।
প্রেমই প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ তথা মানবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটায়। প্রেমিক তখন বুঝতে পারে সবকিছু মিলে এক- সবকিছুর মূলে এক। আর তিনিই পরমাত্মা, পরম সত্ত্বা’।
হাল্লাজের পর ইবনেসিনা প্রেমতত্তের ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘প্রেমই বিশ্বতাত্তিক নীতি বা সবকিছুর পরিচালনা শক্তি। এই প্রেম সকল বস্তু ও সত্ত্বাকে পরম সৌন্দর্যের দিকে এগিয়ে নেয়’।
অবশ্য ইবনেসিনার প্রেম-র্দশনের ব্যাখ্যা নতুন কিছু নয়, তিনি দার্শনিক প্লেটোর প্রেম-দর্শনের ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র।
মহামতি প্লেটোর মতে, ‘ পরম সত্ত্বা অতীন্দ্রিয় জগতের সত্ত্বা, ধারনার উৎস। একত্রীকরণ,মিলন, সাদৃশ্যকরণ, উন্নতিসাধন, পুনরুৎপাদন ইত্যাদি হলো প্রেমের বিভিন্ন প্রকাশ’।
এরপর ইবনে রুশদ তাঁর প্রেম- দর্শনে সর্বজনীন ধর্মের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সকল ধর্ম একই মহাসত্যের বহি:প্রকাশ মাত্র’।
তিনি ধর্মের দুটি দিক নির্দিষ্ট করে বলেন, ‘ধর্মের দুটি দিক আছে যেমন, অভ্যন্তরীণ সত্য বা প্রেমময় দিক আর বাহ্যিক দিক’। তাঁর মতে , প্রেমের অভ্যন্তরীণ দিক হলো ধর্মের প্রাণ, আর বাহ্যিক রূপ হলো তার দেহ। প্রেমের অভাবে ধর্মের বাহ্যরূপ আচার -অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। তিনি বলেন, ‘বৈচিত্রময় বিশ্বে সৃষ্ট সবকিছুই স্রষ্টার নিদর্শন। বিশ্বে যে মহাশক্তির স্পন্দন অনুভভুত হয় তার প্রতি প্রেমাকর্ষণই চরম ও পরম ধর্ম; আর এটাই সর্বজণীন ধর্ম।
রুশদ বলেন, মানুষের অন্তরে যিনি বিরাজ করেণ, যাঁর চেতনায় মানবাত্মা সতত সচেতন থাকে , তাঁকে সন্ধান করতে কোন মন্দির, মসজিদ, গীর্জায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অন্তরের ধনকে অন্তরের প্রেমাকর্ষণ দ্বারা সন্ধান করা প্রয়োজন’( হাযারি-পৃষ্ঠা:৩৭)।
সুফি দার্শনিক ও কবি জালাল উদ্দীন রুমী তাঁর মাসনভী কাব্যে প্রেমতত্ত তুলে ধরেন। মাসনভী কাব্যের মর্মবানী হলো প্রেম, বিরহ আর পরমাত্মার ঐক্য। রুমীর মতে প্রেম হলো সব ব্যাধির মহৌষধ।
প্রেম মনকে মলিনতা ও পাপাসক্তি হতে মুক্ত , নির্মল, পবিত্র ও উন্নত করে। প্রেমের বলেই মাটির দেহ আকাশে উন্নীত হয়েছিল। প্রেমের স্পর্শে পর্বত সচল হয়েছিল । প্রেম তুর পর্বতে প্রেমোন্মক্ততা এনেছিল এবং মুসা মুর্চ্ছিত হয়ে পড়েছিল।
রুমী বলেন, ‘তাঁর সত্ত্বার ওপর-নিচ সবদিক প্রভুর সত্তার মধ্যে লুকিয়ে আছে।
সে গোপন রহস্য প্রকাশ করলে সমগ্র বিশ্ব ওলট-পালট হয়ে যাবে’।
রুমীর প্রেমতত্ত মহামতি প্লেটো ও ইবনেসিনার মতবাদের অনুরূপ। রুমী বলেন, ‘বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা কার্যের ভালো-মন্দ, লাভ-তি, ইত্যাদি বিচার করে দেখে। কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রে এসব হিসাব-নিকাশ নেই। প্রেমিক কোন প্রকার বাছ-বিচার ছাড়াই প্রেমাস্পদের কাছে আত্মসমর্পণ করে’।
তিনি বলেন, প্রেমই পরম সৌন্দর্য এবং পরম সৌন্দর্যই প্রেম। সুতরাং প্রেম ইন্দ্রিয়াতীত আধ্যাত্মিক জগতের পরম সৌন্দর্যের কাছে মানুষকে পৌঁছে দেয়। জীবনের আসল কাজই হলো ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাওয়া- অপুর্ণতা থেকে পুর্ণতায় উন্নীত হওয়া। প্রেম জীবনকে ুদ্রতা থেকে , তুচ্ছতা ও সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠাতে সম। প্রেমের আবেগে পরম সেীন্দর্যের সন্ধান পাওয়া যায়।
তাতে পরম সৌন্দর্যের সঙ্গে এক মহামিলন ঘটে। সমগ্র সৃষ্টির মধ্যদিয়ে অনন্ত গতিতে প্রবাহিত এক মহাপ্রেরণা ছুঁটে চলছে পরম উৎসের পানে। আর এ প্রেরণার নামই প্রেম’। রুমির মতে প্রেমের অর্থ যে বোঝে সে সৃষ্টির নিগুঢ় তত্ত্ব বোঝে- তার আধ্যাত্কি দৃষ্টির সামনে প্রকৃত তত্ত্ব উন্মোচিত হয়। প্রেম আত্মার রহস্য যা ব্যক্তিরই অর্ন্তনিহিত সত্তার ঐশ্বর্য।
সত্যের পরিচয় লাভের জন্য প্রেম এক উপলব্ধি শক্তির সৃষ্টি করে এবং এ শক্তি মানুষকে মহত্ত্ব, মানবত্ব প্রভৃতি গুনে গুনান্বিত করে ।
লালনের মরমী দর্শনের দিকে দৃষ্টি দিলে সেখানেও মূল কথা প্রেম। তাঁর মতে, ‘প্রেম সংজ্ঞাতীত ও বর্ণনাতীত’। রুমি ও অন্যান্য দার্শনিকদের মতই তিনি বলেন,প্রেম সারবস্তু, প্রেম-পদার্থ সাধনার চূড়ান্ত ল্য, আত্মিক বিবর্তনের চরম পরিনতি, মানবাত্মার সকল ব্যাধির মহৌষধ,বিশ্বের সকল কিছুর মূল সত্ত্বা, সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার প্রেরণা, মরমী চিত্তের পরম অভিজ্ঞতা, আত্মার অমরতা লাভের পরশ পাথর। লালন প্রেমকে দুভাগে ভাগ করেছেন; ঐশী প্রেম ও জাগতিক সুখ ভোগের প্রেম।
প্রাকৃতিক কারণেই ধন-সম্পদ,স্ত্রী-পুত্র-পরিজন ইত্যাদি কামনা করে। এই কামনা যখন পার্থিব বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট করে অর্থ্যাৎ জড় জগতের প্রতি আকর্ষণই লালনের মতে তা পার্থিব প্রেম। আর যে প্রেমে মানবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে, লালনের মতে তাই ঐশী প্রেম।
এতসব কথার মুল প্রতিপাদ্য বিশ্লেষন করলে আমরা দেখবো প্রেম,জীব আর ঈশ্বর একই সুত্রে গাথা। জীবের প্রতি যিনি দয়াবান তিনি প্রকৃত জ্ঞানী, তিনি নিজেকে চেনার মতা রাখেন, তিনি প্রকৃতই ঈশ্বরের সেবক , আর এর মধ্যদিয়ে মানব জীবন স্বার্থকতা লাভ করে।
এর বাইরে ধর্মের যে কথিত রীতি তা কেবল আনুষ্ঠানিকতা সদৃশ বা বাহ্যিক। মানব জীবনের কল্যাণ ও নির্বানের পথ নিহিত হয়েছে নিজেকে চেনার মধ্যদিয়ে অর্জিত শ্বাশত জ্ঞানকে জীবের কল্যানে প্রয়োগ করা। আর নিজেকে চেনার মধ্যে আত্মা যে পরিশুদ্ধতা পায় এবং মস্তিষ্ক উর্বর যে জ্ঞান অর্জন করে তা পার্থিব সকল স্বার্থপরতা থেকে মানুষকে পরিত্রাণ দেয়। সব অর্বাচিনতাকে ধুঁয়েমুছে মানুষকে মানবিক করে। মানুষ তখন স্বয়ং ঈশ্বরের সেবক হয়ে যায় ।
আর ঈশ্বরের সেবক হওয়ার একমাত্র পথ জীবের প্রতি সদাচরণ বা প্রেম। এই প্রেমই সব জ্ঞানের ,সব ধর্মের উৎস। এই অভেদ নীতি সব ধর্মমত দার্শনিকের; এমনকি সব ধর্মেরও। এই জ্ঞান, এই প্রেম, এই মানবিকতা অর্জনই মানব জীবনের অন্যতম সাধনা হওয়া উচিত। যদিও এই সাধনায় অর্বাচিনদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ আসবে, আঘাত আসবে, অপবাদ-অপপ্রচারের কালো মেঘ ছেয়ে দেবে চারদিক।
অপশক্তির কাছে শুভশক্তিকে মনে হবে সংখ্যালঘু । তবু নিস্তরঙ্গ নদী সাঁতরে পার হওয়ার থেকে তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ নদী পার হয়ে কিনারে যাওয়ার আলাদা গৌরব আছে।
শেষে পবিত্র কোরানের একটি বানী বলি,‘রাত যেমন দিনের মতো নয়, অন্ধকার যেমন আলোর মতো নয়, অন্ধ যেমন চুষ্মানের মতো নয়, মৃত যেমন জীবিতের মতো নয়, তেমনি অজ্ঞানী জ্ঞানীর মতো নয়’ ( কোরান-আয়াত : ৩৫:১৯-২২,২২-২৮; ৩৯:৯ )।
-এম জসীম
২৫ নভেম্বর-২০০৯
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।