আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আয়লায় ধ্বস্ত গ্রামে ভালবাসার ফিনিক্স


এভাবেই বনমালীকে রোজ খাওয়ান উদয়বাবু বনমালীর সঙ্গেই সকালের জলখাবার সারেন উদয়বাবু। প্রায় মাস ছয়েক ধরে এই রুটিন। আশির কোঠায় পা রাখা উদয় কুমার মন্ডল গোসাবা থানার কচুখালির বাসিন্দা। গ্রামের আনাচে কানাচে আয়লার চিহ্ন প্রকট এখনও। নোনা জলে ডোবা চাষের জমি।

দুমড়োনো মুচড়োনো ঘরবাড়ি ছেড়েই উপায়হীন গ্রামবাসী জন খাটতে বাইরে যাচ্ছে। কিন্তু এই আয়লাই উদয়বাবুকে বনমালীর সঙ্গে এক মরমী সম্পর্কে বেঁধে ফেলেছে। কী ভাবে পরিচয় হল ওঁদের? আয়লা যে দিন এল, কচূখালিতে ঝড়বৃষ্টি শুরু হল বেলা এগারোটা নাগাদ। খানিক্ষণ পরেই গ্রামে জল ঢুকতে থাকলো। উদয়বাবু বলেন,“আমিও আমার স্ত্রী আর বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার তোড়জোড় করছি।

এমন সময় আচমকা একেবারে আছড়ে এসে পড়ল বনমালী। ঝড়ের দাপটে আর প্রবল বৃষ্টির তোড়ে ভিজে-চুপসে ওর তখন কোথাও যাওয়ার ক্ষমতা নেই। ” এদিকে উদয়বাবুর নিজেরও দিশেহারা দশা। “কোথায় যাব, কী করব কিছু ঠিক নেই। অগত্যা বাড়ির একটা উঁচু জায়গায় কিছু খাবার দিয়ে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

গ্রামে জল তখন আরও বেড়ে গিয়েছে। ” পরম বৈষ্ণব, নিরামিষাশী উদয়বাবু কৃষ্ণের জীবকে কৃষ্ণের চরণেই সঁপে দিয়েছিলেন সে দিন। দিন কয়েক পর বাড়ি ফিরে আর দেখতে পাননি তাকে। তারপর বেশ কিছুদিন চলে গেল। জল কিছুটা নামল।

বিদ্যাধরীর তীরে হঠাৎ সুনসান হয়ে যাওয়া কচুখালির ছোট্ট জনপদে একটু একটু করে সাড়াশব্দ শোনা যেতে লাগল। একদিন সকালবেলা বাড়ির দাওয়ায় বসে জলখাবার খাচ্ছিলেন উদয়বাবু। হঠাৎ একটা কর্কশ আওয়াজ। উপরে তাকাতেই গায়ে সাদা ছিট দেওয়া ধূসর রঙের একটা পাখিকে গাছের ডালে বসে থাকতে দেখলেন তিনি। এ-গাছ ও-গাছে বুড়ি ছুঁয়ে একটু পরে পাখিটা সটান নামল দাওয়ার উপরে।

উদয়বাবু সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলেন তাকে। জিজ্ঞাসা করলেন, “কী রে, কিছু খাবি?” কলামাখা মুড়ি রাখলেন হাতের তেলোর উপরে। পাখিটা নির্ভয়ে হাত থেকেই খেতে লাগল। সেই শুরু। উদয়বাবু পাখির নাম রাখলেন -‘বনমালী’।

এখন আর শুধু জলখাবার নয়। বনমালীর দুপুর আর বিকেলের খাওয়াও উদয়বাবুর সঙ্গেই। মাটিতে বা পাত্রে খাবার দিলে অভিমানী পাখি তা ছুঁয়েও দেখে না। আর কেউ না, শুধু উদয়বাবুর হাত থেকেই খায়। সে সময় মতো না এলে উদয়বাবুরও খাওয়া হয় না।

“আমরা যা খাই, তাই খায়। ভাত, ডালসেদ্ধ, কখনও দু’চার টুকরো ফল। বাড়ির সামনে এসে ডাকলে বুঝতে পারি, খাওয়ার সময় হয়েছে ওর। ” সকাল সাড়ে আটটা, বেলা দেড়টা আর বিকেল চারটে, এই তিনবার তার খাওয়ার সময়। বাকি সময়টা পাখি কোথায় থাকে কেউ জানে না।

‘বনমালী’ বলে ডাক দিলে বাড়ির সামনের গাছে উড়ে এসে তার উপস্থিতি জানান দেয়। আগন্তুক পাখির কুলশীলগোত্র কিছুই জানেন না অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক উদয়বাবু। বলতে পারেননি বনদফতরের কর্তারাও। প্রাথমিক ভাবে তাঁদের অনুমান, বনমালী কোকিল গোত্রীয় কোনও স্ত্রী-পাখি হতে পারে। আরো খোঁজখবর চলছে।

এ সব নিয়ে অবশ্য তত মাথাব্যথা নেই উদয়বাবুর। বনমালীকে খাওয়াতে খাওয়াতেই বললেন, “শুধু পুজোর তিনদিন ও আসেনি। এ ছাড়া রোজ তিন বার করে ওর আসা চাই-ই। আমারও কেমন জানি অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। না এলে মন খারাপ লাগে।

” উদয়বাবুর খড় আর টালির চালাবাড়িতে লোক বলতে স্ত্রী লক্ষ্মীরানি মন্ডল আর শাশুড়ি শোভারানি মন্ডল। বাড়িতে বসেই গ্রামীণ ডাক বিভাগের কিছু অস্থায়ী কাজকর্ম করে তাঁদের সংসার চলে। প্রথমে গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা ভিড় করে দেখতে আসত বনমালীকে। এখন আশপাশের গ্রাম থেকেও মানুষ আসে। বনমালীর তাতে কোনও আপত্তি নেই।

বরং উৎসাহী মানুষের ডাকে সে দিব্যি সাড়া দেয়। হরিশচন্দ্রপুরের কচুখালি গ্রামে এখন কান পাতলেই বনমালীর গল্প। [আনন্দবাজার, ১৩/১১/০৯] ....................................................................................................... আমার বনমালী
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৮ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।