সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!!
আমি জীবনের কঠিন রূপটাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। সময়ের সাথে সাথে মানুষের রূপের পরিবর্তনটাকেও খুব উপলব্ধি করেছি। টিকে থাকা আর উচ্চাশার সিড়িগুলো এক এক করে ভেঙ্গে যেতে দেখেছি। দুঃসময়ে পরিচিত মানুষগুলোর নির্বিঘ্নে সরে যাওয়া দেখেছি। এতদসত্ত্বেও নিজেকে কোনদিন আশ্রয়হীন ভাবিনি।
সত্যি বলতে কোনদিন আশ্রয়হীন ছিলামও না। কারণ আমাকে সর্বদা আগলে রেখেছিলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয়; আমার মা। কোন এক সাধু মহাপুরুষ বলেছিলেন, এ পৃথিবীতে সেই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত যার মা নেই। কাজেই সূত্রানুযায়ী পৃথিবীর সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালালেও আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বঞ্চিত মানুষটির কাতারে ফেলতে পারবেনা। মাঝে মাঝেতো নিজেকে ঈশ্বরের চাইতেও বেশি ভাগ্যবান বলে মনে হয়।
কারণ ঈশ্বরের কোন মা নেই। সে হিসেবে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বঞ্চিত, সবচেয়ে আশ্রয়হীন। সত্যিইতো প্রতাপশালী ঈশ্বরেরতো আসলেই কেউ নেই। সবাই শুধু তাঁর কাছে চায়। চাহিদা অনুযায়ী কাংখিত বস্তুটি পেলে খুশি হয়।
বঞ্চিত হলে অভিশাপ দেয়।
ছেলেবেলায় স্কুলের পড়া ফাকি দেওয়ার জন্য কিংবা একটু ভাল খাবারের আশায় অথবা মায়ের একটু বেশি আদর পাওয়ার জন্য অসুখটাকে খুব বেশি করে কামনা করতাম। কিন্তু কাঙ্খিত অসুখটা যখন আসত তখন এর কষ্টটা স্কুলের স্যারের বেতের চাইতে অনেক বেশি বেদনাদায়ক ছিল। ভাল খাবারগুলো মুখে দিলে চিরতার চাইতেও বেশি তিতা ও বিষধর মনে হত। কিন্তু এসব অপ্রাপ্তির মাঝেও একটা প্রাপ্তির কোন কমতি ছিলনা।
হ্যাঁ, মায়ের বাড়তি আদরটার কোন অপ্রাপ্তি ছিলনা, এর উপস্থিতি ছিল অবধারিত। অসুখের পুরোটা সময় মা তাঁর খাওয়া, নিদ্রা, বিশ্রাম বাদ দিয়ে অপলক দৃষ্টি নিয়ে আমার শিয়রের পাশে বসে থাকতেন। সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। কিন্তু অসুখের সময়ে শিয়রের পাশে বসা মায়ের দৃষ্টিটার কোনরূপ পরিবর্তন আসেনি। এখনও অসুখ হলে মা সব হারানোর শংকা নিয়ে নিজের খাওয়া, নিদ্রা, বিশ্রাম বাদ দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে আমার শিয়রের পাশে বসে থাকেন।
ফুরসত পেলে শিয়রের পাশে আমার সহধর্মিনীও খানিকটা বসেন। অপলক দৃষ্টিতে কিছুটা সময় তাকিয়েও থাকেন। তবে সেই দৃষ্টি জুড়ে থাকে ভবিষ্যত জীবনের নিরাপত্তা বা ছন্দ হারানোর শংকা।
কুড়ি বছর আগে যখন শহরতলীর এই জায়গাটিতে এসেছিলাম তখন স্থানটা একরকমের জনশূন্যই ছিল। আশেপাশে কয়েকটা বাড়ি ছাড়া আর তেমন জনবসতি ছিলনা।
চোখ মেললেই পৃথিবীর শেষ সীমানাটা দেখা যেত। যখন মনটা খুব খারাপ হত বা মা যখন একটু বেশি বকা দিতেন তখন দিগন্ত প্রসারিত শূন্য আকাশটার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতাম আর কোনদিন এ বাড়িতে ফিরে আসবনা। সত্যি সত্যি অজানার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে দিতাম। কিন্তু যখন সন্ধ্যা হয়ে আসত, যখন পাগুলো অবসন্ন হয়ে যেত তখন মনটাও শান্ত হয়ে আসত। বুঝতাম বাড়িতে ফেরা ছাড়া আমার আর কোন বিকল্প নেই।
দিগন্তের এই শূন্যতা আমাকে কেবল শূন্যতাই দিবে, আশ্রয় দিবেনা। সন্ধ্যার আলো-আধারে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন দেখতাম দরোজার একপাশে অশ্রুসজল চোখ নিয়ে মা সরু রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে আছেন। সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন এসে গেছে। শূন্য জায়গাগুলো জনবসতিতে পূর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু এতোসব পরিবর্তনের মাঝেও আমার অনুপস্থিতিতে মায়ের উৎকন্ঠিত চোখের অবয়বে কোন পরিবর্তন আসেনি।
অফিসের বাড়তি কাজ কিংবা রাস্তায় জ্যামের কারণে এখনও বাড়ি ফিরতে দেরি হলে মা উৎকন্ঠিত চোখ দুটো নিয়ে আমার বাড়ি ফিরবার পথটির দিকে তাকিয়ে থাকেন।
পুরো মাসটা পরিবার আর স্বজনদের চাহিদা আর বায়না পূরণ করতে করতেই চলে যায়। একটুও স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়ার সময় পাইনা। মাসের শেষদিকে যখন চাহিদাগুলো আর আগের মতো নির্বিঘ্নে পূরণ হয়না তখন স্ত্রী আর স্বজনদের মুখের দিকে তাকানোর সাহস পাইনা। তাঁদের বিরক্ত দৃষ্টি যেন বারংবার আমাকে জানান দিয়ে যায় আমিই হলাম পৃথিবীতে সবচেয়ে অপদার্থ, সবচেয়ে দায়িত্বহীন।
কিন্তু মা, কোনদিন তাঁর কোন চাহিদা দেখিনা। ভাল তরকারিটা কোন সময়ই জোর করে তাঁর প্লেটে দিতে পারিনা। পরিধানের কাপড়টা পরার অনুপযোগী হয়ে গেলেও কোনদিন মুখ ফুটে তা বলেননা। কোন অভিযোগ তাঁর নেই। তিনি সর্বংসহা।
আমি বুঝি পুরনো এই চশমাটা দিয়ে তিনি স্পষ্ট আর কিছুই দেখতে পাননা। আমি নিজে থেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেও তিনি যাননা। বরং সবসময়ই আমার স্বাস্থ্য নিয়ে আক্ষেপ করেন। শরীরের ওজনটা আমার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। পরিচিতরা ওজন কমানোর প্রতিনিয়ত নানা পরামর্শ দিচ্ছেন।
এই বাড়তি শরীরটা কখনও মায়ের নজরে আসেনা। সবসময়ই আক্ষেপ করে বলেন দিন দিন আমি নাকি শুকনা হয়ে যাচ্ছি। জগতের সবার কাছে অপদার্থ হিসেবে চিহ্নিত এই আমার জন্য মায়ের এ মাত্রাতিরিক্ত ভাবনার কোন যৌক্তিক কারণ শত চেষ্টার পরেও আমি আজ অবধি খঁজে পাইনি।
খুব কম সম্পর্ককেই আমি স্বার্থহীন দেখতে পাই। সম্পর্কগুলোকে ছাকলে প্রাথমিকভাবে আমার কাছে কেবলমাত্র দুটো সম্পর্ককেই স্বার্থহীন মনে হয়।
সম্পর্কগুলো হচ্ছে ঈশ্বরের সাথে তাঁর সৃষ্টির এবং মায়ের সাথে সন্তানের। না, এখানেই আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেইনা। কারণ ভাল করে লক্ষ্য করলে আমি একটা সময় দেখতে পাই ঈশ্বরের সাথে তাঁর সৃষ্টির সম্পর্কটা আসলে পরিপূর্ণ স্বার্থহীন নয়। ঈশ্বর প্রার্থনা চান। ক্ষেত্রবিশেষে ভোগও চান।
যথাযথভাবে এসব ঐশ্বরীক চাহিদার পূরণ না হলে ঈশ্বর আর তাঁর সৃষ্টির সম্পর্কটা জৌলুস হারায়। কিন্তু মা, তিনিতো আপাদমস্তক স্বার্থহীন। তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা, সমস্ত ইচ্ছা শুধু আমার জন্য। এ বিবেচনায়, এখানে ঈশ্বর মায়ের কাছে সম্পূর্ণরূপেই পরাস্ত।
জানিনা পুনর্জন্ম বলে কিছু আছে কিনা।
জানিনা ঈশ্বর পৃথিবীতে জীবকে পুনঃ পুনঃ পাঠান কিনা। জানিনা এমন বিষাদময় আরেকটি জীবনের স্বাদ নেয়ার জন্য ঈশ্বর আমাকে পুনরায় পৃথিবীতে প্রেরণ করবেন কিনা। যদি ঈশ্বর আমাকে পুনরায় পৃথিবীতে পাঠান, যদি সেই জীবনটাও ঠিক এমনই বিষাদের হয় তবে তা মেনে নিতেও আমার কোন আপত্তি নেই যদি সে জন্মেও তিনি আমার এ জন্মের মা'কে মা হিসাবে নির্ধারণ করেন। কিন্তু ঈশ্বর কি তা করবেন? নাকি নিজের মা নেই বলে হিংসায় জ্বলে তিনি আমাকে মায়ের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত করবেন? অনাগত সময়ই কেবল সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
----------------------------------------------------------------------------------
Related Post (Click This Link)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।