আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৭ নভেম্বরের ব্যবচ্ছেদঃ কি পেলাম কি হারালাম

সীমানার প্রাচীর টপকাতে হবে

ছোটবেলাতে ৭ নভেম্বর আসলেই স্কুল ছুটি থাকত। কিন্তু কেন এই ছুটি এই দিনটির কি মাহাত্ম কিছুই জানতাম না। স্কুলের ক্যালেন্ডারের শুধু লিখা থাকত “জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস”। গুরুজনদের জিজ্ঞেস করতাম, কেন এই ছুটি। খুব সদুত্তর পাওয়া যেত না।

চারপাশের মানুষজনকে জিজ্ঞেস করতাম। উত্তর পেতাম খুব ভাসা ভাসা। এই দিন নাকি একটা বিপ্লব হয়েছিল। সিপাহী ও জনতা মিলে বিপ্লব করেছিল। সেই বিপ্লবের মাধ্যমে নাকি দেশ রক্ষা পায়।

নিউজপেপারেও এই রকম কথাবার্তা থাকত। কিভাবে কি ঘটেছিল, ঘটনার পটভূমি কি সবকিছু ছিল ধোয়াটে। ছোট ছিলাম বলে এই নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামাতাম না। স্কুল ছুটি পাওয়া গিয়েছে তাতেই খুব খুশি। সারাদিন মজা করার মত সুযোগ পাওয়া গেল।

ইতিহাস আমাকে খুব টানে। এবং সেটা খুব ছোটবেলা থেকেই। ইতিহাসের মধ্যে কোন রকম ফাঁকফোকরের মধ্যে আমি নেই। তাই ৭ নভেম্বরের এই জোড়াতালি আমি শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু সমস্যা হল প্রকৃত ইতিহাস জানাটাও কিন্তু সহজ না।

কারন ইতিহাস একেক দলের কাছে একেক রকম। নিরপেক্ষ কোন ইতিহাস নেই। তাই আমাকে উলটা কৌশল নিতে হল। ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং-এর একটা ব্যাপার আছে। কোন একটি স্থাপনাকে যদি তিন ডাইমেনশন থেকে প্রজেক্ট করা যায়, তাহলে ঐ স্থাপনার মূল আর্কিটেকচার ঠিকই বের করে নিয়ে আসা যায়।

তাই একেক দলের একেক ইতিহাসকে যদি এক করে নিয়ে আসি তাহলে পুরোটা না হলেও অনেকখানি নির্ভরযোগ্য একটা ইতিহাস ঠিকই বের হয়ে আসবে। এই দিনটি বিএনপির কাছে বিশেষ কিছু। কারন জিয়াউর রহমান এই দিন ক্ষমতায় আসীন হন। আওয়ামী লীগের জন্য এই দিন ভাল-মন্দ কোন দিক থেকেই বিশেষ কিছু না। কিন্তু তারপরেও বিএনপির বিরুদ্ধে থাকার জন্য তারা এই দিনকে দেখে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস হিসেবে।

এইদিনে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মারা যান কোন সন্দেহ নেই তাতে। জাসদের কাছে অবশ্য এই দিনটি বিশেষ কিছু। কারন ঐ দিন তারা বিজয়ী ছিল। কিন্তু অল্পকিছুদিনের মধ্যেই এই বিজয় ধুলোয় মিশে যায় কর্নেল তাহেরের মৃত্যুর সাথে সাথে। এবার আমি আমার পর্যালোচনায় আসি।

এই দিন বিএনপির জন্য বিশেষ দিন দেশের জন্য না এই দিন ব্যাপক রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। এবং সেটা দেশের জন্য কোন শুভকর রক্তক্ষয় ছিল না। খালেদ মোশাররফ সহ বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যান। তাই এই দিনে দেশের কি লাভ হল? শুরুমাত্র ক্ষমতার বদল হল। ক্ষমতার লড়াইয়ের বিজয়ী বিএনপি তাই দলীয়ভাবে এই দিন উদযাপন করতেই পারে।

কিন্তু জাতীয় ছুটি দেয়ার কি মানে? এটা তো জাতীয় কোন বিজয় না। আসলেই কি সিপাহী-জনতা বিপ্লব? এই দিনকে যেভাবে নামকরন করা হয়েছে তাতে সিপাহী এবং জনতাই যেন মূল নায়ক। তারা যেন এক মহান উদ্দেশ্যে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। কিন্তু আসলেই কি তাই? কোন রেফারেন্সে পাওয়া যায় না যে এতে জনতার কোন অংশগ্রহন ছিল। সিপাহীর অবশ্যই অংশগ্রহন ছিল, কিন্তু সেটা সেনা অফিসারদের নেতৃত্বে।

কি এমন মোটিভেশন সিপাহী-জনতাকে উস্কে দিল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার জন্য তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। জিয়াউর রহমান ঐ সময় এমন কোন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন না যে সিপাহী-জনতা স্বতস্ফুর্তভাবে তাকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে আসবে। তার মানে আসলে সিপাহী-জনতার নাম দিয়ে এই দিনকে মহান বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আদতে এটা বানোয়াট ছাড়া আর কিছু না। খালেদ মোশাররফের প্রতি আওয়ামী লীগের এত সহানুভূতি কেন? রাজনীতিতে একটা ট্যাকটিকস কাজ করে।

সেটা শুধু যে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তা না, যেকোন দেশের রাজনীতিতে। এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও। ট্যাকটিকসটা হল, শত্রুর শত্রু হল আমার বন্ধু। শুরুমাত্র এই লজিকের কারনেই কিন্তু আওয়ামী লীগ খালেদ মোশাররফের গুনকীর্তন করে যাচ্ছে। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কোন সন্দেহ নাই।

কিন্তু ১৫ আগস্টে ইতিহাসের অন্যতম জঘন্যতম হত্যাকান্ড যখন ঘটে তখন তিনি কোথায় ছিলেন? তিনি শেখ মুজিবের খুব পছন্দের পাত্র ছিলেন তার কোন প্রমান পাওয়া যায় না। দেশের নড়বড়ে অবস্থায় ক্ষমতালিপ্সা থেকেই তিনি সেনা অভ্যুত্থান ঘটান। যা পরে কিনা অন্যান্য সেনা অফিসাররাও করেন। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানকে আওয়ামী লীগ সাপোর্ট করে আসলে বিএনপির বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য। ৩ নভেম্বর আর ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মধ্যে তো আসলে কোন পার্থক্য নেই।

দুইটাই ক্ষমতালিপ্তার অভ্যুত্থান। ঐ অভ্যুত্থানে যদি শেষ পর্যন্ত খালেদ মোশাররফ জয়ী হতেন তাহলে আমরা জিয়াউর রহমানের পরিবর্তে খালেদ মোশাররফের সেনা শাসন পেতাম। তাতে গনতন্ত্রের জন্য কি বা এমন ভাল হত। কর্নেল তাহের কতখানি মহান নায়ক? আওয়ামী লীগকে দেখা যায় কর্নেল তাহেরের ব্যাপক গুনকীর্তন করতে। এটাও আসলে একটা রাজনৈতিক চাল ছাড়া আর কিছু না।

আমাদের দেশের রাজনীতিবীদেরা কতখানি নিচ তার একটা প্রমান পাওয়া যায় কর্নেল তাহেরের পক্ষে আওয়ামী লীগের গুনকীর্তনে। কিন্তু কেন? কারন মনে রাখতে হবে ৭ নভেম্বরের সেই অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের কিন্তু জিয়াউর রহমানের পক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। এবং তিনিই কিন্তু জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এমন একজনের গুনকীর্তন করে যিনি জিয়াউর রহমানের পক্ষে কাজ করেছিলেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান পথের কাটা দূর করবার জন্য কর্নেল তাহেরকে হত্যা করেন সেটা অন্য বিষয়।

সেটা তাদের নিজেদের ক্ষমতার লড়াই। সেই লড়াইয়ে কর্নেল তাহেরও জয়ী হতে পারতেন এবং জিয়াউর রহমান মারা যেতে পারতেন। তখন তো মনে হয় কর্নেল তাহের আওয়ামী লীগের খলনায়ক হতেন আর জিয়াউর রহমান হতেন মহান নায়ক। আওয়ামী লীগকে তখন দেখা যেত জিয়াউর রহমানের গুনকীর্তনে ব্যস্ত হতে। ক্ষমতায় কর্নেল তাহের আসলে হয়ত জামায়াত রাজাকারগুষ্ঠির পুনর্বাসন হত না।

কারন তিনি বামপন্থী ছিলেন। এই কারনেই জাসদ তাকে ব্যাকআপ দেয়। বাম দলগুলো আজ আওয়ামী লীগের মিত্র হলেও তখন কিন্তু তারা ছিল মূল বিরোধী দল। বামপন্থীদের একটা অংশ কিন্তু চরমপন্থী সর্বহারা ছিল। এই সর্বহারাদের অত্যাচার কিন্তু এই দেশকে দীর্ঘদিন অনেক ভুগিয়েছে।

বর্তমানের আমরা সেটা হয়ত ভুলে গিয়েছি। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে বামপন্থীদের অভ্যুত্থান তাই দেশের জন্য এমন কোন সুখকর হত না। আবারও সেই ভারতীয় জুজু ৭ নভেম্বর না ঘটলে নাকি ভারতীয় দাদারা এই দেশ শাসন করত। খুবই হাস্যকর ব্যাপার যে, বিএনপি সেই ৭৫ সাল থেকে শুরু করে আজও একই ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই জুজুর ভয় যে আজ হাস্যকর ব্যাপারে দাড়িয়েছে সেটা কি তারা বুঝতে পারে না? ৯১ এর নির্বাচনে ঐ জুজু অনেকখানি কাজে দিয়েছিল কোন সন্দেহ নাই।

জুজু দেখিয়ে তারা ভোট ব্যাংক হাতাতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে সেই জুজুর ভয় যে কতখানি ফাপা একটা বিষয় সেটা কিন্তু দেশের মানুষ ঠিকই বুঝতে পেরেছে। গ্রামের কিছু সহজ-সরল মানুষ ছাড়া মনে হয় কেউ আর ভারতীয় জুজুর কথায় প্রভাবিত হয় না। বাংলাদেশ দখল করার ইচ্ছা থাকলে ভারত তো সেই ৭১ এই দখল করতে পারত। ঐ যুদ্ধবস্থায় এমন ঘটনাতে বিশ্বশক্তিগুলোর তেমন মাথাব্যাথাও থাকত না।

এমনকি এখনো ভারতের পক্ষে সামরিকভাবে বাংলাদেশকে দখল করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার না, সেটা সবাই বুঝে। কিন্তু ভারতের তাতে কি স্বার্থ? এই দেশের ১৫ কোটি মানুষের দায়িত্বভার নেয়ার কি এমন স্বার্থ তাদের আছে? এই দেশের রিসোর্সও কি খুব বেশি, যার জন্য ভারত লোভাতুর হয়ে থাকবে? বরং এই দেশের প্রতি বড় লোভ হচ্ছে এই দেশের মার্কেট। আর সেটা তো ভারত এমনিতেই দখল করে রেখেছে। তার জন্য সামরিক অভিযানের তো কোন দরকার নেই। তাই ৭ নভেম্বর এই দেশের সিপাহী-জনতা ভারতীয় দাদাদের শাসন থেকে রক্ষা করেছে এটা খুব হাস্যকর একটা কথা।

সর্বশেষ কথা এই যে, ৭ নভেম্বর আমাদের জনগনের জন্য বিশেষ কোন দিন না। এই দিন থাকা বা না থাকাতে আমাদের বিশেষ কোন আসে যায় না। সেনাদের ক্ষমতার লড়াইয়ে কে জিতল আর কে হারল তাতে আমাদের কি? আমরা ঘুরে ফিরে সেই সেনা শাসনই পেতাম। আর গনতন্ত্রের জন্য ধুকতাম।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।