চলুন এক ফোঁটা চোখের জল ফেলে আসি
শ্যামল দত্ত
==================================
এটা ইতিহাসের এক মর্মান্তিক সত্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল এবং আরেক অনিবার্য সত্য হচ্ছে, সেই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচার আইন করে রুদ্ধ করা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডের এক মাস পরেই। ইতিহাসের নানা পথপরিক্রমাই আজ সেই হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর ৩ মাস ৯ দিন পর জাতি এক কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে মুক্ত হয়েছে।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর- এই দীর্ঘ সময় জাতির ওপর চেপে থাকা শ্বাসরুদ্ধকর এক ভারী পাথর সরে গেছে আজ। হেমন্তের সকালের শিশিরকণায় নতুন করে বাঁচার আশায় শ্বাস দীর্ঘদিন পাথরের নিচে চেপে থাকা এক বিশ্বাস, যে বিশ্বাস বলেছে একদিন বিচার হবে খুনিদের আজ এটা প্রমাণিত যে, সত্য কখনো চেপে রাখা যায় না। সত্য অন্ধকার নয়, আলোর মতোই স্পষ্ট।
শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের ইতিহাসের বর্বরতম এই হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছরের নানা সময়ে শুধু আইন করে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার র"দ্ধ করা হয়নি, খুনি মোশতাকের কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জাতীয় সংসদে আইনে পরিণত করেছে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সরকার। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনে এই আত্মস্বীকৃত খুনিদের চাকরি দিয়েছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান, তাদের সুযোগ-সুবিধা বহাল রেখেছেন ও আরো পুরস্কৃত করেছেন জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতাসীন আরেক স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ এবং ’৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর ভোটে নির্বাচিত খালেদা জিয়ার সরকার। ইতিহাসের কলঙ্কজনক ঘটনার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগী এই জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার। এই দায় এই তিন সরকারের কেউ এড়াতে পারে না। কারণ এই তিন সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী সরকার, হত্যাকারীদের পুনর্বাসিত করার সরকার, বিচার প্রক্রিয়াকে অবরুদ্ধ ও বিলম্বিত করার সরকার।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের দণ্ডিত করা হলো, কিন্তু ঘটনার নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। এই রায়ের পর এখন দায়িত্ব এসেছে সত্যানুসন্ধানের। খুঁজে বের করতে হবে নেপথ্যের নায়কদের, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীদের।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতার নামে জাতির জনক হত্যাকাণ্ডে বিচার কাজ শুর" করলেও প্রক্রিয়াটি শেষ করতে আজ সময় লেগেছে ১২ বছর। দীর্ঘ এই সময়ে বিব্রতবোধ ও বেঞ্চ গঠনের দীর্ঘসূত্রতার কৌশলে বিচার প্রক্রিয়া করা প্রলম্বিত।
আপিল বিভাগে বিচারের জন্য একটি বেঞ্চ গঠন করতে সময় লেগেছে প্রায় ৫ বছর। তারপরও জাতি অপেক্ষায় থেকেছে আজকের এই মাহেন্দ্রক্ষণের, কলঙ্কের অন্ধকার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সোনালি রোদ্দুরের অপেক্ষায়।
প্রিয় পিতা, আপনি আমাদের ক্ষমা করুন। এমন একটি দেশ, দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে পাওয়া এই দেশ, বীর শহীদদের রক্তে রন্জিত এক দেশ আপনি আমাদের দিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে আপনার নিজের হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩৪ বছর। তার পরও এটা নির্মম সত্য যে, নানা ষড়যন্ত্র ও কূটচালে আবদ্ধ করা যায়নি সত্যকে।
সত্য আজ আরো দৃঢ়, আরো প্রস্ফুটিত হেমন্তের সোনালি আলোয়। খুনিরা আজ ফাঁসিকাষ্ঠের মুখোমুখি। একদিন যারা দম্ভ করে বলেছিল, জাতির জনককে আমরা হত্যা করেছি, তার ১০ মাসের শিশু পুত্রকে হত্যা করেছি, তার ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূকে হত্যা করেছি, তাদের চোখের সামনে এখন ফাঁসির দড়ি। পিতা আমাদের ক্ষমা করুন, এই কাজটি করতে আপনার দুর্ভাগা দেশে সময় লেগেছে ৩৪ বছর। এই কলঙ্কের দায় আমাদের সবার।
এই অপরাধে দোষী আমরা সবাই। আমাদের ক্ষমা কর"ন।
চলুন এই দায় মোচন করতে ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে আমরা সবাই এক ফোঁটা চোখের জল ফেলে আসি।
---------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ এর বিশেষ সম্পাদকীয় / ১৯ নভেম্বর ২০০৯
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।