শুদ্ধতার আগুনে যেন সতত পুড়ি
একটি পোস্টের জন্য ইন্টারভিউ দিতে অনেক লোক এসেছে। এক কোণে বাসে দেখা গয়না হারানো মহিলাটিকেও মনে হয় দেখতে পেলাম। কেন যে আমার মনে হচ্ছিলো সে আমাকে দেখতে পেয়েই খানিকটা ঝুঁকে আড়াল নিয়েছে। আমিও সেদিকে তাকানোর কৌতুহল দেখাই না।
এগারো নম্বরে আমার ডাক পড়তেই আমি দরজা ঠেলে ঢুকি।
একটিমাত্র টেবিলে একজন লোক বসা। দেখতেও তেমন কেউকেটা গোছের বলে মনে হয় না। তাই আমি কিছুটা অবহেলা করেই এগিয়ে যাই। আগের ইন্টারভিউ বোর্ড ফেস করার মত বিনয়ের অবতার সাজতে ইচ্ছে করলো না।
টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটি বলে উঠলো, আপনি যে জন্মসূত্রে বাঙালী তা আপনার বায়োডাটাতেই আছে।
ধর্মের দিক দিয়েও দেখছি মুসলিম। আমাদের দেশটাও মুসলিম দেশ। কিন্তু আপনি সালাম দিলেন না যে?
লোকটি এত কথা বললেও আমাকে বসতে বলেনি। হিসেব মত আগেই আমাকে বসতে বলার কথা। যেহেতু বসতে বলেনি, তাই দাঁড়িয়ে থেকেই বলি, মুসলমানের দেশ হলেও এ দেশে বিভিন্ন ধর্মের লোক আছে।
আর আপনি মুসলিম না নন মুসলিম কি করে জানবো? আপনার নাম কোথাও দেখিনি। তা ছাড়া ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি যে, নন মুসলিম কাউকে সালাম দেয়াটা ইসলামে বৈধ নয়।
লোকটির মুখ সঙ্গে সঙ্গেই কালো হয়ে গেল। যেন তেতো মুখেই বললেন, বসেন।
ধন্যবাদ জানিয়ে বসতেই তিনি বলতে আরম্ভ করলেন, যে দেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান স¤প্রদায়ের নাগরিক যথেষ্ট সংখ্যায় আছে তেমন একটি দেশ কী করে ইসলামী রাস্ট্র হয়?
হওয়া উচিত হয়তো নয়।
কিন্তু এরশাদ যখন সেক্যুলার থেকে ইসলামী রাস্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ঘোষনা দেন তখন কিন্তু নন-মুসলিম কেউ প্রতিবাদ করেননি। মিটিং-মিছিল-জ্বালাও-পোড়াও ধরনের আন্দোলনও করেননি। মাত্র কয়েক মাস আগেই যেমন একটি বিড়ালের সঙ্গে মোহাম্মদ শব্দটা জড়িয়ে দেশি মোল্লারা বিশ্ববাসীকে যা দেখালো, বাংলাদেশের খৎনা করানো দেখেও অন্যান্য ধর্মের পুরোহিতরা কেন তার সিকিও পারলো না? এমনকি মন্ত্রীসভায় অমুসলিম মন্ত্রী থাকলেও কেউ তার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন বলে জানি না। জানি না নন-মুসলিম কোনো সরকারি আমলাও পদত্যাগ করেছেন বা এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন। কেবল বিভিন্ন পত্রিকায় এ নিয়ে কিছুটা লেখালেখি হয়েছে।
পরিণতিতে আমরা কি দেখলাম? দেখলাম নন-মুসলিমরা মিলে একটি ঐক্যপরিষদ বানিয়েছেন। আমি যার কোনোটাই সমর্থন করি না।
কেন করেন না? নন-মুসলিমদের কি সে অধিকার নেই?
এখন আর নেই। কারণ রাস্ট্রের যখন খৎনা করানো হয়েছিলো সেটা যেমন নন-মুসলিমরা মেনে নিয়েছেন তেমনি ইসলামী রাস্ট্রের খাঁটি নাগরিক হতে তাদেরও উচিত ছিলো নিজেদের খৎনা করিয়ে মুসলমান হয়ে যাওয়া।
আমার কথা শুনে ভদ্রলোকের মুখটা লাল হয়ে উঠলো।
আমি ধরেই নিয়েছি যে, চাকরি আমার হবে না। একটি চাকরির খাতিরে আমি যতটুকু জানি-বুঝি বা বিশ্বাস করি তা প্রকাশ থেকে কেন বিরত থাকবো? একজন নাগরিক হিসেবে রাস্ট্রীয় কোনো ব্যাপারে আমার ভালো-লাগা খারাপ লাগা বলতেই পারি! যদি তা না-ই বলতে পারি তাহলে এ গণতন্ত্রের নাম ভিন্ন কিছু রাখা উচিত। যে তন্ত্র আমার বলার অধিকার খর্ব করে। আমার বিশ্বাসবোধকে গুঁড়িয়ে দেয় সে তন্ত্র বোধ করি স্বৈরতন্ত্রের চেয়েও বেশি নোংরা!
ভদ্রলোক হয়তো ভেতরে ভেতরে এতটাই রেগে গেছেন যে, বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। হয়তো রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করছেন।
আমি চুপচাপ বসে থাকি। অফিসের ভেতরের আসবাব দেখি। কোণার দিকে একটি কাচের বাক্সে দেখতে পাই ধাতব নটরাজের মূর্তি। আজকাল অনেক মুসলমানের ঘরেই শো-কেসে বা টেবিলের উপর ফুলদানীর পাশাপাশি মাটির তৈরী নটরাজের মূর্তি সাজানো থাকে। কাজেই এমন ছোট্ট একটি নমুনা দেখেও অনুমান করতে পারি না যে লোকটি হিন্দু স¤প্রদায়ের কেউ।
এসব শাহবাগ-রমনাপার্ক এলাকায় আর নিউমার্কেটের কোথাও কোথাও বিক্রি হতে দেখেছি।
কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক হয়তো ধাতস্ত হয়ে বললেন, আপনি আসতে পারেন। আজ আর কিছু হবে না।
আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতেই বেশ ক’জন আমাকে ছেঁকে ধরে নানা রকম জেরা আরম্ভ করলো। এত সময় কেন লাগলো? কি কি জিজ্ঞেস করেছে? চাকরিটা কি আপনার হবে?
আমি বলি, তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করেনি।
আর এমন হাবিজাবি প্রশ্ন থেকেই অনুমান করা যায় যে চাকরি আগেই কাউকে দিয়ে রেখেছে। এখন কেবল আমাদের চোখে ধূলো দিতেই এ আয়োজন।
সবাইকে হতাশায় ডুবিয়ে দিয়ে আমি রাস্তায় নেমে আসি। এই প্রথমবার কোনো ইন্টারভিউ দিয়ে প্রসন্ন মনে বেরিয়ে এসেছি। ভদ্রলোক আমাকে কি ভাববেন কে জানে! কিন্তু যা বলতে চেয়েছি তা যে বেশ জোরেসোরেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পেরেছি সেটাই আমার ভালো লাগার কারণ বোধহয়।
রাস্তার পাশে একটি খোলা রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভাজি আর পরাটা দিয়ে নাস্তা করি। সকালের দিকে বোরোবার মুখে এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়েছিলাম কেবল। আটা ছিলো না বলে মা খিচুরি রান্না করেছেন। সকালের নাস্তায় আটার তৈরী কিছু না হলে আমার খেতে ভালো লাগে না।
নাস্তা সেরে এক কাপ চা খেতে খেতে ভাবছিলাম আর কোনো কাজ বাকি আছে কিনা।
না। তেমন কোনো কাজ নেই। কিন্তু এতটা পথ যেয়ে কি আবার আসবো? থাক। আজ আর কোনো কাজ নয়। সন্ধ্যার দিকে রাইসাকে পড়াতে যাওয়ার আগে আর ঘর থেকে বের হবো না।
তা ছাড়া ক্রমাগত নাক মুছতে গিয়ে নাকটা কেমন জ্বলছে। মাথাটাও ব্যথা করছে খুব। এখন কোথাও শুয়ে ঘুমোতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আজকাল ভবঘুরে লোকের সংখ্যা এতটাই বেড়ে গেছে যে পার্কের বা স্টেশনের কোনো বেঞ্চে বসারও জায়গা পাওয়া যায় না তেমন।
চা মুখে দিয়ে চুমুক দিচ্ছি এমন সময় টপ করে এক ফোঁটা সর্দি কাপের চায়ে পড়ে গেল।
এতটা পাতলা সর্দি খুবই খারাপ। কোনো ওষুধেই কাজ হবে না। এখন নিচের দিকে ঝুঁকে মাথা ধরে বসে থাকা ছাড়া পথ নেই। নাকের পানি যতক্ষণ ফোঁটা ফোঁটা পড়ার পরতে থাকুক। কিন্তু নোংরা আর ঘিঞ্জি এই ঢাকা শহরের কোথাও কি এভাবে বসার জায়গা আছে? এত নোংরা আর বিশ্রি শহর তবুও কেন যেন ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হয় না আমার।
আর সে কারণেই হয়তো আমার দুর্দশা কখনো দূর হবার নয়। নয়তো গ্রামাঞ্চলের কোনো কলেজে কাজ করতে পারলে হয়তো ভালোই হতো। কাশিয়ানী কলেজে ইংরেজির লেকচারার হিসেবে জয়েন করতে পারতাম। বাবা খুবই উৎসাহ দিয়েছিলেন। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবও পরপর তিনটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু আমার মনটাই কেন বেঁকে বসেছিলো সেটাই রহস্য। অথচ এখন মাঝে মধ্যে মনে হয় যে, সেখানে জয়েন না করে হয়তো ভুলই করেছি।
ঘরে ফিরতে ফিরতে আবার জ্বরই এসে যায় কিনা সে ভয়ই হচ্ছে। আজ চার তারিখ। টিউশানীর টাকা পাবার কথা।
যদিও এ পর্যন্ত কোনো হেরফের হয়নি তবুও এতটা নিশ্চিত হওয়া উচিত নয়। প্রত্যাশা বেশি থাকলে কষ্ট পাবারও সম্ভাবনা থাকে। আজকাল আমার ভেতর তেমন কোনো প্রত্যাশা আছে বলেও বুঝতে পারি না। শুনতে পাই প্রায় সাতান্ন বছর বয়সেও মেজ ভাই কোনো এক কলিগের সঙ্গে নাকি চুটিয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছেন। তাদের অন্যান্য কলিগরা ফোনে ভাবিকে জানায়।
হয়তো ঈর্ষা থেকেই তাদের এমন গোয়েন্দাগিরী। সব শুনে আলম ভাইকে প্রশ্ন করলে তিনি ভাবিকে জানান, মেয়ের সমান বয়সের কলিগের সঙ্গে কি এসব সম্পর্ক হয় নাকি? হয়তো ভাবির বিশ্বাস হয় না। মাঝেধ্যে তার চোখে পানি দেখতে পাই। হয়তো খুব বেশি কান্না-কাটির ফলে কখনো কখনো তার মুখও ফুলে থাকতে দেখি। তাদের ছেলে-মেয়ে দুটোও যেন কেমন উদাস হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত জায়গাটুকুর মাঝামাঝি কোনো অষুধের ফার্মেসি আছে বলে আমার চোখে পড়েনি। অন্তত প্যারাসিটামল পেতে হলেও আমাকে আগে শাহবাগ যেতে হবে। তা ছাড়া পান-সিগ্রেটের দোকানেও বয়মের ভেতর প্যারাসিটামল দেখেছি। কিন্তু এখন তেমন দোকানে প্যারাসিটামলও দেখতে পাচ্ছি না। দু একটিতে জিজ্ঞেস করেও পাইনি।
চা খেয়ে উঠে গ্লাসের পানি দিয়ে রুমালটাকে আবার ধুয়ে নেই। হাতটাও ধুয়ে ফেলি। তখনই সেখানকার একজন বলে ওঠে, ভাই অ্যামনে পানি ফালানের লাইগা তো পয়সা দিয়া পানি কিনা আনি না।
অন্যায় কিছু বলেনি। তবুও আমার কিছুটা পানি খরচ করার অধিকার আছে।
যেহেতু এখানেই আমি নাস্তা করেছি প্রায় পনের টাকার। সে তুলনায় এক গ্লাস পানি আর কত দাম? আগে মেঘনা আর দাউদকান্দি ফেরিঘাটে পানি বিক্রি হতো। দাম হিসেবে যে যা দেয়। নির্দিষ্ট কোনো রেট না থাকলেও পঁচিশ পয়সার নিচে দিলে ওদের মুখ কালো হয়ে যেতো।
ঝামেলা এড়াতে বলি, তা ঠিক।
কিন্তু এই এক গ্লাস অতিরিক্ত পানির জন্যই আমি এতটা দূর হেঁটে এসে নাস্তা করতে বসেছি।
লোকটি কেমন করে হাসে। হয়তো আপসের হাসি একেই বলে।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।