শুদ্ধতার আগুনে যেন সতত পুড়ি
ঘরে ফিরতেই দেখি পিলু মুখ ভার করে বসে আছে। সে আমার দু বছরের ছোট। তার হাজবেন্ড ইকবাল কিছুদিন হলো নাইজেরিয়া গেছে চাকরি নিয়ে। তারপর সে এখানেই থাকছে। বলি, কিরে পিলুপিল্লানি, কি হয়েছে?
পিলু গোমড়া মুখে জানালো কিছু হয়নি।
তাহলে মুখ অমন প্যাঁচার মত কেন?
সে কাথার জবাব না দিয়ে সে বললো, আলম ভাই নাকি আঁখিকে বিয়ে করেছে।
মাথাটা ভারী বোধ হলেও আমি না হেসে পারি না। বলি, আলম ভাই বিয়ে করেছে তো কি হলো? যাকে বিয়ে করেছে সেও তো আমাদের ভাবি হবে। হয়তো কোনো একদিন সেও মুখ কালো করে বলবে, তোদের সঙ্গে কি আমাদের সম্পর্ক রাখতেই হবে?
পিলু বললো, বউ-বাচ্চাকাচ্চা আছে এমন লোক বুড়ো বয়সে বিয়ে করলে আশপাশের মানুষ কি বলবে?
মানুষ কোন কাজটা ভালো বলে বল? তুই যে এখানে আছিস দেখবি ক’দিন পর শুনবি তুই বউ হিসেবে খারাপ বলেই বাপের বাড়ি পড়ে আছিস।
পিলু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, মানুষ বলবে না তুই বলবি? ঠিক আছে আমি এখানে থাকলে যদি তোদের খারাপ লাগে তাহলে আজই চলে যাচ্ছি!
পিলু সত্যি সত্যিই তার ব্যাগ গোছাতে আরম্ভ করলো।
মাথাটা আরো ভারী মনে হচ্ছিলো। আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। অসময়ে শুয়ে থাকাটা মা পছন্দ করেন না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তিনি এসে আমাকে শুয়ে থাকতে দেখেও এ ব্যাপারে কিছু বললেন না। বললেন, পিলুকে কি বলেছিস?
কি বলবো? তেমন কিছু বলিনি তো!
তাহলে ও ব্যাগ গোছাচ্ছে কেন?
হুম।
তাহলে আমার ওপর রাগ করেছে হয়তো।
কি বলেছিস তুই?
আমি বিছানায় উঠে বসি। জ্বর এসে গেছে। বেশ শীত শীত মনে হচ্ছে। তবু বলি, পিল্লানিকে বললাম, কদিন পর লোকে বলবে বউ হিসেবে খারাপ বলেই তুই বাপের বাড়ি পড়ে আছিস।
এর বেশি তো কিছু বলিনি!
ও এখানে পড়ে থাকলে তোর অসুবিধা কোথায়? নাকি তোরটা খাবে?
মাও রেগে গেলেন? আমি আর কিছু বলি না। আবার শুয়ে পড়লে তিনি বললেন, যেভাবে পারিস ওকে থামা!
বললাম, আচ্ছা।
তারপরই আমি পিলুকে ডাকি। পিল্লানি! অ্যাই পিল্লানি!
মা তখনই সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পিলুকে ডাকার সময় মাথার ভেতরটা কেমন যেন ঝনঝন করছিলো।
আমি অপেক্ষা করি। কিছুটা সময় নিয়ে সে আসে। দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, কেন ডাকছিস?
হয়তো কেঁদেছে। মুখটা আরো ভারভার মনে হচ্ছে। বলি, থার্মোমিটারটা কোথায় দেখতো! আমার মনে হয় জ্বর উঠেছে।
পিলু এগিয়ে এসে আমার কপালে হাত দিয়ে বললো, সত্যিই তো জ্বর! কোনো অষুধ খেয়েছিস?
প্যরাসিটামল খেয়েছিলাম।
দেখি অন্য কোনো অষুধ আছে কি না।
বলি, লাগবে না। তুই কি আমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারবি? চা খেলেই মনে হয় জ্বরটা চলে যাবে।
পিলু হয়তো চা বানাতে যায়।
তার হাতের রঙ চা খুবই ভালো হয়। আমি জানি পিলুর অভিমান চা বানাতে বানাতেই চলে যাবে। ভুলে যাবে ব্যাগ গোছানোর কথা। হয়তো ব্যাগটা তেমনিই পড়ে থাকবে তার বিছানায়। কেন সেটা বিছানায় তাও হয়তো পরে মনে করতে পারবে না।
এমনিতে পিলু খুবই ভালো মেয়ে। মনটাও ভালো। মনের ভেতর একটা রেখে মুখে অন্যটা বলতে কখনোই শুনিনি। দুজন দুই ইয়ারের ব্যবধানে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় একবার পিলু এসে বললো, ভাইয়া, তুই কি পিস্তল দেখেছিস?
হঠাৎ পিস্তলের প্রসঙ্গ শুনে চমকে উঠলেও বলি, সিনেমায় দেখেছি।
হাতে পেলে গুলি চালাতে পারবি?
তা হয়তো পারবো।
মাসুদ রানা সিরিজের অনেক বইতে কিভাবে পিস্তল লোড করতে হয়। সেফটি ক্যাচ অফ করে গুলি চালাতে হয় তার পরিষ্কার বর্ণনা আছে। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।
তাহলে আমার সঙ্গে কাল তুই যাবি। ওকে আমার সামনে গুলি করবি।
পারবি না?
কেন পারবো না? মানুষটা যদি তোর শত্র“ হয় আর তোর কোনো ক্ষতি করে থাকে তাকে কুকুরের মত গুলি করে মারতে আমার হাত একটুও কাঁপবে না।
পরদিন আমার ক্লাসের দরজায় এসে পিলু আমাকে ডাকতেই বেরিয়ে যাই। ক্যান্টিনের আড়ালে নিয়ে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে সত্যি সত্যিই একটি কালো রঙের পিস্তল বের করে আমার হাতে দিতেই ভয়ে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলেও বললাম, কাকে গুলি করতে হবে?
সে মুখ চোখের ভাব কঠিন করে জানালো, ইকবালকে।
কেন?
ওর মত খারাপ চরিত্রের লোকদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। বেঁচে থাকলে দিন দিন ওরা আমাদের সমাজটাকে আরো নোংরা কেরে ফেলবে।
পিস্তল হাতে আমি ভাবতে থাকি। এখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ভালো না। চারদিকে পুলিশ পাহারা। যে কোনো সময় যে কোনো কাউকেই পুলিশের লোকেরা ডাক দিয়ে শরীর অথবা ব্যাগ তল্লাশী করছে। অথচ এমন একটি নাজুক সময়ে পিলু পিস্তল পেলো কোথায়? সঙ্গে সঙ্গেই সেটাকে পেটের কাছে প্যান্টের ভেতর লুকিয়ে ফেললাম।
কিন্তু যতদূর জানি ইকবালের সঙ্গে পিলুর সম্পর্ক খুবই ভালো। প্রেমের সম্পর্ক। কিন্তু কী এমন কারণ ঘটলো যে, ইকবালকে ও খুন করানোর মত নোংরা কাজ করতে চায়? বলি, তুই এখানে না দাঁড়িয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে চা-সিঙ্গাড়া খা। ইকবালকে ঠিক মাথায় গুলি করেই আমি বাসায় চলে যাবো।
পিলুকে ক্যান্টিনে পাঠিয়ে দিয়ে পিস্তলটা আমি সেখানেই ড্রেনের পাশে লুকিয়ে রাখি।
তারপর ছুটে যাই ইকবালের কাছে। বলি, সত্যি করে বল পিলুর সঙ্গে তোর সমস্যাটা কি?
ইকবাল পারলে কেঁদে ফেলে এমনভাবে বললো, আমার কাজিনের সঙ্গে এক রিকশায় দেখতে পেয়েই ক্ষেপে গেছে। আমি ওকে যতই বোঝাই যে, রুমঝুম আপু আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়! তা ছাড়াও তার স্বামী-বাচ্চাকাচ্চা আছে। আমার মনে তেমন কিছু থাকলে তার কাছে নিশ্চয়ই গোপন করতাম! কিন্তু কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। কাল থেকে ও আমাকে খুন করাতে লোক খুঁজছে।
ও তো কোত্থেকে যেন সত্যি সত্যিই একটি পিস্তল যোগাড় করে আমাকে দিয়েছে তোকে খুন করতে।
ইকবাল গোমড়া মুখে বললো, আদনান বলেছে। ওটা জার্মানির তৈরী খেলনা পিস্তল হলেও মারাত্মক!
খেলনা পিস্তল?
ইকবাল মাথা নেড়ে জানিয়েছিলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই আমার যাবতীয় উদ্বেগ বিদায় নিয়েছিলো। তার কিছুক্ষণ পরই ক্যাম্পাসে চাউর হয়ে গিয়েছিলো, ইকবালকে কে যেন গুলি করেছে।
পিলু পাগলের মত দৌঁড়ে এলো। আমাকে ডিপার্টমেন্টের সামনে দেখতে পেয়েই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্না জুড়ে দিয়ে বলেছিলো, এটা তুই কি করলি ভাইয়া?
বললাম, তুই তো বললি?
আমি রাগের মাথায় কি করেছি তুই কেন বুঝতে পারলি না!
তুই কি ইকবালকে বিয়ে করতি?
ওকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না!
পিলুর কান্না দেখে কখন আমিও কাঁদতে থাকি বুঝতে পারি না। আমার সহপাঠিরা সবাই চারদিক গোল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ভেজা চোখে মুহিবকে বললাম, একটু কষ্ট কর না দোস্ত! ইকবাল কোথায় আছে দেখবি?
কিছুক্ষণ পর ইকবাল আসতেই পিলু কান্না ভুলে আঁচল কামড়ে ধরেছিলো। আর আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো, ভাইয়া তুই কেন কাঁদছিস?
আমার মনের ভেতর হঠাৎ করে জমে ওঠা যাবতীয় কষ্ট মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়।
বললাম, ইকবাল আর পিলুর আজই বিয়ে দেবো।
সবাই হাত তালি দিয়ে উঠেছিলো। এ উপলক্ষে সবাই মিলে ছোটখাট একটা পার্টির আয়োজনও করে ফেলেছিলো।
তারপর ইকবাল সহ ঘরে ফিরে পিলুকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বলেছিলাম, তোর কথা মত সত্যিই যদি ওকে গুলি করতাম, তুই কি আমাকে ক্ষমা করতে পারতি?
পিলু আমার একটি হাত টেনে নিয়ে গালে লাগিয়ে বলেছিলো, তুই খুবই ভালো রে ভাইয়া!
আমার বুকটা ফের আনন্দে ভরে উঠেছিলো। আর কিছু না পারি পিলুকে মনে হয় সুখি হওয়ার পথে খানিকটা এগিয়ে দিতে পেরেছি।
পিলু তেমন ভাবেই আবার বলেছিলো, ভবিষ্যতে আমি এমন কিছু বললে তুই আর শুনিস না!
কিন্তু পিলুর বিয়ে নিয়ে ক্ষেপে উঠেছিলেন বাবা। ইকবাল আর পিলুর সামনেই পায়ের স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে বলেছিলেন, মেয়ের জন্য আমি ডাক্তার ছেলে ঠিক করেছি আর তুই কিনা বিয়ে দিয়েছিস তোর মত আরেকটার সঙ্গে?
তারপর হাতের স্যান্ডেল দিয়ে মারতে মারতে আমাকে ঘরের বাইরে বের করে দিয়েছিলেন। দু’দিন দরজার সামনে বাইরের দেয়ালে হেলান দিয়ে কাটিয়েছি। পিলু আর মা যথারীতি আমাকে তিনবেলা খাবার ঠিকই দিয়েছে। তৃতীয় দিন বাবা আমাকে ঘরে ফিরিয়ে নিলেও অনেকদিন পিলু আর ইকবালের বিয়েটাকে মেনে নিতে পারেননি।
পিলু চা আর দুটো ট্যাবলেট নিয়ে ফিরে এসে আমার পাশে বসে বললো, তোর কি মাথা ব্যথা আছে? টিপে দেবো?
টিপতে হবে না। কেমন যেন ভারী হয়ে আছে।
ট্যাবলেট খেয়ে চা খেতে খেতে আমি তাকে ইকবালের কথা জিজ্ঞেস করি।
পিলু জানায়, ইকবাল নাকি ওকেও সেখানে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু সে নাকি মানা করে দিয়েছে।
আমি অবাক হয়ে বলি, বোকা মেয়ে মানা করেছিস কেন?
পিলু আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, তোদের না দেখলে আমি কোথাও গিয়ে থাকতে পারবো না!
তুই তো দেখছি আসলেই গাধা! আমাদের তো তুই ইন্টারনেটেই দেখতে পাবি। ইন্টারনেটে বিভিন্ন ম্যাসেঞ্জারে এ সুযোগ আছে। তা ছাড়া শুনেছি সেল ফোনেও নাকি ভিডিও কলের সুবিধা আছে। তুই গিয়ে তেমন একটা সেট পাঠিয়ে দিলেই তো হতো!
পিলু আঙুলের মাথায় আঁচল জড়িয়ে বললো, তাহলে কি ওকে আবার বলবো ব্যবস্থা করতে?
কেন বলবি না?
মানা করে দিয়ে কি করে আবার বলবো? আমার লজ্জা লাগবে।
তোকে বলতে হবে না।
যা বলার আমিই বলবো। যদিও ইকবাল আমাকে এখনও কিছু জানায়নি। হয়তো ব্যাপারটা নিয়ে কেবলই ভাবতে আরম্ভ করেছে। আর তাই জানিয়েছে পিলুকে।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।