তোমার অস্তিত্বে সন্দিহান, তবু্ও সদাই তোমায় খুঁজি
বাংলা একাডেমির 'বাংলা থেকে বাংলা' অভিধানে স্রষ্টা ও পরকালে বিশ্বাস নেই এমন ব্যক্তিকেই নাস্তিক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সোজা কথায় বলতে গেলে ঈশ্বরের অস্তিত্বে চূড়ান্তভাবে অবিশ্বাসী ব্যক্তিই নাস্তিক এবং তাঁর চর্চিত জীবনব্যবস্থাই নাস্তিকতা। এখানে কিন্তু ধর্মে অবিশ্বাসী ব্যক্তিকে নাস্তিক বলা হয়নি। সে মোতাবেক একজন ধর্মে অবিশ্বাসী ব্যক্তিও আস্তিক হতে পারেন যদি তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। কিন্তু আমাদের সাধারণ বিশ্বাসটা এমন অবস্থায় দাড়িয়েছে যে, ধর্মে অবিশ্বাসী ব্যক্তিকেই নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি একজন ব্যক্তির অনাস্থা থাকতেই পারে। নিজের বিবেকের কাছে অশুদ্ধ হলে প্রচলিত ধর্মগুলোর নির্দেশ একজন লোক অবজ্ঞা করতেই পারেন। তারপরেও কিন্তু সংজ্ঞানুযায়ী তাঁকে নাস্তিক বলা যায়না যদিনা তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। আবার আপনি ধর্মবিশ্বাসী হলেও নাস্তিক হতে পারেন। বৌদ্ধধর্মে স্রষ্টার কোন অস্তিত্ব নেই।
গৌতম বুদ্ধকে তাঁর শীষ্যরা ঈশ্বর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, " ঈশ্বর থাকতেও পারেন, নাও থাকতে পারেন। তবে নির্বাণ লাভের জন্য ঈশ্বর আবশ্যক নন। মানুষ কেবলমাত্র ইচ্ছাকে নিজের বশে এনে নির্বাণ লাভ করতে পারে। " এখানে মুক্তিলাভের জন্য ঈশ্বরের কোনরূপ ভূমিকাকে অস্বীকার করে আমার মনে হয় আদৌতে তিনি ঈশ্বরকেই অস্বীকার করেছেন। তাঁকে চূড়ান্তরূপে অবজ্ঞা করেছেন।
এতদসত্ত্বেও বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের তেমন একটা নাস্তিক বলতে শুনা যায়না। এর কারণ সম্ভবতো তাঁরা কিছু আচার আচরণ পালন করেন। মানুষ তাঁদের এ আচার আচরণকেই ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তাঁর মনোজাগতিক বাসনাকে নয়। তবে মানুষের ধারণা যাই হোকনা কেন আস্তিকতা বা নাস্তিকতা যে শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাসকেন্দ্রিক নয় তা আমার প্রারম্ভিক আলোচনায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি বলে আমার বিশ্বাস।
নাস্তিকতা বা আস্তিকতা পুরোপুরি ধর্মকেন্দ্রিক না হলেও এ দু'য়ের সম্পর্কের অন্যতম প্রভাবক হিসেবে ধর্মকে কোন অবস্থায়ই অস্বীকার করা যায়না।
বরং বর্তমান অবস্থায় ধর্মই এ দুটো বিশ্বাস বা জীবনব্যবস্থাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে। এবং এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে এ দু'য়ের সম্পর্ক মোটেও স্বস্তির নয়। এটা যেহেতু আত্মসমালোচনামূলক একটি লেখা তাই এ অস্বস্তির পিছনে ধর্ম বা আস্তিক সম্প্রদায় কি ভূমিকা রাখছে সে আলোচনায় যাবনা। বরং একজন নাস্তিক এ অস্বস্তির উত্তরণে কি ভূমিকা রাখতে পারে সেদিকেই মনোযোগ দিব।
প্রায় নাস্তিকতার কাছাকাছি বলে স্বীকৃত বৌদ্ধধর্মের অনুসারীরা বছরের পর বছর ধরে অন্য ধর্মের লোকদের সাথে মোটামুটি ঝামেলা ছাড়াই বসবাস করে আসছে।
আড়াই হাজার বছর ধরে চলমান এ ধর্মটির অনুসারীদের সাথে অন্য ধর্মের অনুসারীদের সংঘর্ষের তেমন ঘটনা নেই। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা থাকলেও তা তাঁদের উপর চাপিয়ে দেয়া। তবে আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের সাথে তুলনা করলে এগুলোকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপনের কোন সুযোগ নেই। বড়জোর ব্যতিক্রম হিসেবে ধরে নেয়া যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মোটামুটি নাস্তিক বলে পরিচিত বৌদ্ধধর্মের অনুসারীরা গতানুগতিক আস্তিকতার ধ্বজাধারী ধর্মালম্বীদের সাথে মিলেমিশে থাকতে পারলেও আধূনীক নাস্তিকরা গতানুগতিক আস্তিকদের সাথে সে সম্পর্ক স্থাপনে কেন ব্যর্থ হচ্ছে।
আমি জানি এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের আচরণ বা ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের যথেষ্ট সুযোগ আছে। এটাও জানি যে, উত্থাপিত প্রশ্নগুলো মোটেও অসত্য বা ভিত্তিহীন নয়। তবে এটাও বিশ্বাস করি যে এখানে নাস্তিকদেরও আত্মসমালোচনা বা দায়িত্বপালনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
প্রতিপক্ষের কাছ হতে যতই উস্কানী আসুক না কেন দু'পক্ষের সম্পর্কটা স্বাভাবিক বা উষ্ণ রাখার জন্য অপেক্ষাকৃত উদার মনোভাবের দাবিদার নাস্তিকদেরই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। এখানে যেটা মনে রাখা দরকার তাহলো নাস্তিকতা রুখবে ধর্মীয় অনাচারকে, ধর্মীয় আচরণকে নয়।
এবং এ রুখার বহিঃপ্রকাশটা এমন হতে হবে যাতে সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারে এ প্রচেষ্টা আসলে তাঁদের মঙ্গলের জন্যে, দমনের জন্যে অবশ্যই নয়। সার্বিকঅর্থে একজন ব্যক্তি যাতে তাঁর স্বাভাবিক ধর্মীয় আচার-আচরণ তাঁর মনের মতো করে পালন করতে পারে তাঁর নিশ্চয়তা বিধান করার দায়িত্ব উদারতাবাদে বিশ্বাসী নাস্তিক সম্প্রদায়েরই।
গৌতম বুদ্ধ মানুষকে অন্তর্মুখী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি একজন নাস্তিককে অবশ্যই অন্তর্মুখী হতে হবে। নাস্তিকতার চর্চাক্ষেত্র ব্যক্তি নিজে।
তাঁর জবাবদিহিতাও তাঁর নিজের কাছে। ব্যক্তির নিজেকেই তাঁর উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে হবে। অবিরত চর্চা বা জবাবদিহিতার মাধ্যমে তাঁকে যেতে হবে উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে, শুদ্ধিতার দিকে। এ উন্নতি বা শুদ্ধিতা আত্মার, ব্যক্তির নিজস্ব। এর কোন দল নেই, গোষ্ঠী নেই।
এর প্রচার নেই, প্রসার নেই। তবে এ শুদ্ধিতা ব্যক্তি পর্যায়ে অর্জিত হলেও বা ব্যক্তির একার হলেও এর ফলভোগ করবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসহ তাঁর সংশ্লিষ্ট সবাই।
ইদানিং অনেকেই নাস্তিক সম্প্রদায়কে সংগঠিত করে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মতোই একটি গোষ্ঠী বা দলের ছকে ফেলার চেষ্টা করেন। মতৈক্য তৈরীর প্রচেষ্টা নেন। আমি নিশ্চিত এটা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
কারণ ধর্মের উৎপত্তি বা মুলবিন্দু এক জায়গায়। এর অনুসারীরা একে কেন্দ্র করেই সদা ঘুর্ণায়মান। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মাঝে একটি একাত্ম বা দলের সৃষ্টি হয়। কিন্তু নাস্তিকতার কোন মুলবিন্দু নেই। একেক ব্যক্তি একেক অভিজ্ঞতার কারণে নাস্তিকতার দিকে ধাবিত হন।
সে কারণে এটাকে গোষ্ঠীর ছকে না ফেলে ব্যক্তিপর্যায়েই ছেড়ে দেয়া উত্তম।
নাস্তিকতার উৎপত্তির অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্যক্তিপর্যায়ে যতোই ভিন্নতা থাকুক না কেন এর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য নিয়ে কোন মতানৈক্য বা ভিন্নতা সৃষ্টির সুযোগ নেই। নাস্তিকতার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে নৈতিকতার চূড়ান্তসীমায় আরোহন। নৈতিকতা বিবর্জিত নাস্তিক ধর্মান্ধ মৌলবাদীর চেয়েও ভয়ংকর। তাঁর হাতে কেউ নিরাপদ নয়।
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে একজন ব্যক্তির পক্ষে কতোটা নৈতিক হওয়া সম্ভব। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের ত্বত্ত্ব বা সূত্রগুলো একটি চরম বা পরম অবস্থাকে কল্পনা করে তৈরী হয়। বাস্তব অবস্থায় আপনি কখনই এগুলোর প্রতিফলন দেখবেন না। মানুষ কখনই দার্শনীক রাজা, আদর্শ রাষ্ট্র বা আদর্শ সমাজের দেখা পায়নি। তারপরেও প্রচেষ্টা থাকে এগুলোকে লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিয়ে এগুলোর কাছাকাছি অবস্থান করার।
ঠিক তেমনি নাস্তিকের নৈতিকতা হয়তো চরম মানের কাছে যাবেনা। তারপরেও তাঁর অবস্থানটা যাতে মূলবিন্দুর কাছাকাছি থাকে সেরকম একটা প্রচেষ্টা সবসময়ই নিজের মধ্যে থাকা উচিত।
সাম্প্রতিক সময়ে নাস্তিক বা নাস্তিকতার বিরুদ্ধে একটি জনপ্রিয় অভিযোগ হচ্ছে, নাস্তিকতা হচ্ছে আসলে নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবে উপস্থাপন বা স্মার্টনেস প্রকাশের একটি চেষ্টা। অভিযোগটি অন্তত আমাদের দেশের সাপেক্ষে অবান্তর। আমাদের সমাজে এখনও নাস্তিকদের অভিশপ্ত বা শয়তানের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
তাঁদের জীবন এবং চলাফেরা কোন রকমেই নিরাপদ নয়। বিশ্ববিদালয়ের হাই-প্রোফাইল শিক্ষক বা স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক ব্যতিরেকে অন্য কেউ ঘোষণা দিয়ে নিজেকে অবিশ্বাসী হিসেবে পরিচিত করবেন এমন সামাজিক সহনশীলতা বা নিরাপত্তা বলয় আমরা এখনও সৃষ্টি করতে পারিনি। সত্যি বলতে ধারেকাছেও যেতে পারিনি। কাজেই বিষয়টি স্পষ্ট যে, নাস্তিকতা প্রকাশের মাধ্যমে ব্যক্তির কোন লাভের সম্ভাবনাতো নেইই, বরং ক্ষতির আশংকাটাই প্রবল। বরঞ্চ বলা যায় যে পক্ষের নিকট হতে এ অভিযোগগুলো আসে তাঁরা নিজেরাই এ সমস্যায় জর্জরিত।
সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে ভাল সাজার জন্য বা সুবিধা নেয়ার জন্য ধর্মচর্চা করেন এমন লোকের সংখ্যাই এখন বেশি। লোকদেখানোর জন্য নামাজ পড়া, যাকাত দেয়া, হজ্ব করাটা আমাদের দেশে এখন বাতিকে পরিনত হয়েছে। নির্বাচনের আগে এ প্রবনতাটা আরো বেশি দেখা যায়। ধর্মের মাধ্যমে স্মার্ট সাজা বা সুবিধা নেয়ার চিরায়ত সংস্কৃতিটা আরো বেশি বেগবান হয় যখন তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরাও ভোটের রাজনীতির জন্য নিজেদেরকে ধর্মের মোড়কে আবৃত করেন। এনিয়ে আলোচনাটা আরো বিস্তৃত করা যেতে পারত।
কিন্তু যেহেতু লেখাটা আত্মসমালোচনামূলক তাই এ সংক্রান্ত আলোচনাটা আর বিস্তৃত না করাই প্রাসঙ্গিক। তবে 'নাস্তিকতা স্মার্টনেসের বহিঃপ্রকাশ' এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে নাস্তিকদের আত্ম-সমালোচনা বা আত্ম-পরিচর্যার কোন সুযোগ আছে বলে আমি অন্তত মনে করিনা।
চূড়ান্তঅর্থে আমি নাস্তিকতাকে একটি ধর্ম হিসেবে দেখতে চাই। আমি চাই প্রচলিত ধর্মগুলোর মতো নাস্তিক ধর্মেরও একজন ঈশ্বর থাকবেন, একজন প্রবর্তক থাকবেন। এক্ষেত্রে নাস্তিকের ঈশ্বর বা প্রবর্তক নাস্তিক স্বয়ং।
প্রচলিত ধর্মগুলোর অনুসারীরা যেমন ঈশ্বরের ভয়ে বা প্রবর্তকের বিধান অনুসারে নিজেদের শুদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা নেয় তেমনি নাস্তিককেও তাঁর ঈশ্বরের নির্দেশে বা প্রবর্তকের বিধান অনুসারে নিজেকে শুদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা নিতে হবে। একজন মানুষ যখন নিজেকে নিজের ঈশ্বরে পরিনত করতে পারবেন এবং নিজের কাছে নিজের জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন ঠিক তখনই তিনি সত্যিকারের নাস্তিক। এর ঠিক আগ-মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি নিঃসন্দেহে অপরিপক্ক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।