_________________সেলাই গাছের কারখানা _______________________________________
প্রো লো গ
লেখক : আহমদ মিনহাজ
শেষ কিস্তি
Click This Link
Click This Link
উচ্চারণ-১ : মাহমুদ শের, পাকিস্তান আর্টিলারি রেজিমেন্টের সৈনিক। সে তার সদ্যোজাত শিশু সন্তানের নামটি আমায় মুখস্থ করিয়েছে। আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি,-খবর সংগ্রহের ছুতোয় যদি কখনো পাকিস্তানে ঘুরতে যাই এবং সেটা যদি পাঞ্জাবের সমতল ভূমি হয়, তবে তার পরিবারকে এই খবরটি পৌঁছে দেওয়া হবে,-‘আর্টিলারি রেজিমেন্টের মাহমুদ শেরের সাথে গেরহার্ডের দেখা হয়েছিল। মাহমুদ শের ইস্টার্ন কমান্ডের হয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে বীরের মতো লড়াই করছে। সবাই যেন তার জন্য প্রার্থনা করে।
মহানবির ইসলাম রক্ষার জন্য জেনারেল নিয়াজি তাকে এই দায়িত্বটি দিয়েছেন। গেরহার্ডের মাধ্যমে সে তার পরিবারকে এই অভিজ্ঞতাটি পাঠিয়েছে,-পূর্বাঞ্চলের অধিবাসী বাঙালিরা একটি ধর্মভীরু জনসংখ্যা। অলি-দরবেশের অসংখ্য মাজার সেখানে বিদ্যমান। স্থানীয় লোকজন মসজিদে নামাজ পড়তে যায় ও ঘুম থেকে উঠে আল্লাকে স্মরণ করে। গেরহার্ডের মাধ্যমে পাঞ্জাবের সবাই যেন এই সংবাদটি পায়,-মাহমুদ শের একজন সত্যবাদী।
ওরা তাকে মিথ্যা বলে এখানে নিয়ে এসেছে। মিথ্যেবাদীর জন্য আল্লা তার নরকের রাস্তা খোলা রেখেছেন। শেষ বিচারের দিন রাস্তাটি খুলে দেওয়া হবে এবং যে-যার প্রাপ্য বুঝে নেবে। কেননা আল্লা স্বয়ং অঙ্গীকার করেন,-মিথ্যেবাদীর উপর আল্লার লানৎ বর্ষিত হবে।
প্রিয় ফ্রাউলিন, লানৎ সম্ভবত আরবি অভিশাপবাচক ক্রোধ।
মাহমুদ শেরের মাধ্যমে গেরহার্ড এই সতর্ক বার্তা পাঠাচ্ছে তোমায়,-ভাইমারের অধিবাসীদের জানা প্রয়োজন যুদ্ধ এক মনস্তাত্ত্বিক প্রতারণা। মাহমুদ শেরকে প্রতারণা করা হয়েছে। তার সন্তানটিকে সে হয়তো কোনোদিন চুম্বন করতে পারবে না। ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ পাঞ্জাবের সমতল ভূমির কাছে মাহমুদের লানৎ-টি পৌঁছে দেওয়া হবে। ওভার।
উচ্চারণ-২ : রামোস গনজালেস, ভিয়েতনামের যুদ্ধে আমেরিকান সিগন্যাল কোরের সদস্য। মার্কিন দেশে জন্মগ্রহণকারী স্প্যানিশ এই সৈন্যটিকে বলা হয়,-ভিয়েতনাম একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র। একটি অগণতান্ত্রিক শক্তি ভিয়েতনামের অখণ্ডতাকে ধ্বংস করতে চাইছে। এশিয়া মহাদেশে চীন ও সোভিয়েতের অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করার জন্যে ভিয়েতনামের সমাজতন্ত্রীরা নিজেকে ব্যয়িত করছে। আমেরিকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এটি হলো ডিআরভি-দের (উবসড়পৎধঃরপ জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ঠরবঃহধস) একটি ষড়যন্ত্র।
গণতন্ত্র একটি আমেরিকান অভিজ্ঞতা। একমাত্র মার্কিনী জাতীয়তাবাদ সেটি ভিয়েতনামে নিশ্চিত করতে পারে। সোভিয়েত রাশিয়া বা চীনা জাতীয়তাবাদ নয়।
সব শুনে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ বোধ করে গনজালেস। সিগন্যাল কোরের সদস্য হিসাবে শত্রুর বিরুদ্ধে আগ্রাসী হওয়ার শপথ করে সে।
ভিয়েতনামের ধানখেত ও কলাবাগানে দুই বছর মরণপণ লড়াই করে ক্লান্ত গনজালেস একদিন তার গ্যারিসন কমান্ডারকে প্রশ্ন করে বসে,-কমান্ডার আমরা এখানে খামোখা লড়ছি কেন? কমান্ডার তার দিকে ক্রূর হেসে উত্তর করে,-ভিয়েতনাম ও রাশিয়ার পাছা মারার জন্য। কমান্ডারের উত্তর শুনে গনজালেস অনুধাবন করে,-এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো মার্কিনী গণতন্ত্রকে কেন পাছা মারার গণতন্ত্র বলে ডাকে। এই উপলব্ধি গনজালেসের শপথ ও অঙ্গীকারকে দুর্বল করে ফ্যালে। বোমা-বিধ্বস্ত ভিয়েতনামের কথা ভেবে তার দু’চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে। এরপর একটি নির্জন রাত আসে গনজালেসের জীবনে।
নির্জন সেই রাতে গ্যারিসন কমান্ডারের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করে সে।
প্রিয় ফ্রাউলিন, পূর্ব বাংলার এক বীর মুক্তিসেনা তার বাঙ্কারে বসে গেরহার্ডকে এই আত্মহত্যার গল্পটি শুনিয়েছিল। মুক্তিসেনাকে গেরহার্ড এই প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়,-পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি বিষয়ে কোনো মিথ্যে ও অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন সে পাঠাবে না। সে আরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে,-গেরহার্ডের লেখনী নিছক সাংবাদিক প্রতিবেদন হবে না, এটি এই মানবিক সত্য উন্মোচিত করবে যে বাঙালিরা স্বাধীনতা ও স¤প্রীতিপ্রিয় জনসংখ্যা, এবং তার একটি ইতিহাস রয়েছে। প্রিয় ফ্রাউলিন, ইতিহাস এক অস্তিত্ববাচক উন্মোচন।
এর ভিতর দিয়ে জনসংখ্যারা বাক্যালাপ করে। মুক্তিসেনার মাধ্যমে ভাইমারের কাছে গেরহার্ডের এই সতর্ক সংকেত পাঠিয়ে দিও,-মিথ্যে ও প্রতারণা হইতে সাবধান। মিথ্যে একটি গোয়েবলসীয় আত্মরতি, যেটি মাহমুদ শের ও গনজালেসকে হত্যার অভিমুখে বিভ্রান্ত করেছে। জীবন-প্রতিরোধী বিভ্রান্তি জনসংখ্যার বাক্যালাপকে স্তব্ধ ও স্তিমিত করে। ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ সাংবাদিক প্রতিবেদন লেখার সময় বাঙালি মুক্তিসেনার অনুভূতিটি রক্ষা করা হবে।
ওভার!
উচ্চারণ-৩ : লতিফউল্লা হিলালী, টাইগার নিয়াজির রাজাকার বাহিনীর একজন কামান্ডার। সে আমায় এই বিবৃতি টুকে নিতে জোর করে,-রাজাকার একটি স্বস্তিবাচক বিশেষ্য; ষড়যন্ত্রের বিপরীতে এটি হলো শান্তি ও স্থিতির পতাকা। জলপাই রঙের জিপে বসিয়ে হিলালী আমায় এই বিবৃতি উপহার দিয়েছে,-বিদায় হজ্বের ভাষণে আল্লার প্রেরিত পুরুষ একটি স¤প্রীতির উচ্চারণ করে গেছেন; পাকিস্তান সেই উচ্চারণের রাজনৈতিক ফলশ্রুতি। এখানে হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরকে ভাই নামে সম্বোধন করে ও প্রতিবেশীর মতো বসবাস করে। ইসলামের বরাত দিয়ে হিলালী এই ব্যাখ্যাটি বৈধ করতে চেয়েছে,-নিজের আমল বজায় রেখে অপরের প্রতি সহিঞ্চুতা প্রদর্শন ইসলামের মূল কথা।
আমল হলো র্কোআনিক বিশেষত্ব; যার অর্থ সম্ভবত এই করা যায়,-ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আত্মার প্রশান্তি ও আল্লার সন্তুষ্টি অর্জন।
লতিফউল্লা হিলালী একজন সুপুরুষ। তাকে দেখে গেরহার্ডের অনুভব হয়,-লোকটি বোধহয় আল্লার সন্তুষ্টি অর্জন করেছে। আমার সঙ্গে তার কথা বলার ভঙ্গি ইসলামের চরিত্রের পক্ষে অনুকূল ছিল। কেননা ইসলাম ইহুদিকে নিন্দা করলেও মোজেসের প্রশংসা করেছে।
মোজেস একজন প্রেরিত পুরুষ, এবং মোহাম্মদ তাঁকে বিনয় করেন। লতিফউল্লা হিলালী দক্ষ তার্কিক। ইসলামের প্রথা-আনুষ্ঠানিকতা ও দার্শনিক ভাবনাকে উপযুক্ত শব্দের সাহায্যে গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপনায় তার কুশলতা গেরহার্ডকে চমৎকৃত ও মুগ্ধ করেছে। বাঙালি বিদ্বান-সমাজ এবং মুক্তি সেনারা হিলালী ও রাজাকার-কে সমার্থক গণ্য করে। তারা বলে,-হিলালী প্রতিক্রিয়াশীল স্বেচ্ছাসেবক; পাকিস্তান রাষ্ট্রের অনুচর।
নিজে বাঙালি হয়ে এই জনসংখ্যার অনুভূতি ও মূল্যবোধের সাথে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা মনে করে,-হিলালীর বিশ্বাসঘাতকতা রাজাকার শব্দের অর্থটিকে পাল্টে দিয়েছে। প্রগতি ও বিশ্বাসের মধ্যে ভয়ংকর এক স্ববিরোধী রূপে এই রাজাকাররা উত্থিত হয় বলে তারা ধারণা করেন।
বিশ্বাসঘাতক ও স্ববিরোধী,-আখ্যা দুটি সম্পর্কে হিলালীকে আমি প্রশ্ন করি। কমান্ডারটি মৃদু হেসে উত্তর করেন,-অবিশ্বাসীদের জন্য এটি বিশ্বাসঘাতকতা ও স্ব-বিরোধী হতে পারে, কিন্তু আমার জন্য নয়।
আমি ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস করি, এবং আপনি জানেন ইসলাম অবিশ্বাসীদের বিষয়ে সতর্ক। তার বক্তব্যে হিলালী একটি বিশ্বাসকে ব্যাখ্যা করে। গেরহার্ডকে সে এই বিশ্বাসের দিকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছে,-ইসলাম এক পূর্ণাঙ্গ জীবনপ্রণালী। প্রেরিত পুরুষ মোহাম্মদের বাণী মরুভূমিতে সুবাস ছড়িয়েছে। এখন এটি সারা পৃথিবী জুড়ে স¤প্রসারিত হচ্ছে।
পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের ভ্রান্তি বা দুর্গতির বিপরীতে ইসলাম একটি গ্রহণযোগ্য আধুনিকতা। ইসলামের অপব্যাখ্যা যারা করে তারা ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য সেটি করে। কাজেই ...
ফ্রাউলিন, হিলালীর হয়ে শোফেনস্খিলকে এই বিষয়টি অভিহিত করো,-হিলালী একজন রাজাকার। পাকিস্তানী সেনাদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কমান্ডার। সে বিশ্বাস করে ভারত একটি সা¤প্রদায়িক ভূখণ্ড।
হিন্দু সা¤প্রদায়িকতা পাকিস্তান সৃষ্টির কারণ হয়েছিল। ভারতনেত্রী মিসেস গান্ধি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পরিকল্পিত বিরোধ ঘটিয়ে সেই সা¤প্রদায়িকতাকে আবার উসকে দিতে চাইছেন। ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’র মাধ্যমে ভারতবর্ষ পৃথক হয়। এখন পাকিস্তান পৃথক হলে দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না। হিলালী মনে করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও মিসেস গান্ধির দৃষ্টিভঙ্গি পৌত্তলিক।
এই পৌত্তলিকতা মানুষকে তার মহত্ত্ব থেকে সরিয়ে রাখার বিধান প্রচার করে; যেন মানুষ এক অবোধ পশু! কিন্তু আল্লা মানুষকে বোধসম্পন্ন করে সৃষ্টি করেন,-পশুর মতো অবোধসম্পন্ন করে নয়।
ইসলামের দার্শনিক তাৎপর্য সম্পর্কে হিলালীকে প্রশ্ন করলে সে উত্তর করেছিল,-ইসলাম ধর্মে নিরাকার এক শান্তিকে নিজের আমল ও নফস-এর পরিশুদ্ধি দিয়ে প্রণতি জানায় মানুষ। এই প্রণতি ইসলামের গূঢ় দার্শনিক ভিত্তি। আল্লার সৃষ্টিকে অনুধাবন করো। এর উপযোগিতাকে নিজের কাজে লাগাও।
ইসলামে অনুধাবন ও উপযোগিতার উপর মোহাম্মদ প্রচণ্ড গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। কেননা তারা আল্লার সন্তুষ্টি ও ‘পরিশুদ্ধি’ অর্জনে মানুষকে সাহায্য করে। ইসলাম হলো ‘পরিশুদ্ধি’র আহবান। মোহাম্মদ তোমায় আহবান করেন,-জাগতিক উৎকর্ষ ও আত্মিক মুক্তির শরীরে নিজেকে মিলিত করো। আল্লার সৃষ্টিকে অনুধাবন করো ও এর উপযোগিতাকে ব্যবহার করো।
এই মিলন ধর্মকে রক্ষা করবে। ’
ফ্রাউলিন, তোমার মাধ্যমে গেরহার্ড এটি স্মরণ রাখতে ইচ্ছুক,-হিলালী নিজেকে একজন পরহেজগার মনে করে। পরহেজগার ধর্মবাচক গুণাবলী। এর অর্থ সম্ভবত এই করা যেতে পারে,- পরহেজগার ইসলামী বিধানকে যথাযথভাবে পালন করে এবং ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভকে আমল করে। গেরহার্ডের মাধ্যমে বাঙালি বিদ্বান-সমাজ ও মুক্তি সেনাদের কাছে হিলালী এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছে,-বাঙালি বিদ্বান-সমাজ ব্যক্তিস্বার্থের পূজারী এবং তারা একটি পৌত্তলিক বিভ্রান্তির পৃষ্ঠপোষকতা করে।
রাজাকার এই বিভ্রান্তিকে প্রতিবাদ করায় তাকে নিয়ে সকলের এতো মাথাব্যথা। গেরহার্ডের কাছে হিলালী এই অভিযোগটি তুলে ধরে,-ভারত রাষ্ট্রের অনুচর বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিসেনারা অযথা ফিৎনা সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আসবিয়াহ-কে বিনষ্ট করছে। একজন রাজাকার ফিৎনাকারীকে ভয় করে না এবং তাকে শাস্তি প্রদানে রাজাকারের হাত কখনো কেঁপে উঠবে না। যেহেতু আল্লার প্রেরিত পুরুষ মোহাম্মদ বলবার চেষ্টা করেছেন,-ফিৎনা সৃষ্টিকারীকে তার গোত্র থেকে বহিষ্কার করো। প্রয়োজনে তাকে হত্যা করা যেতে পারে।
আল্লা বনি ইসরাইলকে ফিৎনা সৃষ্টিকারী হিসাবে আখ্যায়িত করার পক্ষে, যেহেতু কিনান গোত্রের বনি ইসরাইলরা প্রথমে মোজসকে স্বীকার করেনি এবং তার বিধান অনুসরণ করেনি। তারা উদ্ধত। আল্লা সীমা লংঘনকারী ও ফিৎনা সৃষ্টিকারী গোত্রসমূহকে ধ্বংসের পক্ষে।
ফ্রাউলিন, এই দৃশ্যটি শোফেনস্খিলের কাছে বর্ণনা করা প্রয়োজন,-বনি ইসরাইল একটি ইহুদি বাচক ইঙ্গিত, যেটি মুসলমান ও ইহুদিকে পরস্পরের শত্রু করে দিয়েছে। ফিৎনা হলো র্কোআনিক বিশেষত্ব; অযৌক্তিক ও হিংসাত্মক মনোভাব সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের শান্তি ও স্থিতিকে ধ্বংস করে বলে ফিৎনা-কে ঘৃণা করা হয়।
ফিৎনা-র বিপরীত বিশেষণ আসবিয়াহ,-একটি একতা ও স¤প্রীতিবাচক বিশেষণ। ইবনে খলদুন একে জরুরি মনে করেছেন এই যুক্তিতে,-আসবিয়াহ মানুষকে সামাজিক ঐক্য ও সংহতির দিকে একত্র করে রাখে। হিলালী আমায় এই ধারণাটি দেয়ার চেষ্টা করে,-ফিৎনার বিপরীতে আসবিয়াহ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৪৭-এ ভারত ভেঙে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। রাজাকার এই সৃষ্টির বৈধতায় আজো বিশ্বাস করে এবং তার কাছে এটি কোনো অপরাধ নয়।
ফ্রাউলিনের মাধ্যমে গেরহার্ড এটি জানানো কর্তব্য মনে করে,-রাজাকার হিলালী আমার কাছে এই প্রতিশ্রুতি আদায়ে সচেষ্ট ছিল যে আমি তার বক্তব্য অনুধাবন করতে সক্ষম
হয়েছি, এবং এই বক্তব্য কোনো উদ্দেশ্যমূলক কারণে বিকৃত করা হবে না।
‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ হিলালীর বক্তব্যকে বিকৃত করা হয়নি। প্রেরিত পুরুষরা বলেন,-পৃথিবীর আশ্চর্য এই ফলবাগানে ঈশ্বর ছাড়া কোনোকিছু ধ্রুব বা নিশ্চিত নয়। সুতরাং এই প্রতিশ্রুতি করা যেতে পারে যে গেরহার্ড তার প্রতিবেদনে লতিফউল্লা হিলালীর বক্তব্যকে বিকৃত করে না। তবে ফ্রাউলিনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার মুক্তি সেনাদের কাছে গেরহার্ড এই বার্তাটি পৌঁছে দিচ্ছে,-ভাইমার ও বুখেনওয়াল্ডের দূরত্ব সম্পর্কে সে সজাগ রয়েছে। সুতরাং, হিলালীর বক্তব্যের বিপক্ষে সংগঠিত তর্ক ও প্রত্যাখানের প্রতি গেরহার্ডের জোরোলো সমর্থন বজায় রইলো।
ওভার!
উচ্চারণ-৪ : শিউলি বালা দেবী ও মুজিব ফকির। শিউলি বালা দেবী পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘু, আর মুজিব ফকির মুসলমান বাউল। পূর্ব বাংলায় বাউল একটি জনপ্রিয় সঙ্গীতবাচক বিশেষ্য এবং এটিকে অসংখ্য ক্রিয়াবাচক বিশেষণে বর্ণনা করা সম্ভব। ঈশ্বর, নদী ও জন্মভূমিকে ধর্ম এবং মানুষের দিকে সমার্থক করে বাউল। তাই ধর্ম বাচক হলেও এটি একটি নিরপেক্ষ সম্ভাষণ।
মুজিব ফকির গান করে, আর শিউলি বালা ফকিরকে ভালোবাসে। পূর্ব বাংলার নদীগুলোর মতো বেগবান সেই ভালোবাসা। বাংলার মাটি আবেগ ও ভালোবাসার জাদুতে বর্ণিল। রমণীরা ভাইমারের মাটির চেয়ে কালো ও উর্বর। শিউলি বালা কৃষ্ণবর্ণ নারী।
তার এই কৃষ্ণতা আফ্রিকার মতো কালো নয়। শিউলিবালার কৃষ্ণতা বাংলার ধানখেতের মতো,-সবুজ সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না। ধানখেত একটি অস্থির যৌনবাচক ইঙ্গিত। এটি কচি সবুজ থেকে কালচে সবুজ, কালচে থেকে সোনালি রঙে তার যৌনতা পাল্টায়। নৌকায় মেঘনা নদী পার হওয়ার দিনগুলোয় শিউলি বালা গেরহার্ডকে জানায়,-মুজিব ফকিরকে ভালোবেসে অস্থির এই যৌন-অভিজ্ঞতাটি তার হয়।
মুজিব ফকির সাত্ত্বিক বাউল। সাত্ত্বিক এমন এক বিশেষণ যেটি বিনয় ও আসক্তি-প্রতিরোধী উচ্চারণের সঙ্গে মিলিত হতে ভালোবাসে। যার অর্থ হলো,-ভালোবাসায় কামনার বাড়াবাড়ি নেই। ভালোবাসা একটি মধুর সম্ভাষণ, যেটি ঈশ্বরের বিরাট সৃষ্টির দিকে মানুষের মুখ আলোকিত রাখে। পৃথিবী সম্পর্কে মুজিবের ধারণাটি সাত্ত্বিক হলেও গেরহার্ডকে সে এই বলে আশ্বস্ত করেছে,-সাধারণ মানুষের মতো বাউল-ও ক্ষুধার্ত হয়।
ক্ষুধার্ত হলে খাদ্য ও শিউলি বালা,-উভয়কে সে গ্রহণ করে। এই সংবাদটি গেরহার্ড কেবল ফ্রাউলিনের জন্য সংরক্ষণ করছে,-বাউল মুজিব ফকিরের ক্ষুধাকে পূর্ব বাংলার খেয়ালখুশিভরা টিলা ও পাহাড়ের সাথে তুলনা করা যায়। বাংলার টিলা ও পাহাড় অনিশ্চিত স্বভাবের হয়। বর্ষায় পাহাড় ধসে পড়ে এবং টিলাগুলো অনেক সময় দেবে যায়। মুজিব ফকিরের খাদ্যের ক্ষুধা ক্ষণস্থায়ী।
গেরহার্ড এটি লক্ষ করেছে, গাজায় দম দিয়ে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা গলা ছেড়ে গান গাইতে পারে সে।
শিউলিবালার কাছে জীবন একটি নেশা-ধরানো ভ্রমণ। ফকিরের সাথে এর অন্তিম পর্যন্ত ঘুরতে ইচ্ছুক সে। অন্যদিকে গেরহার্ডের কাছে ফকির তার ধারণাটি ব্যাখ্যা করে,-জীবন একটি নদী। নদীটি ঈশ্বরের দিকে আরাধনা করার জন্য বইছে।
ফকিরের গান শুনে গেরহার্ডের ধারণা হয়েছে,-বাউল-রা ঈশ্বরকে নদী ও নারীর প্রতীকে স্পর্শ করতে পছন্দ করে। কেননা নদী হচ্ছে জীবনদায়ী আর নারী পুরুষকে যৌনতা ও সন্তানে আলোকিত রাখে। প্রিয় ফ্রাউলিন, শিউলি বালা এক কৃষ্ণবর্ণ প্রজাপতি; এই রমণীর কালো চোখে ঈশ্বর নিজের সৃষ্টিকে আলিঙ্গন করেছেন। ঠিক যেরকম, তোমার নীল চোখের তারায় আমি স্পর্শ করি ভাইমার। আমার গোপন যৌন-সংবেদন!
এই তথ্যটি শোফেনস্খিরের জন্য যে মুজিব ফকির ও শিউলি বালা গ্রামীণ সর্বহারা।
জাতীয় উৎপাদনে তাদের ভূমিকা অস্পষ্ট। হয়তো-বা নগণ্য। শ্রমসাধ্য কোনো কাজ তারা করে না। ধর্ম বিশ্বাস অস্পষ্ট বা গুহ্য। মুসলমান ফকির ভালোবাসে হিন্দু রমণীকে, এবং তাদের যৌন মিলন হয়।
এশিয়ার সামাজিক রঙ্গমঞ্চে বাউল একটি বিস্ময়কর ব্যতিক্রম; পূর্ব বাংলার সাপুড়ে জিপসিদের মতো। জিপসিদের এখানে বেদে বলা হয়। এরা নৌকায় করে বাংলার নদীগুলো ঘুরে বেড়ায় ও সাপের খেলা দেখায়। বাউলরা বছর ভরে হিন্দু-তীর্থ ও মুসলমান সাধু-ফকিরদের মাজারে গান করে বেড়ায়। গানের ভাষা উপনিষদের মতো রূপময়।
সুরেলা ও আকর্ষণীয়। একতারা একটি অতি সাধারণ বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু বাউলের হাতে বাদ্যযন্ত্রটি সহজ নিঃশ্বাসের মতো জীবনতরী বয়ে চলার কাহিনী বর্ণনা করে। বাউলরা ভায়োলিন বাজাতে পারে এবং তাদের ভায়োলিনের গঠন অতি সাধারণ খেলনার মতো। ভায়োলিন বাউলকে সুরের প্রবাহ ও গলার ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
মুজিব ফকির একজন দক্ষ কবিয়াল। তার এই ক্ষমতাটি শীত ঋতু এলে সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশিত হয়। শীতে পূর্ব বাংলার গ্রামগুলোয় গানের আসর বসে। আসরে গাইবার জন্য দূরের সব গ্রাম থেকে ফকিরের সাথে যোগাযোগ করা হয়। এই যোগাযোগ একটি মৌলিক বার্তা বহন করে।
গেরহার্ড মনে করে জাতীয় উৎপাদনে বাউলদের অবদানকে বিনোদন ও শিখন নামে সম্ভাষিত করা যায়। মুজিব ফকিরের মতো বাউলরা গানের আড়ালে ঈশ্বর, ভালোবাসা ও নৈতিকতাকে একত্রিত করে এবং মানুষকে তার জন্ম ও পরিণাম নিয়ে ভাবতে প্ররোচিত করে। স্থানীয় বিদ্বানরা গেরহার্ডকে এই ব্যাখ্যাটি উপহার দিয়েছেন,-বাউলরা এগনোস্টিক। বাংলায় এই শব্দটির অর্থ করা হয়,-মানুষকে চিন্তা করলে ঈশ্বরকে চিন্তা করা সম্ভব। ঈশ্বর এক তীরহীন মহানদী।
মানুষ অচেতন পশুর মতো এই মহানদীকে তার শরীরে বয়ে বেড়ায়। মহানদীর প্রশ্নে সেসবসময় অচেতন; কারণ, এই নদীকে আজো কেউ সম্পূর্ণ জানে না, আর আগামী দিনেও জানতে পারবে না।
গেরহার্ডের কাছে মহানদী একটি জটিল বিশেষ্য, যার ভিতরে ভাইমারের মুখ সে দেখতে পায় না। তবে এই তথ্য ফ্রাউলিনের গোপন অন্তর্বাসে জায়গা করে নিক,- মুজিব ফকির ও শিউলি বালা পরস্পরের স্পর্শে গান করে। সঙ্গীত একটি মারাত্মক যৌন-অন্তর্বাস।
যুদ্ধের দিনেও তারা গান করে। মেঘনা নদীর অগাধ জলরাশির তোড়ে ছোট নৌকায় জীবননদী পাড়ি দেয়ার ক্ষণে সঙ্গত ও সঙ্গীত করে। মুজিব ফকির এক আশ্চর্য প্রেমিক গায়ক! সঙ্গিনীর গোপন অন্তর্বাস উন্মোচনের ক্ষণে সে ঈশ্বরকে দয়াল নামে ডাক দিতে পারে। দয়াল একটি অসীমবাচক ইঙ্গিত। বাউল এই ইঙ্গিতকে গান করে।
মুজিব ফকিরের মধ্য দিয়ে এই গান পৌঁছে যাক ফ্রাউলিনে এবং তা ঢুকে পড়–ক তার সংগোপন অন্তর্বাসে। জাগিয়ে তুলুক ফ্রাউলিনের যৌনতা। গান করে উঠুক সর্বপ্রাণে,-দয়াল তুমি দেখাও লীলা আজব ভূমণ্ডলে/ জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে/ ছায়া তোমার সর্ববৃক্ষে/...দয়াল তুমি নাচাও মোরে/ পাগলের হাট-বাজারে।
প্রিয় ফ্রাউলিন, গেরহার্ড একটি বিপদ সংকেত পাঠালো তোমায়,-নদী ভ্রমণের দিনগুলো ছিল মৃত্যুর আতংক ও জীবনের অনিশ্চয়তায় ভরা। একদিন মধ্যরাতে মেঘনা নদীতে ঝড় উঠেছিল।
আকাশের উপর দিয়ে জঙ্গি বিমানগুলো পাক খাচ্ছিলো। মেঘনার মধ্যবুকে গেরহার্ডকে বহনকারী নৌকাটি নিশ্চিত মৃত্যুর তালে কেবল দুলছিল। তোমায় প্রাণপনে স্মরণ করে উত্থিত হতে চাইছিল সে। গেরহার্ড তোমায় বলছে,-এটি মনে রেখো যে স্মরণ একটি প্রতারক উচ্চারণ; সময়ে সেটি জাগে না। স্মৃতি ও পুরুষাঙ্গে ভাইমারকে জাগাতে না-পেরে নিজেকে সেদিন অসাড় মনে করছিল গেরহার্ড।
মুজিব ফকির এই ভিনদেশি ইহুদিকে তার গানের ভিতরে জড়িত করে নিয়েছিল। ইহুদির জন্য এটি ছিল এক অমলিন স্বস্তি; এক প্রণয়মাখা ভালোবাসা ও চুম্বন। চুম্বনের অর্থ আমি তোমায় বলি,-সঙ্গীত। এটি এক সুমহান যৌনতা। ঈশ্বর এতে জেগে উঠেন বিপন্নকে রক্ষা করবেন বলে!
প্রিয় ভাইমার, আমায় অভিনন্দিত করো এই অনুভবের জন্য যে বেঁচে থাকা একটি মহান অভিজ্ঞতা; আর গেরহার্ড এখনো বেঁচে আছে! প্রিয়তমা ফ্রাউলিন, তোমার গোপন অন্তর্বাসে গেরহার্ডের পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হওয়ার মুহূর্তে মুজিব ফকিরের গানটি অনুধাবন করার চেষ্টা করো।
কারণ, সঙ্গীত হলো সেই উচ্চারণ যেটি প্রতিশ্রুতিকে অনন্তকাল ধরে মানুষের ভিতরে বাঁচিয়ে রাখে। আশা করি তুমি প্রতিশ্রুত যে আমাদের বেঁচে থাকা প্রয়োজন।
‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ সংকটের মুহূর্তে জীবনের গান করার। ফ্রাউলিন, আমার হয়ে প্রতিশ্রুতিটি বুখেনওয়াল্ডের সকল মৃত মানুষের কাছে পৌঁছে দাও। প্রতিশ্রুতি পৌঁছে দাও এক লক্ষ আউশভিৎসে।
একটি মহৎ কৃষক মারা গেছে বুখেনওয়াল্ডে। সে মারা পড়েছে পূর্ব বাংলার অগণিত বধ্যভূমিতে। সেই মহৎ কৃষকের আত্মা স্মরণ করে উচ্চারণ করো...
মৃত্যুর আতংক শেষে নব-বীজের উত্থান/ জীবনের এই তো রীতি ভাই.../ বীজ বুনে চলা কৃষকের কাজ/ বীজ বুনি ধান ভানি/ অপেক্ষা ও আক্ষেপ করি/ উদয়ের/ সেটি কার জানো ভাই.../ আমি অপেক্ষা করি/ শুভবুদ্ধি উদয়ের।
তোমার মাধ্যমে ফ্রাউলিন, কেবল তোমার শরীরকে অনুভব করার মাধ্যমে গেরহার্ড এই সিদ্ধান্তটি পাঠাচ্ছে br />
একটু পরে সকাল হবে। একটু পরে শহরটি আক্রান্ত হবে।
একটু পরে মুক্তিবাহিনী নামবে। একটু পরে জনকের লাশের কাছে যুবতী কন্যাটি ধর্ষিতা হবে। একটু পরে চিকিৎসকের চোখ উপড়ে নেবে বেয়নেট। একটু পরে শহরের একমাত্র জীবিত কবির মুখে বারুদ ঠেসে ধরা হবে। আর, একটু পরে, গেরহার্ড এ-শহর ছেড়ে পালাবে।
প্রিয় ফ্রাউলিন, গেরহার্ড এখনো বেঁচে আছে এই বিস্ময়ের খবরটি রাষ্ট্র করো ভাইমারে। আর মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় হাতে রয়েছে। তোমার মুখে নিরাপত্তার স্বস্তি পাঠিয়ে দিতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগবে আমার। মোজেসকে প্রার্থনা করো,-তিনি যেন করুণা করেন। যেন আমি হ্যাভারসেকটি কাঁধে তুলে নিতে পারি।
যেন পলায়ন করতে পারি সীমান্তে। মিসেস গান্ধি সীমান্তকে এখনো অক্ষত রেখেছেন।
প্রিয় ফ্রাউলিন, পলায়ন তৎপর সংবাদকর্মীর কাছে ভারত একটি মহান রাষ্ট্র। মিসেস গান্ধি সেই রাষ্ট্রের অলংকার। এটি শোফেনস্খিলের বার্তা ছিল যে,-মৃত্যু আসন্ন বুঝলে পালাও।
তার সঙ্গে আমি একমত। কেননা, গেরহার্ড কোনো মুক্তিযোদ্ধা নয়, এবং পূর্ব বাংলা তার দেশ নয়। সে এসেছে সুদূর জার্মানির পাইন বন থেকে। তার গায়ের রঙ বরফের মতো সাদা, আর চুল সোনালি। প্রিয় ফ্রাউলিন, গেরহার্ডের হয়ে মিসেস গান্ধিকে এই শুভাশিস পাঠিয়ে দিও,-দুটি শত্রু রাষ্ট্রের মাঝে ধরা-খাওয়া এই মৃত্যু-উপত্যকা থেকে পলায়নের জন্য তিনি তার সীমান্ত এখনো খোলা রেখেছেন।
তাকে বলো, আমি গেরহার্ড এই শুভাশিস পাঠাচ্ছি। সেই সঙ্গে এটি স্মরণ করিয়ে দিও, ভাইমার নগরীর বাসিন্দা গেরহার্ড মাত্র একবার তাঁকে সাক্ষাৎ করেছিল। তাঁর মনে না-থাকাই স্বভাবিক। মিসেস গান্ধিকে স্মরণ করিয়ে দিও, গেরহার্ড তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল br />
‘আপনি কি পাকিস্তানকে শত্রু মনে করেন? আপনি কি মনে করেন যে পাকিস্তান ভারতকে শত্রু ভাবে?’
মিসেস গান্ধি তার বিখ্যাত পিতার মতো ধারালো ও সুদর্শন ভঙ্গিতে উত্তর করেছিলেন br />
‘আপনি এমন একটি প্রশ্ন করেছেন যার জবাব কোনো রাষ্ট্রপ্রধান সহজে দিতে চাইবেন না। আমি যদি একজন কূটনীতিকের মতো বলি,-ভারত পাকিস্তানকেমিত্র ভাবে এবং আমরা পরস্পরের আত্মীয়, তবে সেটা শুনে আপনি সম্ভবত হাসবেন।
আর যদি বলি পাকিস্তান ভারতকে শত্রু গণ্য করে, তাহলে আপনার জন্যে সেটা হবে আকর্ষণীয় খবর; কারণ এতে তর্ক উসকে উঠবে আর ভারতকে নিন্দা জানাবে সবাই। হতে পারে আমাদের সীমান্ত এতে অস্থির হয়ে উঠবে এবং আপনারা খবর সংগ্রহের জন্য সেখানে ছুটে যাবেন। কেননা, দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে এমন কোনো উত্তেজনা ঘটেনি যে আমি স্নায়ুচাপের বশবর্তী হয়ে এই মন্তব্যটি করবো। আপনার
প্রশ্নের উত্তরে আমি বরং বলবো,-সিন্ধু নদীর তীর ঘেঁষে আমাদের বসতি এই বিরাট ভূখণ্ডে বিস্তৃত হয়েছে, আর নদীকে আপনি যেভাবেই ভাগ করুন-না-কেন,-নদীর জল সবসময় সাগরে গিয়ে পড়বেই। ’
প্রিয় ফ্রাউলিন, মিসেস গান্ধি সুদর্শন রাষ্ট্রনায়ক।
তার সৌন্দর্য ভারতকে অমলিন রাখুক। তাকে এই বার্তাটি পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন,-শেখ মুজিবকে তিনি একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শেখ এখন অনিশ্চিত প্রশ্নবোধক। বাঙালি তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। এবং ঢাকায় বন্দি তার পরিবরাকে হয়তো এরিমধ্যে হত্যা করা হয়েছে।
মিসেস গান্ধিকে এই খবরটি পৌঁছে দিও br />
মার্কিন দেশের জনৈক সংবাদকর্মী কিছুদিন আগে একটি ছবি তুলেছেন। ছবিটি এক নববিবাহিত দম্পতির কাহিনী বলার চেষ্টা করেছে। দম্পতি একটি ছোট শহরের অধিবাসী ছিল। শহরটি আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তারা গ্রামে পলায়ন করে। যুদ্ধ সেখানে পৌঁছে যাওয়ার কারণে যুবক স্বামী তার নবপরিণিতা স্ত্রীকে নিয়ে ভারত সীমান্ত দিয়ে পলায়নের চেষ্টা করে।
এইসময় গুলি বর্ষিত হয়। সীমান্তের ঠিক সেই রেখায় অবস্থানকালে তারা লাশ হয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যাকে নো-ম্যানস-ল্যান্ড নামে আখ্যা দিয়ে থাকেন।
ফ্রাউলিনের হয়ে মিসেস গান্ধিকে গেরহার্ড এই বার্তাটি পৌঁছে দিতে ইচ্ছুক,-নব দম্পতি গেরহার্ডের পরিচিত। যুবকটি ছিল বুদ্ধিমান, আর মেয়েটি ছিল চকোলেট রঙের। ফ্রাউলিনের ছোট বোনের বান্ধবী মার্গারিটের যমজ ছিল সে।
মার্গারিট লিপজিগে বাস করে এবং সে নব বিবাহিত। মার্গারিটের বোনের মৃত্যু এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিগত দিনগুলোয় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকগণ কিছু ওয়াদা করেছিলেন। ওয়াদা সম্ভবত একটি আরবি উচ্চারণ। অঙ্গীকারবাচক শপথ; আর ওয়াদা করা হয় তা না-রাখার জন্য। ওয়াদা-কে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়,-‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’।
প্রিয় ফ্রাউলিন, মিসেস গান্ধির কাছে গেরহার্ডের বার্তাটি পৌঁছানোর চেষ্টা করো,-শেখ মুজিব এখন বিস্ময়বোধক স্মারকের মতো নিখোঁজ। পূর্ব বাংলায় নিয়াজি ও মুক্তি সেনারা পরস্পরের মুখোমুখি। রণাঙ্গনের দিনগুলোয় মুখোমুখি অনিশ্চিয়তা বাচক সম্বোধন হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা এই অনিশ্চিয়তার পরিশেষ আশা করে। আর তা যদি না হয়, সীমান্ত দিয়ে পলায়ন তৎপর হওয়ার ক্ষণে মিসেস গান্ধি ও জেনারেল ইয়াহিয়াকে গেরহার্ড এই আবেদনটি জানিয়ে রাখা আবশ্যক বিবেচনা করে,-নো-ম্যানস-ল্যান্ড হলো শূন্যতাবাচক একটি দৃশ্য, কাজেই জনসংখ্যা সেখানে অবস্থান করতে পারে না।
আপনাদের দক্ষ সেনাদের দিয়ে পূর্ব বাংলাকে জনসংখ্যা-শূন্য নো-ম্যানস-ল্যান্ড বলে ঘোষণা করুন। যদি সেটি সম্ভব না-হয়, গেরহার্ড বিনয়ের সঙ্গে এই আবেদন পেশ করছে,-সৈন্য ও কূটনীতি প্রত্যাহার করে আপনারা জনসংখ্যাকে তার মাটি ফিরিয়ে দিন। তাকে একটি প্রতিশ্রুত উচ্চারণ উপহার দিন যে এই-মুহূর্ত থেকে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা নিরাপদ। তারা এখন জীবনের দিকে মুখ ফিরিয়ে আলোকিত হতে পারে। কারণ জীবন হলো প্রতিশ্রুতিকে উচ্চারণ করা এবং সেই উচ্চারণকে অনন্তকাল ধরে মানুষের ভিতরে জাগিয়ে রাখা।
আশা করি আপনারা প্রতিশ্রুত যে মানুষের বেঁচে থাকা প্রয়োজন...ওভার!
...
বি. দ্র : ‘হরমা’র প্রোলোগ হিসাবে সংবাদকর্মী রিচার্ড গেরহার্ড কোনেলের এই আলেখ্যটি রচনা করেছেন আহমদ মিনহাজ। কতিপয় সত্য-ঘটনা ও ঐতিহাসিক চরিত্র ব্যতীত আলেখ্যে বর্ণিত সংবাদকর্মী এবং সংশ্লিষ্ট চরিত্র ও ঘটনারা আলেখ্যের প্রয়োজনে সৃষ্ট। বাস্তবের কোনো চরিত্রের সঙ্গে সংবাদকর্মী রিচার্ড গেরহার্ড কোনেল বা সংশ্লিষ্ট চরিত্রের কোনো মিল কেউ যদি খুঁজে পান তবে তা অনিচ্ছাকৃত ও রচয়িতার অজ্ঞাতে ঘটেছে। আলেখ্যে ব্যবহৃত সত্য ঘটনা ও চরিত্রে যদি কোনো ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়ে থাকে, এর দায়ভার রচয়িতার নিজের।
‘হরমা’র পক্ষ থেকে এই সাংবাদিক-আলেখ্যটি পৃথিবীর সকল শান্তিকামী ও যুদ্ধ প্রতিরোধী অনুভবের সমর্থনে উৎসর্গ করা হলো।
এটি উৎসর্গিত হলো যুদ্ধ সংক্ষুব্ধ গাজা ও ইরাকবাসীর প্রতি-ও। যেন অদূর ভবিষ্যতে কোনো সংবাদকর্মীকে রক্তপাত ও সহিংসতার এইসব বিবরণ লিখতে না হয়। আমরা যেন এটি স্মরণ করি যে মানুষ এক মহান সুবিবেচক। এই বিবেচনা সকল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জীবনের দিকে আলোকিত রাখুক আমাদের।
__________________________________সম্পাদক, হরমা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।