ইমরোজ
আজ সকালে অফিসে ডাক পড়েছে সকাল আটটার সময়। সংবাদ মাধ্যমে কাজ করি। বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার রায় দিবে। সব সংবাদকর্মী আজ ব্যাস্ত। দেশে একটি মাত্র খবর।
প্রত্যেকটি চ্যানেলের লাইভ। এমনকি দিগন্তেও।
তখন বাজে ঠিক পৌণে এগারটা। আমি অফিসে বসে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। এমন সময় মনে হলো চা বিড়ি খাওয়া দরকার।
নিচে নামতে যাবো এমন সময় আমার কলিগ এক সময়ের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে ছাত্রদল নেতা, মুক্তা ভাই আমাকে বললেন, এখন বাইরে যাইস না। এখনই রায় হবে। রায়ের সময়টা টেলিভিশনের সামনে থাক। এটা একটা ঐতিহাসিক মুহুর্ত।
ভারত থেকে একজন কন্সালটেন্ট এসেছিলেন আমাদের ট্রেনিং দিতে।
তিনিও আমাদের সাথে যোগ দিলেন। পুরো অফিস টেলিভিশনের সামনে। একটিতে চ্যানেল আই, একটিতে দিগন্ত ও আরেকটিতে এনটিভি। উদ্গ্রীব হয়ে আছি আমরা। গোটা জাতি।
মুক্তা ভাই আমাকে বললেন, দেরি করিসনা। এক্ষনি বের হয়ে যা, নাহলে পরে কিছুই পাবি না। একজন ক্যামেরা ম্যানকে সাথে নিয়ে হাতে মাইক্রোফোন (টেলিভিশনের ভাষায় যাকে বুম বলে)। প্রথমে গেলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। সেখানে দেখি নেতাকর্মীদের ভিড়।
স্লোগান দিচ্ছে লোকজন। ব্যানারে ব্যানারে লেখা, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাসি চাই দিতে হবে।
ঠিক ঐ মুহুর্তে রায় এলো। হুল্লোড় করে উঠলো সমস্ত লোকজন। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হলো বঙ্গবন্ধুর সেই বাসভবন।
যেখানে তিনি সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন। বাঙ্গালী হারিয়েছিল তাদের পিতাকে।
এমন সময় উল্লোসিত কতকজন নেতা কর্মীর ভাষ্য নিলাম। চ্যানেল ওয়ানের এক রিপোর্টার আমাকে বললেন, ধানমন্ডি ৩ নং এ আওয়ামীলীগের অফিসে পার্টি থেকে আনুষ্ঠানিক অভিব্যাক্তি জানানো হবে। তখন আমাদের ইউনিটটির সাথে গাড়ি ছিল না।
সাথে সাথে বের হয়ে গেলাম গাড়ি ছাড়াই। দেরি করা যাবে না। আমাদের নিউজ দরকার।
রিক্সায় উঠে গেলাম। টেলিফোনে অফিসকে ইনফর্ম করে দিলাম।
আওয়ামীলীগ অফিসে গিয়ে অনেক ক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে হলো। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এলেন দুপুর দেড়টার সময়। এসে সাংবাদিকদের বললেন, বক্তব্য দিতে আরও এক ঘন্টা সময় লাগবে।
কি আর করার। অফিসের আসেপাশে ঘোরাফেরা করতে লাগলাম।
এমন সময় সাংবাদিকদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হলো। খাওয়া দাওয়ার পরপরই শুরু হলো ব্রিফিং। তার ঠিক আগে আগে বিএনপি নেতা সাবেক আইন মন্ত্রী মওদুদের কথা টেলিভিশনের নিজ স্ক্রোলে দেখতে পেলাম। সেটা নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে ঈষৎ আলোচনাও করলাম। বিএনপি ব্যাপারটিকে এত পজেটিভলি নিবে সেটা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল!
আশরাফুল ইসলাম যে লিখিত বক্তব্য পাঠ করলেন তার কিয়োদংশ এরকম,
"আজকের এই দিনে আমি স্মরণ করছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে সকল মানুষকে নির্মম ভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
স্মরণ করছি সেই চার নেতাকে যাদের অবদানে দেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল। ১৯৭৫ সালের পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যত সরকারই দেশের শাসনভার নিয়েছে, কেউই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের কাজ করেননি। জিয়ার সরকার, খালেদা এরশাদের সরকার এবং খালেদা জিয়ার সরকার এই হত্যাকারীদের বিচার করেনি। জিয়ার সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরকে বিদেশে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইন্ডেমনিটি করা হয় যার ফলে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর এরশাদ এই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেননি। খালেদা জিয়ার সরকার ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ১৯৯৬ সালের অক্টোবর পাশে সংসদের মাধ্যমে ইনডেমনিটি বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের পথ সুগম হয়। এরপরের ইতিহাস আপনারা সকলেই জানেন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার আবার ক্ষমতায় আসে।
বিএনপি সরকারের আমলে এই মামলার রায় কয়েকবার পিছিয়েছে এবং ইতিহাসের প্রথম সর্বোচ্চ সংখ্যক বিচারপতি বিব্রত বোধ করেছেন। ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিনের সরকার দেশে এসে, তারাও মামলা নিয়ে কোন কাজ করেননি। ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে। সরকার গঠন করার আগে আমরা ম্যানিফেস্টোতে বলেছিলাম, বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতাসহ যে সকল হত্যাকান্ড হয়েছিল, আমরা তার বিচার করব। এই রায়ের মাধ্যমে আমাদের পথ সুগম হলো।
এর মাধ্যমে দেশ কলঙ্কমুক্ত হলো এবং ৩৪ বছর পর সুষ্ঠ পক্রিয়ায় বিচার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। আমরা দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল করি নাই। কারণ শেখ হাসিনা প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। তিনি একটি সুষ্ঠ বিচার চেয়েছিলেন। যেটার জন্য পুরো জাতিও অধীর অপেক্ষা করেছে সুদীর্ঘ ৩৪টি বছর।
১৯৭৫ সালের যে সকল ঘাতকেরা বিদেশে লুকিয়ে আছে অচিরেই তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করছি। চার নেতার হত্যার বিচারও হবে। আমরা আশা করব, আমাদের নেতাকর্মীরা কোন আনন্দ মিছিল করবে না। কোনরকম উল্লাস করবে না।
কারণ এখানে উল্লাস করার কিছু নেই। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আর তো ফিরে পাব না। তবু তাঁর হত্যার বিচারের মাধ্যমে আমরা স্বস্তি পেলাম। এর অনেক দরকার ছিল। এটা একটা উদাহরণ।
কেননা যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, তারা স্বগর্বে তা ঘোষণা করে, তারা ভেবেছিল তাদের ধরা ছোয়া যাবে না। কিন্তু আজ প্রমাণিত হলো যে খুনী যত শক্তিশালীই হোক না কেন আইনের উর্ধ্বে কেউ নয়। অন্যায় করলে তার বিচার হবেই। আমরা আশা করব এই হত্যাকান্ডের বিচারের রায় অতিদ্রুত কার্য্যকর হবে। সবাইকে ধন্যবাদ।
"
এইছিল মোটামুটিভাবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য। বক্তব্যের পরে আমরা সেখান থেকে বের হলাম। অফিসে গেলাম। ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দিয়ে খবর তৈরী করলাম। মনে হলো এক বিশাল ইতিহাসের সাথে অনায়াসে জড়িয়ে গেছি।
এইভাবেই কেটেছে আজকের গোটা দিনটি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।