আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুরুষ-১

শুদ্ধতার আগুনে যেন সতত পুড়ি

(প্রাক-কথন : নেটের অভাবে অ-নে-ক দিন এখানে আসতে পারি নাই। । তাই দিনে দিনে সঞ্চয় কিছুটা বেড়ে গেছে। আর সে কারণেই লেখা কিছুটা বড়। ধন্যবাদ) বাসে উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার নাকের বাঁ পাশটা যেন বন্ধ হয়ে গেল।

শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় টের পাচ্ছিলাম ডান পাশ দিয়ে বোশ জোরেসোরেই বাতাস আসা যাওয়া করছে। আর তার সঙ্গেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। মোটামুটি কৈশোর থেকেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম যে, আমার নাকের বাঁ পাশটার ফুটো দিয়ে কম শ্বাস-প্রশ্বাস চললে কম বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ি। একবার এমন হওয়ার পরই প্রচন্ড জ্বরের মুখে পড়েছিলাম। ঘন্টাখানেকের মধ্যে এমন হয়েছিলো যে, চলার শক্তি পাচ্ছিলাম না।

তখন স্টেশনের বেঞ্চে শুয়ে পড়েছিলাম। তারপর নিজকে আবিষ্কার করেছিলাম জেল হাসপাতালে। পরে জানতে পেরেছিলাম সেদিন কোন এক মন্ত্রী স্টেশনে আসার কথা ছিলো। তাই তার আগে আগে যত ভিখিরী আর ভবঘুরে আছে তাদের ধরে নিয়ে জেলে পুরেছিলো। আমার ভাগ্যটা তেমন একটা খারাপ না থাকায় হয়তো জ্বরের কারণে হাসপাতালের আরামের বেডে ঠাঁই পেয়েছিলাম।

পেয়েছিলাম অন্যান্যদের তুলনায় খানিকটা ভালো খাবার। জ্বর পুরোপুরি না সারতেই আমাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, জেলখানার গেটে আসতে আসতে আসতেই আমার জ্বর পুরো সেরে গিয়েছিলো। এখনও বাঁ নাকের ছিদ্র দিয়ে কম শ্বাস-প্রশ্বাসের কারণে মনটা খুঁত খুঁত করছিলো। কি থেকে কি হয়ে যায় বলা মুশকিল।

শরীর বেশি খারাপ হয়ে গেলে আমার ইন্টারভিউ ভালো হবে না। যদিও ইন্টারভিউ দিয়ে আজকাল কারো চাকরি হয় বলে শুনিনি। তবুও পরীক্ষা ভালো না হলে সবারই খারাপ লাগার কথা। আজ ইন্টারভিউ দিতে পারলে এটা হবে আমার শততম ইন্টারভিউ। আমি ঠিক করেছি যে এতে চাকরি না হলে রেল লাইনের পাশের কোনো বস্তিতে আশ্রয় নেবো।

পেশা আর জীবন-যাপনের সঙ্গে সঙ্গে মিশে যাবো তাদের সঙ্গে। মুছে ফেলবো আমার বর্তমান ইতিহাস। আমার স্বজনদের সাথে ছিন্ন করবো যাবতীয় সম্পর্ক। নাকের বাঁ পাশটা চাপতে চাপতেই বাসের মাঝামাঝি একটি আসনে জানালার পাশে বসে পড়ি। এ সময়টাতে লোকজন তেমন থাকে না।

বেশির ভাগ চাকরিজীবি আর স্কুল কলেজগামী মানুষ আরো আগেই চলে যায় বলে এ সময়টা মোটামুটি ভিড় কম হয়। কিন্তু কিছুক্ষণের ভেতরই যাত্রী উঠতে উঠতে সবগুলো আসন পূর্ণ হয়ে গেল। আমার পাশে একটি কিশোর বসেছে। কোলের কাছে স্কুলব্যাগ। হয়তো ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কেথাও যাচ্ছে।

নয়তো মর্নিং শিফটে ক্লাস শেষ করে ঘরে ফিরছে। নাকের ভেতরটা হঠাৎ করেই ভীষণ সুরসুর করতে আরম্ভ করলো। হাতে নাক ডলেও কিছু হলো না। পরপর দুটো হাঁচি বেরিয়ে এলো। ঠিক তখনই বাসটি কলেজগেট এসে থামলে আরো কয়েকজন যাত্রী উঠতেই তারা ভেতরের দিকে আসতে লাগলো খালি আসনের আশায়।

একটি মেয়ে ঠিক মেয়েও হয়তো বলা যাবে না, তরুণী বললেও বেশি হয়ে যাবে। মহিলা বলাই বোধকরি সঙ্গত হবে। আমার কাছে দেখতে যা মনে হচ্ছিলো তার বিয়ের বয়স আর বেশি দিন থাকবে না। আমার সরকারি চাকরি পাওয়ার বয়স যেমন আর একুশদিন বাকি আছে, তারও হয়তো বিয়ের উপযুক্ত বয়স কিছুদিনের মাঝেই পেরিয়ে যাবে। আর বিয়ে যদি হয়েই থাকে তাহলে তো সমস্যাই নেই।

আজকাল দেখে বোঝার উপায় নেই কার বিয়ে হয়েছে কার হয়নি। মানুষ আধুনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবন-যাপনও বদলে যাচ্ছে। যে নারীর বিয়ে হচ্ছে সে মিসেস হয়ে যাচ্ছে। আবার যখন স্বামী-স্ত্রীতে ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাচ্ছে বা বিধবা হয়ে যাচ্ছে তখনই নারীটি আবার মিস হয়ে যাচ্ছে। আমার পাশের কিশোরটি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আপা এখানে এসে বসেন।

মহিলা একবার আমার দিকে তাকিয়ে খানিকটা ইতস্তত করে কিশোরটিকে বললো, তুমি কি নেমে যাবা? সে মাথা নাড়লো। তাহলে তুমিই বসো না! আমি হয়তো সিট পেয়ে যাবো। আপনি বসেন। মহিলা আমার পাশে খানিকটা দুরত্ব রেখে বসে পড়লেও আবার কি মনে করে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি কি কষ্ট করে বাইরে আসবেন? আমি জানালার কাছে বসতে চাই।

আমি মহিলার মুখের দিকে তাকাতেই তার কানের ঝুমকা দু’টির ওপর চোখ পড়ে। চোখ পড়ে গলায় চিকচিক করতে থাকা চেনের ওপর। আজকাল সোনার অলঙ্কার পরে কি কেউ বের হয়? আর নিতান্তই যদি গয়নাগাটি পরে তাও নিজের নিরাপত্তার কথাটা আগে ভাবা উচিত। বললাম, জানালার কাছে বসাটা কি নিরাপদ হবে? মহিলা কেমন করে যেন তাকায়। ভেতরে ভেতরে খানিকটা কুকড়েও যাই।

এখনই যদি হল্লা-চিল্লা আরম্ভ করে দেয় কিংবা অসভ্য ইতর কোথাকার তোর মা বোন নেই জুতো দিয়ে...ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে থাকে তো পুরুষ যাত্রীরাও মওকা বুঝে এক চোট বলবে। অতি উৎসাহী কেউ কেউ দু একটা চড়-থাপ্পড় যে বাগিয়ে আসবে না তা ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। আমি বেরিয়ে তাকে বসার জন্য পথ করে দিতেই মহিলা কিশোরটিকে টেনে তার পাশে বসিয়ে দিতেই বললাম, এটা কি হলো? মহিলা আমার দিকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পাই খুব সূক্ষ্ম একটি হাসি তার ঠোঁটে। হয়তো মনের ভাব, কেমন জব্দ? মেয়েদের পাশে বসতে চাওয়ার মজাটা এবার দেখ। তারপর সে বললো, আপনি বড় মানুষ খানিকটা দাঁড়িয়ে গেলে কী এমন ক্ষতি? সামনের কোথাও সিট পেয়ে যাবেন।

কিছু মনে করবেন না, কেমন! আমি থ। কি বলবো? দিনের শুরুতে একটি কাজে যাচ্ছি আর এরই মাঝে প্রতারিত হয়ে গেলাম? তখনই কাঁধে একটি হাত পড়তেই মুখ ফিরিয়ে তাকাই। একজন ঠিক আমার পেছনেই উঠে দাঁড়িয়েছে। বললো, এখানে বসেন। আমি নেমে যাচ্ছি সামনে।

ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি লোকটির পরিত্যক্ত আসনে বসে পড়ি। মহিলাটির প্রতি আমার খুবই রাগ হচ্ছিলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বসতে পারার সঙ্গে সঙ্গে রাগটাও চলে গেল। একবার আড় চোখে মহিলাটির দিকে তাকাই। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

একটি হাত দিয়ে বাইরের দিকের ঝুমকাটা ঢেকে রেখেছে। কিছুটা তাহলে সাবধানীই মনে হচ্ছে। ফার্মগেট ট্রাফিক সিগনালে গাড়িটা দাঁড়াতেই জানালার বাইরে একটি ভিখেরীকে দেখা গেল। আরেকজন কাঠির মাথায় পাঁপড়ি মেলা আমড়া নিয়ে বলছে, আমড়া আমড়া! বরিশালের কচি আমড়া! মহিলাটি আমড়া কিনবে হয়তো। দরদাম জিজ্ঞেস করে কোলের উপর রাখা ব্যাগটা খুলে হয়তো খুচরো টাকা খোঁজে।

তখনই বাইরে থেকে দু’টি হাত তার কানে আর গলায় পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই মহিলার আর্তনাদ শোনা যায়। হায় হায় নিয়ে গেল! কি নিয়ে গেল? কার নিয়ে গেল? আপনি কি করছিলেন? আগেই সাবধান হওয়া উচিত ছিলো! ইত্যাদি নানা ধরনের বাক্যে মুখর হয়ে উঠলো গাড়ির ভেতরটা। আমি মহিলার দিকে তাকাতে পারি না। হয়তো মনে মনে আমি খুশি হই।

কিংবা এমনি কিছু একটা ঘটুক সত্যিই মনে মনে চাচ্ছিলাম। তখনই নাকের বাঁ দিকের ছিদ্রটা ভীষণ ভাবে সুরসুর করতে আরম্ভ করলো। হাতের তালু দিয়ে নাক ঘঁষি। পকেট থেকে দুমড়ানো মোচড়ানো টিসু বের করে নাক চেপে ধরি। কিন্তু কাজ হয় না।

পরপর দু’টো হাঁচি বেরোতেই মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করতে থাকে। তারপর আবার হাঁচি আসে। নাক চেপে ধরে রাখি। বাংলা মোটরের কাছে আসতেই টের পাই নাক দিয়ে পানি পড়ছে। সর্দিই লেগে গেল কি না! খানিক পর বুঝতে পারি যে নাক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

জানালার পাশে থাকলে নির্দ্বিধায় মাথা বের করে নাকটা ঝেড়ে নিতে পারতাম। কিন্তু ভেতরের দিকে বসেছি বলে সে সুযোগটা আর নেই। টিসু চেপে ফ্যাড় ফ্যাড় করে নাক পরিষ্কার করতে চাই। টিসুটা ভিজে যাতা অবস্থা হয়ে যায়। ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলে পাশের দুজন যাত্রীর ঘঁড়ের উপর দিয়ে তা বাইরে ছুঁড়ে মারি।

সুর সুর করে নাকের ভেতর থেকে সর্দি গড়িয়ে নামছে বুঝতে পেরেই পকেট থেকে রুমাল বের করি। এটাকে হয়তো রুমাল বলা ঠিক হবে না। যদিও রুমাল হিসেবেই দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করছি। আসলে এটি একটি জামার কাপড় থেকে বেঁচে যাওয়া টুকরো। আমার ছাত্রী রাইসার খালা দিয়েছে।

গতবার সে কানাডা থেকে ছুটিতে দেশে এসেছিলো। সেখানকার কোনো এক কানাডিয়ান লোককে নাকি বিয়ে করেছে। এ নিয়ে বাবা মা’র সঙ্গে রাগ করে বোনের বাড়িতেই উঠেছিলো। তখনই একদিন রাইসাকে পড়াতে পড়াতেই আমার নাক থেকে পানি ঝরতে আরম্ভ করলে রাইসা ছুটে গিয়ে টিসু নিয়ে আসে। কিন্তু তা অল্পক্ষণেই ফুরিয়ে গিয়েছিলো।

ব্যাপারটা তার খালা কাকলি দেখতে পেয়ে বলেছিলো, আপনার রুমাল নেই? আমি মাথা নেড়ে জানিয়েছিলাম, হারিয়ে যায় বলে সঙ্গে রুমাল রাখি না। কাউকে রুমাল দিতে নেই। না হলে আমার কাছে নতুন রুমাল ছিলো। রুমাল দিলে কি হয়? কিছুই হয় না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাকলি বলেছিলো, তবুও দেবো না।

তবে আমার জামা বানিয়ে একটা টুকরো আছে। সেটা দিতে পারি। আমি হেসে বলেছিলাম, ছেঁড়া গামছা টাওয়েল বা এমনিই কোনো ন্যাকড়া হলেও চলবে। কাকলি হেসে উঠে বলেছিলো, আপনি যে কি না! তারপরই সে নীল রঙের কাপড়ের টুকরোটি এনে দিয়েছিলো। রঙটা দেখে বলেছিলাম রঙটা নীল হলেও যেন নীল নয়।

এর নাম ইলেক্ট্রিট ব্লু। মতিঝিল বাসটা থামতেই তড়িঘড়ি নেমে পড়ি। রুমালটা বলতে গেলে পুরোটাই নাকের পানিতে ভিজে গেছে। রঙটা গাঢ় হয়ে কেমন কালচে দেখাচ্ছে। এটা একবার ধু’তে পারলে ভালো হতো।

হাতটাও কেমন যেন আঠালো মনে হচ্ছে। এ এলাকায় বাইরের কোনো কল থেকে পানি পাওয়ার উপায় নেই। পানির জন্য কোনো রেস্টেুরেন্টে বা আলছালাদিয়াঢাকা হোটেলে ঢুকতে হবে। যেখানে যাবো বলে এসেছি সে অফিসটা দিলকুশায়। সেদিকে অবশ্য কয়েকটি সস্তার রেস্টুরেন্টও আছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।