শুদ্ধতার আগুনে যেন সতত পুড়ি
মা'র কাছে শুনতে পাই ইকবাল পিলুর সমস্ত কাগজ-পত্র পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন দূতাবাসে আর ট্রাভেল এজেন্সিতে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সারতে পারলে সপ্তাহ দুয়েকের ভেতরই সে নাইজেরিয়া চলে যেতে পারবে।
মায়ের কাছ থেকে শুনে আমি পিলুকে বলি, তুই তো আর আমাদের থাকলি না। কথাটা যদিও বলতে পারি কিন্তু আমার ভেতরে ভেতরে কেমন যেন একটি হাহাকার ধ্বনিত হতে থাকে। পিলু চলে গেলে ঘরে আমার মন বসবে না।
আমার খুবই ভালো একজন বন্ধু। আমার জন্য যার অনেক ভাবনা আর ভালোবাসা সেই ছোট বেলা থেকেই। সেই পরম বন্ধুর মত আমার অনেক প্রিয় বোনটি থাকবে না আমার চোখের সামনে। ইচ্ছে হলেও ক্ষণেকের জন্য যাকে দেখতে পাবো না। আমার ইচ্ছে হয় পিলুকে জড়িয়ে ধরে বলি, তোকে কিছুতেই যেতে দেবো না! তোকে না দেখে আমি থাকতে পারবো না! কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারি না।
আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলেই তা হয়তো কান্নার বিস্ফোরণ ঘটাবে। আমি পিলুর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেই। কেঁদে ফেলবো ভয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে পারি না।
পিলু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আমাদের ছেড়ে যেতে হয়তো তারও খারাপ লাগছে।
সে কি আমাদের দৃষ্টি থেকে কান্না লুকাতেই নিজের ঘরে আত্মগোপন করলো?
পিলুর কাগজ-পত্র ঠিক হতে হতে খবর পাই বড় ভাবি আমেরিকা চলে গেছেন। কবে গেল? কখন গেল? আমরা কিছুই জানি না। তাহলে তো তাদের বড় ছেলেটা খুবই একা হয়ে গেল!
মা-বাবা আক্ষেপ করে বলেন, আলমের ছেলেমেয়ে দুটোও জানি কেমন! আমাদের দিকে যেন কোনো টান অনুভব করে না। নাকি ছোটবেলা থেকেই দূরে দূরে ছিলো বলে তাদের মনে আমাদের জন্য ভালোবাসা তৈরী হয়নি? নাকি আমরাই ঠিক মত স্নেহ-মমতা দিতে পারলাম না!
আমি এ নিয়ে কথা বলি না। উচিত হবে না বলেই বলি না।
আমার কথাগুলো হয়তো খুবই নিষ্ঠুর আর অমার্জিত শোনাবে। তার চেয়ে চুপ থাকাই সব দিক দিয়ে মঙ্গল।
শুক্রবার পিলু বললো, ভাইয়া, চল তো মার্কেটে যাবো!
সপ্তাহের ছ’দিন অফিস করে আমার ভালো লাগছিলো না ঘর থেকে বের হতে। কোনো ছুতো নাতায় বাবা-মা’র কাছে থাকাটাই আমার উদ্দেশ্য ছিলো। এখন পিলুর সঙ্গে মার্কেটে গেলে সে কোথায় কোথায় আমাকে টেনে নিয়ে বেড়াবে তার ঠিক নেই।
চট করে ফিরে আসারও সম্ভাবনা নেই। তাই তাকে বললাম, তুই তো নিজেই সব মার্কেট চিনিস। আমাকে কেন?
খানিকটা রাগিয়ে দিতে পারলে হয়তো সে একাই বেরিয়ে যাবে। কিন্তু সে না রেগে বললো, চল না!
আমার ভালো সার্ট-প্যান্টগুলো পরেই অফিসে যাতায়াত করছিলাম বলে সেগুলো ময়লা হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি। সকালের দিকে ধূয়ে দিয়েছিলাম।
এখনো শুকোয়নি হয়তো। বললাম, কাপড় তো সব ধূয়ে রোদে দিয়েছি। কি পরে যাবো?
পিলু আমার দিকে তাকিয়ে বললো, যেভাবে আছিস চল!
আমি মা’র দিকে তাকাই। বাবার দিকে তাকাই। তারা কিছুই বলেন না।
যেন তারা খুব ভালো করেই জানেন যে, পিলু কেন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই যেন চুপ হয়ে ছিলেন। ঘরে যে ঝ্যালঝ্যালে প্যান্ট-সার্ট পরে ছিলাম তা পরেই পিলুর সঙ্গে বাইরে বের হই।
রিকশায় যেতে যেতে পিলু বললো, তোর মনে আছে ভাইয়া, তুই যেবার রাণীর ছোট ভাই তামিমকে পড়িয়ে প্রথম ইনকাম করেছিলি?
কবেকার কথা? তখন আমি মাত্র এইটে পড়ি আর পিলু সিক্সের ছাত্রী।
তামিম ক্লাস টুতে পড়তো।
প্রথম মাসে ওরা পঞ্চাশ টাকা দিলে টাকাটা নিতে চাচ্ছিলাম না। একই এলাকায় পাশাপাশি বাড়ি। এমন পড়শীর কাছ থেকে পড়িয়ে টাকা নিতে আমার লজ্জা লাগছিলো। তবুও তামিমের আম্মা জোর করে টাকাটা পকেটে গুঁজে দিয়েছিলেন।
পিলু আমার দিকে ফিরে কলকল করে বললো, তোর মনে নেই?
মনে আছে।
তুই পুরোটা টাকা দিয়েই আমার জন্য আইসক্রিম কিনে নিয়ে এসেছিলি।
হুঁ।
এর পর আরো কত দামী আর ভালো ভালো আইসক্রিম খেয়েছি। কিন্তু তোর সেই আইসক্রিমের স্বাদ আজও যেন মুখে লেগে আছে।
ঘরে যে শাড়িটা পড়েছিলো সেটা আর বদলায়নি পিলু।
চুলও হয়তো আঁচড়ায়নি। কেমন এলোমেলো লাগছে। মুখে কোনো প্রসাধন নেই। তবুও পিলুকে খুব সুন্দর লাগছিলো। মুখ চোখ যেন মায়ায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
হঠাৎ আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললো, চল, আজ আইসক্রিম খাই!
আমার দাঁত সিরসির করবে।
পিলু হেসে উঠে বললো, আরে বোকা বরফের টুকরোর আইসক্রীম না! সঙ্গে কয়েক রকমের ফলও মিশিয়ে দেয়।
আমি জোর দিয়ে না করতে পারি না। বলি, তুই কি আমাকে আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছিস?
পিলু মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, আরো অন্য ব্যাপারও আছে।
আমি বুঝতে পারি না পিলু কি ভেবে আমাকে নিয়ে বের হলো।
নাকি ক্যাম্পাসে মাঝে মধ্যে আমরা যেমন একসঙ্গে ঘুরতাম সেটা মনে করেই আজ বেরিয়েছে। ইকবালের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমরা আর কখনোই একসঙ্গে কোথাও যাইনি।
আইসক্রিম খেতে খেতে পিলু বললো, আজকাল ছেলেরা টাই পরা ছেড়ে দিয়েছে নাকি? আসার সময় কারো গলায় টাই দেখলাম না।
আমি অবাক হয়ে তাকাই পিলুর মুখের দিকে।
তারপর বলি, হঠাৎ টাইয়ের ব্যাপারে তোর এত কৌতুহল হচ্ছে কেন?
না।
এমনিই বললাম। আগে বাবাকে দেখতাম টাই পরে অফিসে যেতেন। তখন অনেকেই নিয়মিত টাই পরে বের হতেন। কিন্তু আজকাল অমনটা দেখা যায় না।
দিনদিন মানুষ নানা রকম সমস্যায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
তার খরচের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। তাই হয়তো টাই কেনার দামটা অন্য কোনো খরচের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছে।
আমার তা মনে হয় না।
কি মনে হয়?
আমার মনে হচ্ছে টাই পরতে যে ফুরফুরে মনের দরকার হয় লোকজনের সে মনটাই হয়তো এখন নেই। এখন কেবল কোনো রকমে বেঁচে থাকা বা দিনগুলোকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যেতেই মানুষ ব্যস্ত।
তাহলে আমি কি বললাম?
তুই কি বললি আবার?
পিলু আইসক্রিমের গ্লাস থেকে একটি পেঁপের টুকরো মুখে তুলে চিবোয়।
দিনদিন মানুষ নানা সমস্যায় জড়িয়ে যাচ্ছে বললাম না!
পিলু আমার গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললো, তুই তো আসক্রিম খাচ্ছিস না!
বললাম, খুবই ঠান্ডা। দু চামচ খেয়ে আমার গলা ব্যথা হয়ে গেছে।
পিলু আমার গ্লাসটা টেনে নিয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে আবার বললো, ছেলেরা দেখতে যেমনই হোক, টাই পরলে তাদের অনেক স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম মনে হয়। তুই তো চাকরি করছিস।
টাই পরে অফিসে যেতে পারিস না?
পিলুর কথা শুনে আমি না হেসে থাকতে পারি না। বলি, তুই তো দেখিসনি সকালের দিকে কেমন ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠতে হয়। সে সময় গলায় টাই বাঁধা থাকলে ফাঁস লেগেই মারা যেতে হবে। নয়তো লোকজনের টানে সেটা ছিঁড়ে রাস্তায় পড়ে থাকবে।
পিলু একবার সেলফোনটা তুলে ধরে সময় দেখলো মনে হয়।
তারপর বললো, এটাও একটা প্রধান কারণ হয়তো। আমাদের এদিকের রাস্তায় যখন সিটি লাক্সারি বাস সার্ভিস চালু হবে তখন হয়তো সমস্যাটা থাকবে না।
আইসক্রিমের গ্লাস ঠেলে দিয়ে পিলু বললো, চল বেরোই!
আমি যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বলি, আর কোথায় যাবি?
ইস্টার্ন প্লাজা। ইকবালের জন্য একটা টাই কিনবো।
আর তোর জন্য দু একটা গিফট।
এমন ব্যাপারটা ভাবনায় আসেনি। বলি, দোকানের লোকেরা আমাদের ফকির ফাকরা ভেবে হয়তো দামই বলতে চাইবে না।
পিলু হেসে উঠে বললো, আগে দেখি না কি ধরণের আচরণ করে!
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।