ছায়া ছায়ায় পথ হেটে চলি--ছায়া আমার সামনে ও পিছে।
'অশ্রুনদীর সুদূর পারে ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে... নিজের হাতে নিজে বাঁধা ঘরে আধা বাইরে আধা...' আবার তিনিই লিখেছেন 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে...'।
রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন, আমাদের উপলব্ধি করানোর প্রচেষ্টাও করে গেছেন। তবুও আমরা পারিনি। ভয় পাই।
আমাদের মেরুদণ্ড কতো ডিগ্রি কোণে বেঁকে গেছে তা উপলব্ধি করতে ভয় পাই। বগলের তলায় বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে মেরুদণ্ডহীন আমাদের যাপিত জীবন। শিক্ষা কি আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে?
নজরুলের সেই কবিতাটার কথা কি মনে আছে?
সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!”
মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে!
হুজুরের মতে অমত কার?”
সাহেব কহেন, “কী চমৎকার,
বলতেই দাও, আহা হা!”
মোসাহেব বলে, “হুজুরের কথা শুনেই বুঝেছি,
বাহাহা বাহাহা বাহাহা!”
‘ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার’ বলতে বলতে আমরা মুখে ফেণা তুলে ফেলি। ঊর্ধ্বতনের কোনো কথার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করিনা, চন্দ্র-সূর্য যত দিন থাকবে, ততদিন করবোও না!
স্যার হাসেন... আমরা হাসি... স্যার বলেন...। উদ্দেশ্য একটাই নিজের আখের গোছানো, সীমাহীন চাটুকারিতা দ্বারা হাসিল করা নিজ নিজ স্বার্থটুকুন।
আমাদের ভালোবাসা বা আনুগত্য এত প্রবল যে ক্ষমতাবানের কোনো ভুল পদক্ষেপই আমাদের চোখে পড়ে না। আমরা কেবল বলে চলি- সাধু সাধু।
জীবনে উন্নতির উপায়, ভালো চাকুরিজীবী হইবার দুইটি সূত্র সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। মোসাহেবি সূত্র।
সূত্র ১: নির্ভুলতাই কর্তার ধর্ম।
সূত্র ২: যদি কর্তা কোনো ভুল করেন, তাহলে ১ নম্বর সূত্র দ্রষ্টব্য।
ওই যে বললাম সাহেব হাসেন... আমরা হাসি...। সাহেব বলেন... আমরা শুনি...।
এই একবিংশ শতকে এসেও কী নির্মল চাটুকারিতা। এই উত্তর আধুনিকতায় চাটুকারিতা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢোকে গেছে।
লোহিত কণিকার সঙ্গে মোসাহেবি, তোষামোদ আর হুজুর হুজুর কণিকা নামের হাজারটা কণিকা প্রবাহমান। তোষামোদের নির্মল মাদকতায় উতলা হয়ে যান উপর ওয়ালাও। ইহারা সব সাহেব! ইহারা হুজুর। ইহারা ব্রাহ্মণ। সব কাজের কাজি।
আবার নজরুলের কবিতায় ফিরে আসি।
সাহেব কহেন, “আরে ম’লো! আগে
বলতেই দাও গোড়াটা!”
মোসাহেব বলে, “আহা-হা গোড়াটা! হুজুরের গোড়া!
এই, চুপ, চুপ ছোঁড়াটা!”
সাহেব কহেন, “কি বলছিলাম,
গোলমালে গেল গুলায়ে!”
মোসাহেব বলে, “হুজুরের মাথা! গুলাতেই হবে।
দিব কি হস্ত বুলায়ে?”
আমরা মোসাহেবরা হুজুরদের মাথা গুলিয়ে দেই। গুলিয়ে খাই। উন্নতির সোপান রচনা করি।
উন্নতির সোপান! সেখানে আমিই হুজুর। আমিও চাই আসে পাশে হাজারটা মোসাহেব।
আমি হাসবো... অন্যরা হাসবে... আমি বলবো... অন্যরা শুনবে... এই আমাদের নীতি। অন্তর্মুখী নীতি।
সাহেব কহেন, “বসিয়া বসিয়া
পড়েছি কখন ঝিমায়ে!”
মোসাহেব বলে, “এই চুপ সব! হুজুর ঝিমান!
পাখা কর, ডাক নিমাইএ”
সাহেব কহেন, “ঝিমাইনি, কই
এই ত জেগেই রয়েছি!”
মোসাহেব বলে, “হুজুর জেগেই রয়েছেন, তা
আগেই সবারে কয়েছি!”
সাহেব কহেন, “জাগিয়া দেখিনু, জুটিয়াছে যত
হনুমান আর অপদেব!”
“হুজুরের চোখ, যাবে কোথা বাবা?”
প্রণামিয়া কয় মোসাহেব।
।
একদিন সত্যিই নজরুলের মতোই হয়তো হুজুর বলবেন- জাগিয়া দেখিনু, জুটিয়াছে যত হনুমান আর অপদেব! তখন এই সমাজের আমার মতো হনুমানরা কোথায় যাবেন? কোথা হবে ঠিকানা?
হয়তো অন্য কোনো হুজুরের সঙ্গে সহবাসের বিছানা খুঁজবো তখন। একটা বিছানা। দশটা বিছানা। অনাদর্শের বিছানা!
লিখতে ইচ্ছে করছে।
অনেককিছু। বলতে ইচ্ছে করছে। অনেককিছু। পারছি না। লেখার প্রবল তাড়না।
কিন্তু বেরোচ্ছে না কিছুতেই।
মনে আছে না, বুশ সাহেবের কবিতাটা−সেই লরা বুশের ইউরোপ ভ্রমণের সময় জ্যাক শিরাক যখন তার হস্ত চুম্বন করেন, যন্ত্রণাকাতর বুশ লিখলেন−
“Roses are red/Violets are blue/Oh my, lump in the bed/How I”ve missed you,”
বুশ যখন লিখতে পেরেছিলেন, আমিও পারব নিশ্চয়। মনের ভাবটা তো প্রকাশ পেল। সে যতই আবর্জনা হোক না কেন।
আরেকটা কবিতা দিয়ে এই লেখার ইতি টানবো।
জাতীয় কবি কাজী নজরুলের লেখা গদ্য কবিতাকে ব্যঙ্গ করে এটি লিখা হয়েছিল।
‘মারলাম তীর
লাগল কলাগাছে,
হাঁটু বেয়ে রক্ত পড়ে
কার বাপের কী?’
পুনশ্চ: লিখাটা রিপোস্ট করার অপরাধ ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।